শনিবার, ৯ জুন, ২০১৮ ০০:০০ টা

নির্বাচনে অর্থদাতাদের সুবিধা দিয়েছে

বাজেট নিয়ে সিপিডির সংবাদ সম্মেলন

নিজস্ব প্রতিবেদক

নির্বাচনে অর্থদাতাদের সুবিধা দিয়েছে

যারা নির্বাচনে অর্থায়ন করেছেন, প্রস্তাবিত বাজেটে তাদের সুবিধা দেওয়া হয়েছে বলে মনে করে সিপিডি। সংস্থাটি বলেছে, ভোটের মাঠে যারা গুরুত্বপূর্ণ, যারা অর্থ দেয় এবং ভোট দেয়, তাদের প্রতি মনোযোগ দেওয়া হয়েছে। আর বিকাশমান মধ্যবিত্ত উপেক্ষিত রয়ে গেছে। নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তের ওপর করের চাপ বাড়বে। সিপিডির মূল্যায়নে দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপর যে চিড় ধরছে, সে চিড়টা বড় হওয়ার আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে এই বাজেটে। এটা ভালো-মন্দের ধারাবাহিকতা স্থিতাবস্থার বাজেট। আসলে নবীন বাংলাদেশের জন্য প্রবীণ বাজেট তৈরি করা হয়েছে। আগামী ২০১৮-১৯ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট পর্যালোচনা করে ও সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এসব কথা বলেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ-সিপিডির বিশেষ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি মূল বক্তব্য তুলে ধরে বলেন, আমরা বার বার বলেছি যে, বিড়াল বড় হতে পারে, বিড়াল ছোট হতে পারে কিন্তু তাকে ইঁদুর ধরতে হবে। অর্থাৎ প্রবৃদ্ধির হার উঁচুু হতে পারে, প্রবৃদ্ধির হার নিচু হতে পারে, কিন্তু প্রবৃদ্ধিতে গরিব মানুষের দারিদ্র্য বিমোচন হতে হবে, তাদের বেশি পেতে হবে। কিন্তু আমরা দেখেছি, বাংলাদেশে পূর্ব-পশ্চিম ভাগ তৈরি হয়েছে। একদিকে সিলেট, চট্টগ্রাম, ঢাকা। অপর দিকে বরিশাল, খুলনা, রাজশাহী। একদিকে উন্নততর বাংলাদেশ, আরেক দিকে দরিদ্রতর বাংলাদেশ। আমরা দেখছি, সম্পদ, ভোগ এসব ক্ষেত্রে বৈষম্য বেড়েছে। গতকাল রাজধানীর লেকশোর হোটেলে আয়োজিত মিডিয়া ব্রিফিংয়ে সিপিডির বাজেট পর্যালোচনার মূল বক্তব্য তুলে ধরেন ড. দেবপ্রিয় ভট্টচার্য। এতে আরও বক্তব্য দেন, সিপিডির আরেক বিশেষ ফেলো অধ্যাপক ড. মুস্তাফিজুর রহমান, নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন, গবেষণা পরিচালক ড. খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম ও জ্যেষ্ঠ গবেষক তৌফিকুল ইসলাম খান।

ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, যারা সবচেয়ে গরিব, গত পাঁচ বছরে তাদের ৬০ শতাংশ আয় কমেছে। অন্যদিকে সবচেয়ে ধনী পাঁচ শতাংশ মানুষের ৫৭ দশমিক ৪ শতাংশ আয় বেড়েছে। এখানে যার পুঁজি আছে, তারা আয় করার বেশি সুযোগ পাচ্ছে- যার শ্রম ও উদ্যোগ আছে তার তুলনায়। শ্রম ও উদ্যোগের তুলনায় পুঁজি এবং সম্পদকে বেশি পুরস্কৃত করছেন। এটা মেধাভিত্তিক অর্থনীতির জন্য ভালো খবর বলে মনে হচ্ছে না। প্রবৃদ্ধি, বিনিয়োগ, রেমিট্যান্স, রপ্তানি আয়, মুদ্রাস্ফীতি ও সামাজিক সুরক্ষার জায়গাগুলো দেশের অর্থনীতির শক্তিশালী দিক। বাজেটের লক্ষ্য নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে সিপিডি বলেছে, ৭ দশমিক ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধির জন্য বাজেটে বিনিয়োগের যে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে তা পূরণ করতে হলে ১১৭ হাজার কোটি টাকা বাড়তি লাগবে, যা ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ করতে হবে। আর তাতে করে পুঁজির উৎপাদনশীলতা কমে যাবে। ধরা হয়েছে যে, মূল্যস্ফীতির হার ৫ দশমিক ৬ শতাংশ থাকবে। আমরা অবশ্যই এটার ব্যাপারে গভীর সংশয় প্রকাশ করছি। কারণ, বিশ্ব অর্থনীতির যে পরিস্থিতি এবং দেশের ভেতরে যে প্রবণতা  সেটা এটাই বলছে। প্রবৃদ্ধির অঙ্কের বদলে সেই প্রবৃদ্ধি মানুষের জীবন মানে কতটা পরিবর্তন আনতে পারছে সেদিকে নজর বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছেন তিনি। পাশাপাশি রাজস্ব আদায় ও এডিপি বাস্তবায়নে দুর্বলতা, কৃষকের প্রণোদনামূলক দাম না পাওয়া, বৈদেশিক আয়-ব্যয়ের চাপ ও খাদ্য মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধিকে সমস্যা হিসেবে দেখছে সিপিডি।  সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, হঠাৎ করে কোনো মূল্যায়ন ছাড়া করপোরেট করহার কমানো উচিত হয়নি। বৃহৎ করদাতা ইউনিট খাতে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। এটাই তো করের ভেতর গরিব ও বড়লোকের বৈষম্যটা পরিষ্কার হয়ে যায়। করপোরেট কর কমানোর ফলে বিনিয়োগ বাড়বে, এই যুক্তি আমরা গ্রহণ করি না। বিনিয়োগকারীরা এখন দুর্নীতি, আমলাতন্ত্র, অবকাঠামো, সুদের হার, বিভিন্ন ধরনের প্রশাসনিক সমস্যা ও অনিশ্চয়তার কথা বলছেন, সেখানে করপোরেট করের কথা নেই। তাই করপোরেট কর আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নেওয়ার কথা বলছি। কারণ, ব্যাংক খাতে যে ধরনের নৈরাজ্য চলছে, সেটা সমাধান না করে এ ধরনের সুবিধা দেওয়ার আগে যেভাবে পরিচালক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, সেটাকে ধরে রাখা হয়েছে। এর ফলে তারল্য বাড়বে না বলেই আমাদের সন্দেহ। সব ব্যক্তি শ্রেণির করদাতাদের করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানো উচিত বলেও মত এই জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদের।

