শনিবার, ১৪ এপ্রিল, ২০১৮ ০০:০০ টা

জাতিসত্তার উৎসব বৈশাখ

-- শামসুজ্জামান খান

ঝর্ণা মনি

বাঙালি উৎসবমুখর জাতি। আর পয়লা বৈশাখ আমাদের জাতিসত্তার উৎসব। আমরা একটি আনন্দঘন উৎসব করতে চাই। যেখানে হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান— সবাই যেন আমরা বাঙালি, এই চেতনাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে পারি। এই বোধে যেন আমরা জাগ্রত হতে পারি। বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনের সঙ্গে বিশেষ সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন। পয়লা বৈশাখ, বর্তমান পরিবর্তন ও পরিমার্জনের ধারা, ইতিহাস-ঐতিহ্য-কৃষ্টির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ভবিষ্যতের করণীয় বিষয়েও আলোচনা করেন লোকসাহিত্যের এই গবেষক। পয়লা বৈশাখ বাঙালি সংস্কৃতির প্রধান উৎসব উল্লেখ করে অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান বলেন, বাংলা নববর্ষে মহামিলনের আনন্দ উৎসব থেকেই বাঙালি ধর্মান্ধ অপশক্তির কূট ষড়যন্ত্রের জাল ভেদ করার আর কুসংস্কার ও কূপমণ্ডুকতার বিরুদ্ধে লড়াই করার অনুপ্রেরণা পায়। জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়। নববর্ষের ইতিহাস ও ঐতিহ্য তুলে ধরে তিনি বলেন, বাংলা নববর্ষে ব্যবসায়ীদের ‘হালখাতা’ রীতি এখনো এদেশের নিজস্ব সংস্কৃতির আমেজ নিয়ে উৎসবের পরিধির আরও বিস্তার ঘটিয়েছে। কৃষক সমাজ আজও অনুসরণ করছে বাংলা বর্ষপঞ্জি। এক সময় শুধু গ্রামাঞ্চলেই পয়লা বৈশাখের উৎসবে মেতে উঠত মানুষ। নানা অনুষ্ঠান, মেলা আর হালখাতা খোলার মাধ্যমে তখন করানো হতো মিষ্টিমুখ। গ্রামবাংলায় ষাঁড়ের লড়াই, গরুর লড়াই হতো। এখন উৎসবের ধরন পাল্টে গেছে। আরও বড় আকারে অনুষ্ঠান হচ্ছে। এখন আধুনিক বাঙালি তাদের বাংলা নববর্ষকে সাজিয়ে তুলছে মাতৃভূমির প্রতিটি আঙিনায় আরও বেশি উজ্জ্বলতায়। কারণ মানুষের আর্থিক সঙ্গতি বেড়েছে। গোটা বিশ্বের পুঁজিবাদী অর্থনীতির সঙ্গে আমাদের অর্থনীতি তাল মিলিয়ে চলছে। মানুষের হাতে টাকা-পয়সা এসেছে। মানুষের হাতে টাকা এলে কিন্তু দুটো বিষয় কাজ হয়; প্রথমত, উৎসব করার প্রবণতা বাড়ে। দ্বিতীয়ত, উৎসব বাণিজ্যিক রূপ পায়। এর ফলে দেশের মানুষ আগের চেয়ে বেশি উৎসবমুখর হয়েছে। বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক বলেন, বৈশাখ বাঙালির জাতিসত্তাকে নব আলোকে, নব চেতনায় এবং অসাম্প্রদায়িক মানবিকতায় উদ্বুদ্ধ করেছে। আমরা একটি নৃ-তাত্ত্বিক এবং অসাম্প্রদায়িক জাতি। আর এ জন্য বৈশাখী মেলা এবং মঙ্গল শোভাযাত্রায় গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী টেপা পুতুল, মাটির পাত্র, চিরায়ত বাংলার প্রাকৃতিক শোভার প্রতীক হিসেবে ফুল, পাখির পাশাপাশি অশুভ, অমঙ্গলের প্রতীকগুলো স্থান পায়।

পরিবর্তন অবধারিত উল্লেখ করে অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান বলেন, সময় দ্রুত পরিবর্তনশীল। পরিবর্তন ও পরিবর্ধন হবে এটি স্বাভাবিক। পুরনো থেকে নতুনের দিকে উত্তরণের যাত্রা কালের নিয়তি। তবে পরিবর্তন মানে পুরনোকে ফেলে দেওয়া নয়। পুরনো বিষয়গুলোর সঙ্গে নতুনের যুক্ত হওয়া। পরিবর্তন না হলেই বরং সমস্যা। যেমন— সংস্কৃত ভাষা সময়ের সঙ্গে তাল রেখে পরিবর্তন না হওয়ায় কঠিন ও দুর্বোধ্য হয়ে পড়েছে। তিনি বলেন, পরিবর্তন হতে হবে ইতিবাচক এবং আধুনিক। দিন দিন মানুষের আচার ব্যবহার পরিবর্তন হচ্ছে। সবই নেতিবাচক এমনটি ভাবার কোনো কারণ নেই।

তরুণ প্রজন্মের উদ্দেশে তিনি বলেন, আমাদের বিশাল জনগোষ্ঠী নতুন প্রজন্ম। তাদের অনেকেই সংস্কৃতির ধারক ও বাহক হিসেবে নিজেদের তৈরি করছে। এটি ইতিবাচক। এদের বেশিরভাগই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লালন করে এবং গণতান্ত্রিকমনা। তারা প্রতিবাদ করতে জানে। আমি খুব আশাবাদী তাদের বিষয়ে। শামসুজ্জামান খান বলেন, নতুন বছর মানেই এক নতুন সম্ভাবনা, নতুন আশায় পথ চলা। বুকভরা তেমনি প্রত্যাশা নিয়ে নতুন উদ্যমে ও চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে জাতি নতুন বছর আরও সোচ্চার হবে সাম্প্রদায়িক অপশক্তি মৌলবাদ ও জঙ্গি নিধনের দাবিতে। নববর্ষ বাঙালি চেতনাকে সমৃদ্ধ করবে। ধর্ম, বর্ণ ও জাতি ভুলে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করবে এটাই প্রত্যাশা। সবাইকে শুভ নববর্ষ।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর