শনিবার, ১৪ এপ্রিল, ২০১৮ ০০:০০ টা

হাজার বছরের ঐতিহ্য কি বিসর্জন দিতেই হবে?

কামাল লোহানী

হাজার বছরের গর্ব-গৌরব বাঙালিয়ানার। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বিপুল রক্তক্ষরণে অর্জিত স্বাধীনতা আমাদের দিয়েছে যে অহংকার ও মানুষের প্রত্যাশিত অধিকার, সেই ঐতিহ্য-ইতিহাসকেই আমরা দাঙ্গাবাজ সন্ত্রাসী মানুষখেকো নরপিশাচদের সাম্প্রদায়িকতার কাছে বিসর্জন দিচ্ছি কেন? এ যে লাখো শহীদের রক্তে অর্জিত বাংলাদেশকে কলঙ্কিত করছে, শহীদদের প্রতি হীন অশ্রদ্ধা প্রদর্শন করা হচ্ছে, এ কথা কি আমরা জানি না? তবু কেন বাংলার মানুষের পূর্বপুরুষদের উত্তরাধিকার, ঐতিহ্যকে আমরাই ধ্বংস করছি হীন স্বার্থে? আমরা তো হরহামেশাই দাবি করি, এ দেশটা হাজার বছরের ইতিহাসে সমৃদ্ধ-অসাম্প্রদায়িক বাংলার ঐতিহ্যে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া, সুদীর্ঘ ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে, তাকে কেন আজ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সমৃদ্ধ-আমরা মুখে যতই বলি না কেন, কথায় ও কাজে অপমান করছি ধর্মান্ধতার বলি হিসেবে। রাষ্ট্র কি বর্তমান সরকারের মাধ্যমে আমাদের ঐতিহ্যবাহী বাঙালিয়ানাকে অপমান করতে, নস্যাৎ করতে নববর্ষ পালনে নিষেধাজ্ঞা জারি করে নির্দেশ দিয়ে পয়লা বৈশাখের কয়েকটি অনুষ্ঠান বিকাল ৫টায় শেষ করার হুকুম জারি করেছে? যে জাতি মুক্তিযুদ্ধ করেছে পরাক্রমশালী পাকিস্তানি নরপিশাচ ওই হায়েনা-হানাদার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে, পরাজিত নয়, কেবল নাস্তানাবুদ করে আত্মসমর্পণে বাধ্য করেছিলাম একাত্তরে, সেই বিজয়ী বাংলার অমিততেজ মানুষেরা কেন ধর্মান্ধগোষ্ঠীর ভয়ে গুটিয়ে নেবে আমাদের বংশপরম্পরার ঐতিহ্যবাহী নববর্ষের প্রথম সূর্যপ্রণাম থেকে হালখাতা আর দলবদ্ধভাবে পাড়ায়-মহল্লায় সান্ধ্য সাংস্কৃতিক উৎসব আয়োজন? কেন তাদের ওই ধর্মান্ধগোষ্ঠীর উগ্র মানসিকতা ও ভয়ভীতির কারণে ঘরে ঢুকে যেতে হবে রোদভরা বিকালেই? কী লজ্জা, কী কলঙ্ক! শাসকগোষ্ঠী বলবেন নিরাপত্তার কথা। এই নিরাপত্তা কি রাষ্ট্রই এতকাল দিয়ে আসেনি? যদি তাই সত্যি হবে তবে এখন কেন এই নিষেধাজ্ঞা? একি আত্মসমর্পণ নয়? কেন ধর্মান্ধগোষ্ঠীর সাম্প্রদায়িকতার কাছে পরাভব মেনে নিচ্ছি, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে? মুক্তিযুদ্ধের এই প্রিয় মাতৃভূমিতে কেন আজ শকুনির মচ্ছবে আমরাও বিসর্জন দিচ্ছি নিজেদের? বাংলার ক্যালেন্ডারে সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত হলো বাঙালির দিনমান। তাকে কেন খর্ব করছি হেফাজতের ভয়ে? এতে কি সরকার তথা রাষ্ট্রেরই প্রশাসনিক দুর্বলতা প্রমাণ হচ্ছে না? যাদের পরাজিত করলাম ধর্মনিরপেক্ষতা স্লোগান দিয়ে, তাদের কাছেই বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলাকে মান-সম্মান, প্রচলিত রীতিনীতি বিসর্জন দিতে হবে? কেন? আমরা কি ভয় পেয়েছি? না। এ কথা মনে রাখতে হবে, আমরা ক্ষুদিরাম, সূর্যসেন-সালাম-বরকত, রফিক ও জব্বারের উত্তরসূরি, আমরা আসাদ, জোহা শত-শহীদের উত্তরপুরুষ, আমরাই তো ব্রিটিশ তাড়িয়ে পাকিস্তানি নরপিশাচদের দাম্ভিক অস্ত্রের শক্তিকে পরাজিত করে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ও বাংলার অকুতোভয় গণমানুষের প্রত্যাশা, আকাঙ্ক্ষা-অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশকে বাস্তবায়িত করতে চাই, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়। যে নববর্ষ-পয়লা বৈশাখ পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক আমলে জেল-জুলুম, নির্যাতন-নিপীড়ন সত্ত্বেও জাতিসত্ত্বার অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই করে বিজয়ী হয়েছি, সেই আমরা কেন আজ ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক অপশক্তির কাছে মাথা হেঁট করছি? বলবেন হয়তো, জমানা পাল্টেছে তাই কৌশল অবলম্বন করছেন। কিন্তু একি সেই সাম্প্রদায়িক অপশক্তিকেই প্রশ্রয় দেওয়া হচ্ছে না, আমরা কি ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে মানুষকেই ঘরে ঢুকে যেতে বলছি না? সন্ধ্যার অনুষ্ঠানমালা ও নাটক মঞ্চায়ন কি তাহলে রোদভরা বিকালেই শেষ করতে হবে? কেন? কার ভয়ে? ওই হেফাজত-জামায়াত জঙ্গিবাদের ভয়ে? কেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এমন ভয়ার্ত নির্দেশ দিয়ে নববর্ষের আনন্দমুখর চিরাচরিত পরিবেশকে এমন ভয়ঙ্কর করে তুলে বাংলার জনগণের উৎসবমুখরতাকে শৃঙ্খলিত করছেন। যে কারণে এই নির্দেশ জারি করা হচ্ছে তাকে খুঁজে বের করে, সেই সংকট সমাধান করতে হবে। তাই সনির্বন্ধ অনুরোধ মানুষের হাতে পায়ে বেড়ি পরাবেন না। এতে মানুষের মনে ক্ষোভ জমা হবে। ক্ষোভই কিন্তু জমে একসময় ক্রোধে পরিণত হয়, সে কথা ভুলে যাবেন না। অতীত ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ করুন। জনগণে আস্থা রাখুন। বিশ্বাস করলে মানুষ ’৫২, ’৬২, ’৬৯, ’৭০, ’৭১ ঘটাতে পারে। এ কথা মনে রাখবেন। মানুষকে প্রাণের উৎসব করতে দিন। নিরাপত্তার ব্যবস্থা আপনারা করুন, যাদের দায়িত্বই নিরাপত্তা দেওয়া। সিসিটিভি বসিয়েও কোনো লাভ হচ্ছে না। প্রমাণ মিললেও আমলে নিচ্ছেন না। তাই বলি নিরাপত্তার অজুহাত দেখানো বন্ধ করুন, বরং ব্যবস্থা নিন। লেখক : প্রবীণ সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব

সর্বশেষ খবর