তার মতে, দেশে ঘনায়নমান যেসব সংকট, যে সমস্ত প্রাতিষ্ঠানিক সংকট আমরা দেখতে পাচ্ছি, সে সম্পর্কে বাজেটে কোনো সংবেদনশীলতা নেই। আগামী দিনে এই চাপগুলো বাড়বে। অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপর যে চিড় ধরছে, সে চিড়টা বড় হওয়ার আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে এই বাজেটে। কর্মসংস্থানের একটি পূর্ণাঙ্গ পরিকল্পনা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি ছিল এই সরকারের ২০০৮ সালের নির্বাচনে। সেটা আমরা পাইনি। অর্থ ও প্রকল্পনির্ভর উন্নয়ন থেকে বেরিয়ে যাওয়া উচিত। কর্মসংস্থানমুখী উন্নয়ন ও বাজেট পরিকল্পনা করা উচিত ছিল, সেটা আমরা দেখিনি। তিনি বলেন, একজন কর ন্যায়পাল দেওয়ার কথা থাকলেও সেটা হয়নি। জবাবদিহিতার ক্ষেত্রেও কোনো অগ্রগতি হয়নি। সংসদেও জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা দুর্বল।

তার মতে, বাজেট বাস্তবায়নে এখন একটা পরিকল্পনা দরকার। টাকা খরচ করলেই বাজেট বাস্তবায়ন হয়েছে, এই চিন্তা থেকে বেরিয়ে আসা উচিত। সুবিধাভোগীরা ফল পেল কিনা, সেটা দেখতে হবে। টাকা খরচের লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে কিনা, সেটা দেখতে হবে। আমরা চাই, আবাসনখাতে আগে ১১শ বর্গফুটের ফ্ল্যাটে যে নিবন্ধন ফি ছিল, সেখানে ফিরিয়ে নেওয়া হোক। করমুক্ত আয়সীমা তিন লাখ টাকা নির্ধারণের দাবি করছি। সিগারেটের ওপর রপ্তানিকর তুলে দেওয়া হোক। যদিও এগুলো খুচরা বিষয়।

প্রস্তাবিত বাজেট পর্যালোচনা করতে গিয়ে মূল বক্তব্যে সিপিডি বলেছে, দেশের অর্থনীতির সামনে যে চ্যালেঞ্জগুলো আসছে, তা মোকাবিলায় বক্তব্য ও কার্যকর পদক্ষেপ বাজেটে নেই। বরং রাজস্ব আদায়, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) বাস্তবায়ন, মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) অনুপাতে বিনিয়োগ বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা অর্জন নিয়ে সংশয় আছে। আর বাজেটে যে বাড়তি খরচের লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে, তার বড় অংশ যাবে জনপ্রশাসন ও সুদ খাতে। রাজস্ব আয়ের হার বিশ্বে সর্বনিম্নে বাংলাদেশ উল্লেখ করে সিপিডি বলেছে, করপোরেট কর কমানোর সিদ্ধান্ত উল্টো সিগন্যাল দেবে। রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন না করা গেলে, নির্বাচন সামনে রেখে যে ব্যয় করা হবে, তাও হবে না। প্রস্তাবিত বাজেটের ভালো দিকগুলো তুলে ধরে সিপিডি আরও বলেছে, ধনীদের সম্পদের ওপর সারচার্জ বাড়ানো, স্থানীয় শিল্পের প্রসারে নীতি সহায়তা, প্রতিবন্ধীবান্ধব হাসপাতালের সুবিধা, গরিবের রুটি-বিস্কুট ও পাদুকার ওপর মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) তুলে নেওয়া ইত্যাদি ইতিবাচক পদক্ষেপ।

সর্বশেষ খবর