বুধবার, ৪ এপ্রিল, ২০১৮ ০০:০০ টা

তিন মিনিটে হয় গাড়ি

জয়শ্রী ভাদুড়ী, পুনে, ভারত থেকে ফিরে

তিন মিনিটে হয় গাড়ি

ভারতের পুনেতে মাহিন্দ্রর গাড়ি কারখানায় চলছে কাজ —বাংলাদেশ প্রতিদিন

প্রবেশপথের পাশেই দুপুরের কড়া রোদে ঝলমল করছে সোনালি ফুল। প্রকৃতির এই ফুলেল উষ্ণ অভ্যর্থনা পার হতেই কানে আসে লোহা লক্কড়ের কঠিন শব্দ। মহাব্যবস্থাপক শ্যাম ওজারকারের নিরাপত্তামূলক নির্দেশনা মেনে ভেতরে ঢুকতেই চোখ ছানাবড়া। ধাপে ধাপে পথ পরিক্রমা শেষ করে মুহূর্তের মধ্যে তৈরি হচ্ছে ট্রাক। কর্মীদের হাতের নিপুণ দক্ষতা আর অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়ায় কঠোর মান নিয়ন্ত্রণের গ্রিন সিগন্যাল পার হলেই গ্রাহকদের হাতে পৌঁছাবে গাড়ি। প্রতি তিন মিনিটে একটি প্রাইভেটকার এবং সাড়ে ছয় মিনিটে একটি ট্রাক তৈরি করে প্রতিনিয়ত উৎকর্ষতার ধারাবাহিকতা অব্যাহত রেখে কাজ করছে মাহিন্দ্র ভেহিকেল ম্যানুফাকচারারস লিমিটেড। বাংলাদেশের কৃষি, ব্যবসা এবং পরিবহন খাতে বাড়ছে মাহিন্দ্র কোম্পানির গাড়ির সংখ্যা।

মাহিন্দ্র অ্যান্ড মাহিন্দ্র লিমিটিডের হেড অব অপারেশনসের সাউথ এশিয়ার ভাইস প্রেসিডেন্ট সঞ্জয় যাদভ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমরা বাংলাদেশে ২৫ বছর ধরে ব্যবসা পরিচালনা করে আসছি। বাংলাদেশের    ক্রেতাদের সঙ্গে আমরা সুসম্পর্ক গড়ে তুলেছি। ব্যবসায়ীরা আমাদের ট্রাক এবং পিকআপ ব্যবহার করে তাদের ব্যবসায় সাফল্য নিয়ে আসছে। তিনি আরো বলেন, আমরা মানুষের প্রয়োজন অনুযায়ী পণ্য তৈরি করে সরবরাহ করছি এবং কৃষকদের খুবই কাছে থেকে কাজ করছি। আমাদের সরবরাহ করা ট্রাক্টর কৃষকদের ভালো সার্ভিস দিচ্ছে। তাদের হাত ধরে বিপ্লব ঘটছে কৃষিতে। এটাই আমাদের বড় পাওয়া। সম্প্রতি ঢাকার বনানীতে ব্রাঞ্চ অফিস নেওয়া হয়েছে। এর সঙ্গে বাংলাদেশে কারখানা নির্মাণ করে গাড়ি উৎপাদনের বিষয়ে পরিকল্পনা করছি আমরা। ২০১৬ সালে বাংলাদেশে ৬ হাজার ৭০০ এবং ২০১৭ সালে ৯ হাজার ৫০০ ট্রাক রফতানি করেছি। বাংলাদেশের ক্রেতাদের কাছে আমাদের প্রতিষ্ঠানের ট্রাক, ট্রাক্টর, পিকআপ এবং প্রাইভেটকারের চাহিদা প্রতি বছরই বাড়ছে। ২০০৭ সালে ভারতের মহারাষ্ট্রের পুনের চাকানে মাহিন্দ্র ভেহিকেল ম্যানুফাকচারারস লিমিটেড নামে ৭শ একর জায়গা নিয়ে গড়ে উঠেছে এই কারখানা। বর্তমান সক্ষমতায় প্রতি বছর ৩ দশমিক ২ লাখ যানবাহন তৈরি হয় এ কারখানা থেকে। ভারতের গণ্ডি পার করে শুধু বাংলাদেশ নয় বিশ্বের ১০০টি দেশে ২ লাখ ৪০ হাজার কর্মী কাজ করছে মাহিন্দ্রতে। সর্বোচ্চ মানের ম্যানুফ্যাকচারিং প্রযুক্তি, প্রায়োগিক দক্ষতা, নির্মল পরিবেশ ধরে রাখা এবং সামাজিক দায়বদ্ধতার দায়িত্ব নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। সভ্যতার উন্নয়নের সূতিকাগার ছিল চাকার উদ্ভাবন। এখন তা গিয়ে দাঁড়িয়েছে পরিবহন খাতের ওপরে। প্রতিনিয়তই বাড়ছে পরিবহনের চাহিদা। ব্যবসায়িক বা ব্যক্তিগত প্রয়োজনে খোঁজ পড়ছে গাড়ির। স্বল্পমূল্যে সার্বিক সুবিধা এবং উন্নত সেবার প্রতিশ্রুতি নিয়ে কাজ করছে মাহিন্দ্র ভেহিকেল ম্যানুফাকচারারস লিমিটেড। শিক্ষিত এবং প্রায়োগিক দক্ষ তরুণদের কাজের এক অন্যতম ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে এই প্রতিষ্ঠানটি। তাই সেই কর্মযজ্ঞ দেখতে মুম্বাইয়ের রামাদা প্যালেস থেকে সকাল সাড়ে ছয়টায় শুরু হয় যাত্রা। সূর্যের প্রথম আলোয় স্নাত পাহাড়ের গায়ে গড়িয়ে পড়ছে মেঘ। টানেল পার হয়ে পাহাড় ঘেঁষে বাংলাদেশি ইয়ুথ ডেলিগেশনের শত তরুণকে নিয়ে এগিয়ে চলছে পর্যটকবাহী বাস। দুপুর ১২টা পার হতেই প্রধান ফটক পেরিয়ে গাড়ি প্রবেশ করল মাহিন্দ্র ভেহিকেল ম্যানুফাকচারারস লিমিটেডের কারখানার ভেতরে। নানা আয়োজনে চলছে অতিথিবরণ। কিন্তু সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে কখন চোখের সামনে নির্মাণ শেষে বেরিয়ে আসবে ব্র্যান্ড নিউ গাড়ি। অবশেষে প্রথম পর্বের আনুষ্ঠানিকতা শেষে নিরাপত্তা বিষয়ে নির্দেশনা দিয়ে প্রতিষ্ঠানের মহাব্যবস্থাপক শ্যাম ওজারকার সঙ্গে নিয়ে চলছেন নির্মাণ প্রক্রিয়া পরিদর্শনে। এস্কেলেটরে এগিয়ে আসছে ট্রাকের চেসিস, উপরের হ্যাঙ্গারে ঝুলছে ট্রাকের সামনের অংশ। হাতে যন্ত্রপাতি নিয়ে প্রস্তুত কর্মীরা। গ্রিন সিগন্যাল পড়তেই একটা নির্দিষ্ট জায়গায় এসে দাঁড়াল ট্রাকের চেসিসসহ নিচের অংশ। একই সঙ্গে সাইরেন বাজিয়ে নামতে থাকল ওপরের অংশ। কিন্তু খটকা লাগছিল যখন দেখা গেল উল্টো হয়ে নামছে ট্রাকের মাথার অংশ। ঠিক এ সময় হাতে-কলম দিয়ে টোকা দিলেন নির্দেশক। ‘এ সময় চোখের পলক ফেলা যাবে না। বিষয়টা ক্যাচ মিস তো ম্যাচ মিসের মতো।’ ঘটনা তাই! চোখের পলকে হুট করে উল্টে গেল পুরো অংশটি, সোজা হয়ে স্থাপিত হলো চেসিসের অগ্রভাগে। সঙ্গে সঙ্গে নিপুণ দক্ষতায় দ্রুততম সময়ে নাট-বল্টু থেকে শুরু করে যাবতীয় কার্যক্রম শেষ করে ফেললেন শ্রমিকরা। মুড়ি-মুড়কির মতো প্রযুক্তি আর হাতের দক্ষতায় তৈরি হলো ৩০ টন পণ্যবাহী ট্রাক। এবার প্রতিষ্ঠানটির সিনিয়র ম্যানেজার যোগেশ ঘোগলের নির্দেশনায় সবাই পা বাড়াল কার জোনে। সেখানে আরো তেলেসমাতি কারবার। একই প্রক্রিয়ায় প্রতিটি যন্ত্র সংযোজন শেষে মুহূর্তে টেস্টিং ধাপে এগিয়ে যাচ্ছে ব্র্যান্ড নিউ কার। এভাবে প্রতি ঘণ্টায় তৈরি হয় ২০টি গাড়ি। হিসাব করলে তিন মিনিটে একটি গাড়ি। ডুয়েল ঝকঝকে রং আর গতির ঝটকায় চোখ ধাঁধিয়ে যায় দর্শকদের। মাহিন্দ্র ভেহিকেল ম্যানুফ্যাকচারারস লিমিটেডের সাউথ এশিয়া ইন্টারন্যাশনাল অপারেশনস ব্যবস্থাপক (ব্র্যান্ড এবং সিআরএম) মৌপ্রিয়া দাস বলেন, শুধু ব্যবসায়িক উদ্যোগ নয় শিশুদের শিক্ষাকে এগিয়ে নিতে এই প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে ‘নান্নি কলি’ অর্থাৎ ফুলের কুঁড়ি নামে নেওয়া হয়েছে একটি প্রকল্প। এর মধ্য দিয়ে দরিদ্র শিশুদের শিক্ষায় অবদান রাখছে প্রতিষ্ঠানটি। তিনি আরো বলেন, কর্মীদের দক্ষ করে তুলতে ‘গুরুকুল’ নামে প্রশিক্ষণকেন্দ্র আছে প্রতিষ্ঠানটির। সেখানে নতুন মডেলের গাড়ি নির্মাণ বিষয়ে প্রশিক্ষিত করা হয় কর্মীদের। ঝুঁকিপূর্ণ কাজের জন্য ব্যবহার হয় অত্যাধুনিক রোবট। প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব আইটি বিশেষজ্ঞরা প্রতিনিয়ত গবেষণা করে নিত্যনতুন সফটওয়্যার তৈরি করছেন কাজের গতি এবং মান নিয়ন্ত্রণে। সবার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় শতভাগ গ্রাহক সেবার নিশ্চয়তা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর