বুধবার, ৪ এপ্রিল, ২০১৮ ০০:০০ টা

রেললাইনে যমদূত হেডফোন

মির্জা মেহেদী তমাল

রেললাইনে যমদূত হেডফোন

ঢাকায় চাকরি খুঁজতে এসেছিলেন তিন সন্তানের জনক ময়মনসিংহের হাবিবুর রহমান (৩০)। সারা দিন ঘুরেফিরে রাতেই বাড়ি ফিরবেন। টঙ্গী স্টেশন থেকে ট্রেনে চড়ে যাবেন ময়মনসিংহ। সন্ধ্যার দিকে মোবাইল ফোন থেকে কানে হেডফোন লাগিয়ে তিনি টঙ্গীর গাজীবাড়ী এলাকায় রেলপথ ধরে হাঁটছিলেন। কিন্তু মুহূর্তেই সব শেষ। ঢাকাগামী  দ্রুতগতির আন্তনগর ট্রেনে কাটা পড়ে দ্বিখণ্ডিত হয়ে যান হেডফোনে কথা বলায় মগ্ন হাবিব। এই মৃত্যুতে তার পরিবারের ভবিষ্যৎ এখন অনিশ্চিত। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী শিক্ষার্থী সান্ত্বনা বসাক। বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের পাশের রেললাইনে এক বিকালে হেঁটে হেঁটে মোবাইল ফোনে কথা বলছিলেন। কানে লাগানো ছিল হেডফোন। পেছন থেকে ছুটে আসছিল দ্রুতগতির পদ্মা এক্সপ্রেস। ট্রেনটি হর্ন বাজালেও ফোনালাপে মগ্ন সান্ত্বনা বুঝতে পারেননি। ফল যা হওয়ার তা-ই হলো। ট্রেনে কাটা পড়ে মারা যান সমাজকর্ম বিভাগের তৃতীয় বর্ষের এই শিক্ষার্থী। একটি জীবনের সঙ্গে সঙ্গে শেষ হয়ে যায় একটি পরিবারের স্বপ্নও। রাজধানীর তেজগাঁওয়ের নাখালপাড়া রেললাইন ধরে হাঁটছিলেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের দ্বিতীয় সেমিস্টারের ছাত্র মো. ওবায়দুল্লাহ (২৪)। তিনিও কানে হেডফোন লাগিয়ে মোবাইল ফোনে কথা বলছিলেন। ভরদুপুরে দ্রুতগামী ট্রেনের ধাক্কায় ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু ঘটে। রাজশাহীতে একইভাবে ট্রেনে কাটা পড়ে প্রাণ হারান রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আরিফ আরমান সজীব (২১)। এ কটি ঘটনাই শুধু নয়, রাজধানীসহ সারা দেশে প্রায় প্রতিদিনই ঘটছে এমন মর্মান্তিক মৃত্যু। মুহূর্তের অসাবধানতা শেষ করে দিচ্ছে সব। একটি জীবন, একটি পরিবারের স্বপ্ন। রেললাইন ধরে মোবাইলে কথা বলতে বলতে অনেকেই বিপদ ডেকে আনছেন। হেডফোন আশপাশের কোলাহলপূর্ণ জীবন, পরিবারসহ সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে মানুষকে। হেডফোনে মোবাইলে মগ্ন থাকার কারণে ট্রেনের বিকট হর্নও কানে যাচ্ছে না। এতে বিকট শব্দে ছুটে আসা দ্রুতগতির ট্রেন কখন যে পেছনে এসে গেছে তার খেয়াল আর থাকছে না। মুহূর্তেই দেহ হয়ে যায় তাদের ছিন্নভিন্ন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, হেডফোন এখন ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে। বর্তমানে ট্রেনে কাটা পড়ে প্রাণহানির ঘটনার মধ্যে বেশির ভাগই ঘটছে হেডফোন ব্যবহারের কারণে। যেন রেললাইনে যমদূত হয়ে উঠেছে হেডফোন। স্কুলছাত্র থেকে শুরু করে বয়স্ক লোকও হেডফোনের কারণে প্রাণ হারাচ্ছেন ট্রেনে কাটা পড়ে। হেডফোন কেড়ে নিয়েছে এসব পরিবারের স্বপ্ন। কেউ হয়েছেন বিধবা। কোনো সন্তান হয়েছে পিতৃহারা। ঢাকা রেলওয়ে থানা পুলিশের (জিআরপি) হিসাবমতে, গত বছর নারায়ণগঞ্জ থেকে বঙ্গবন্ধু সেতু পর্যন্ত রেললাইনে ৪০০-এর বেশি ট্রেনে কাটা লাশ পাওয়া যায়। এর মধ্য ২০০-এর বেশি লোকের মৃত্যু হয় হেডফোনের কারণে। রেলওয়ে পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, রেললাইন ধরে হেঁটে যায় মানুষ। কানে হেডফোন। কখনো হাসছে, কখনো নাচছে। আশপাশে কী হচ্ছে সেদিকে খেয়াল থাকে না তাদের। আনমনে হেঁটে চলেছে রেললাইন ধরে। ট্রেনের বিকট হুইসেলও তার কানে পৌঁছে না। একপর্যায়ে ট্রেন চলে যায় তাকে পিষ্ট করে। কাটা পড়ে দেহ। খণ্ড-বিখণ্ড দেহ পড়ে থাকে রেললাইনের পাশে। এমন করুণ মৃত্যু বেশ কবছর ধরে অহরহ ঘটছে। তার পরও অসচেতন মানুষ। তিনি বলেন, কানে হেডফোন লাগিয়ে ক্যান্টনমেন্টের স্টাফ রোড দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল ২০ বছরের টগবগে যুবক রায়হান হোসেন। রেললাইন ধরে বেখেয়ালে হাঁটছিল। এমন সময় পেছন থেকে হুইসেল দিতে দিতে ছুটে আসে কমলাপুর থেকে ছেড়ে আসা সিলেটগামী পারাবত এক্সপ্রেস। নিশ্চিত মৃত্যু জেনে দূর থেকে মানুষজনও চিৎকার করে ডাকছিল তাকে। ট্রেন আসছে, ট্রেন আসছে, সরে দাঁড়াও— এ চিৎকারও তার কানে পৌঁছেনি। চোখের সামনে তরতাজা যুবক রায়হান ট্রেনে কাটা পড়ে। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় তার। সামান্য সচেতনতার অভাবে এভাবেই মায়ের বুক খালি হচ্ছে। মহাখালী, তেজগাঁও, মগবাজার ও কারওয়ান বাজার ক্রসিংয়ে মোট আট ঘণ্টা পর্যবেক্ষণ করা হয়। এই সময়ের মধ্যে ৪৮ জনকে দেখা যায় মোবাইল ফোনে কথা বলছে বা কানে হেডফোন লাগিয়ে রেললাইন ধরে হাঁটছে। ঢাকা রেলওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ইয়াসিন ফারুক বলেন, ‘যারা এভাবে চলে, তাদের বাধা দেওয়া হয়। দুর্ঘটনা এড়ানোর জন্য আমাদের জনসচেতনতামূলক কর্মকাণ্ড অব্যাহত রয়েছে। মানুষের নিজস্ব সচেতনতা না এলে দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব নয়।’ তেজগাঁও ক্রসিংয়ে আলতাফ নামের একজন বলেন, তিনি সচেতন থাকবেন। কিন্তু কয়েকজন বলেন, প্রয়োজনেই তারা মোবাইলে কথা বলেন। এ ছাড়া ট্রেনের সময়সূচি সম্পর্কে তাদের ধারণা আছে। তাই বিষয়টি নিয়ে তারা চিন্তা করেন না। আবার আলতাফের মতো কেউ কেউ সতর্ক থাকবেন বলেন। কবির নামের একজন বললেন, মালিবাগ থেকে হেঁটে প্রতিদিন কারওয়ান বাজারে আসেন। রেললাইন ধরেই হাঁটেন। এ সময় ফোন আসে আবার অনেক সময় হেডফোন লাগিয়ে গান শুনতে শুনতে আসেন।

 তিনি বলেন, ‘আমি জানি এটা ঠিক হচ্ছে না। কিন্তু একা একা হাঁটতে বোর (বিরক্ত) লাগে। এজন্য গান শুনি।’ তেজগাঁও রেলস্টেশনের একজন নিরাপত্তা কর্মকর্তা বলেন, ‘কানে হেডফোন দিয়ে মানুষ চলাচল করতে দেখলে আমরা তাদের সতর্ক করি।’ তিনি আরও বলেন, ‘ট্রেন অনেক কাছে, এমন অবস্থায় কাউকে ঢিল দিয়ে বা লাঠি দিয়ে সতর্ক করলে উল্টো মন্দ কথা শুনতে হয়, আবার অনেকেই তাদের ভুল বুঝতে পেরে দুঃখপ্রকাশ করেন।’ পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, কানে হেডফোন দিয়ে চলাচল করাটা মানুষের বিবেক-বিবেচনার বিষয়। নিজে সচেতন না হলে আইন দিয়ে এসব বন্ধ করা সম্ভব নয়। তাই প্রত্যেককেই সচেতন হতে হবে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর