সোমবার, ১৬ জুলাই, ২০১৮ ০০:০০ টা

বিশ্ব জয় করল ফ্রান্স

ফ্রান্স ৪ : ২ ক্রোয়েশিয়া

বিশ্ব জয় করল ফ্রান্স

মিউজিকের তালে তালে দলটা নাচছে। হঠাৎ তাদের মনে হলো, খালি হাতে নাচাটা ঠিক মানাচ্ছে না। দর্শকরা জাতীয় পতাকা ধার দিল পগবাদের। সেই পতাকা নিয়ে লুঝনিকির সবুজ জমিনে ঘুরে বেড়াল তারা। কেউ কেউ নাচল মনের আনন্দে। এ নাচের কোনো নাম নেই। এ নাচের কোনো ছন্দ নেই। যে যেভাবে পারছে, নাচছে। অনেকটা সময় পর দলটাকে গুছিয়ে নিয়ে এলেন অধিনায়ক লরিস। কেউ তখন লুঙ্গির মতো জড়িয়েছে জাতীয় পতাকা। কেউ গায়ে জড়িয়েছে। এই দলটা বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। এক মাসের দীর্ঘ আর ভয়ঙ্কর যাত্রা শেষ করে পর্বতের সর্বোচ্চ চূড়াটা দখল করে নিয়েছে ফ্রান্স। পেছনে ফেলে এসেছে অনেক সাবেক চ্যাম্পিয়নকে। হারিয়েছে ভয়ানক সব প্রতিপক্ষকে। সারাটা দিন রোদ ছড়িয়ে সূর্য মামা গা-ঢাকা দিয়েছে মেঘের আড়ালে। টিপ টিপ বৃষ্টি ঝরল কয়েক ফোঁটা। তখনো কেউ ভাবেনি, লুঝনিকি স্টেডিয়ামের সবুজ মাঠে বিশ্বকাপ ফাইনালে গোল বৃষ্টিও হবে! ঝিরঝিরে বৃষ্টি থেমে গেল। মেঘেদের দল হারিয়ে গেল দূর আকাশে। শেষ বিকালের আলোয় ফাইনালের দর্শকরা দেখল গোলবৃষ্টি। ফ্রান্স করল ৪টা। ক্রোয়েশিয়া ২টা। ৬ গোলের ফাইনাল দেখে তৃপ্ত দর্শকরা খুব আয়েশ করে মাঠ ছাড়ল। ১৯৬৬’র (ইংল্যান্ড ৪-২ জার্মানি) পর আর কোনো ফাইনালে এতগুলো গোল হতে দেখেনি ফুটবল দর্শকরা।

১৯৭০’র (ব্রাজিল ৪) পর কোনো দলকে ফাইনালে চার গোল করতেও দেখেনি। ফাইনালে উঠলেই ডিফেন্সিভ খেলে সফল হতে হবে, এই ধারণাটা পুরোপুরিই ভেঙে দিল ফ্রান্স-ক্রোয়েশিয়া। ৪-২ গোলের জয়ে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করল ফ্রান্স। তবে দারুণ ফুটবল খেলে দর্শকদের মন জয় করেছে ক্রোয়েশিয়াও। এ কারণেই ফাইনালে পরাজয়ের পরও ক্রোয়েশিয়ার সমর্থকরা অভিনন্দিত করেছে স্বদেশি ফুটবলারদের। এ কারণেই ক্রোয়েশিয়ার প্রেসিডেন্ট কলিন্ডাকে অভিনন্দিত করেছেন ফ্রান্সের ম্যাকরন। দুজন হাত ধরাধরি করেই পুরস্কার বিতরণী মঞ্চে এসেছিলেন ফিফা সভাপতি জিয়ানি ইনফ্যান্টিনো এবং রাশিয়ান প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে। ১৭ বছর ২৪৯ দিন বয়সে ফাইনালে (১৯৫৮) গোল করে রেকর্ডবুকে নাম তুলেছিলেন ব্রাজিলিয়ান কিংবদন্তি পেলে। এরপর ৬০টা বছর পেরিয়ে গেল। তার কাছাকাছিও কেউ পৌঁছতে পারেনি। অবশেষে পেলের খুব কাছে পৌঁছলেন ফ্রান্সের কিলিয়ান এমবাপ্পে। উনিশ বছর ছয় মাস পঁচিশ দিন বয়সে বিশ্বকাপ ফাইনালে গোল করলেন তিনি। কিন্তু এমবাপ্পের গোলটার আগেই তো ফাইনাল জয় নিশ্চিত করে নিয়েছিল ফ্রান্স। ম্যাচের ১৭তম মিনিটেই এগিয়ে যায় ফ্রান্স। ডি-বক্সের অনেকটা বাইরে ডান পাশে গ্রিজমানকে ফাউল করলে ফ্রি কিক দেন রেফারি। গ্রিজমানের বাতাসে ভাসানো ফ্রি কিক বিপদমুক্ত করতে গিয়ে হেডারে আত্মঘাতী গোল করে বসেন সেমিফাইনালে ক্রোয়েশিয়ার জয়ের নায়ক মারিও মানজুকিচ। পুরো ক্রোয়েশিয়া শিবির স্তব্ধ হয়ে যায়। তবে সমতায় ফিরতে খুব বেশি সময় নেয়নি ক্রোয়াটরা। ২৮তম মিনিটে মডরিচের ফ্রি কিক থেকে বল ক্রোয়েশিয়ার ফুটবলারদের এ-পা ও-পা ঘুরে ভিডার কাছে আসে। তার মাইনাসে বল পেয়ে পেরিশিচের দারুণ এক গোলে সমতায় ফিরে ক্রোয়েশিয়া। এর কিছুক্ষণ আগে ক্রোয়েশিয়ার সমর্থকরা সমস্বরে চিৎকার করে জানান দিয়েছিল, আমরা এবার ট্রফিটা কিন্তু চাই। তাদের সমস্বরে মিনতি করার ফলই যেন পেরিশিচের গোলটা! কিন্তু লুঝনিকি স্টেডিয়ামের বিধিলিপিটা কে বদলাবে? ম্যাচের ৩৮তম মিনিটে গ্রিজমান পেনাল্টি থেকে গোল করলে ক্রোয়েশিয়ার নৈতিক পরাজয়টা হয়ে যায়। কর্নার কিক ক্লিয়ার করার সময় হ্যান্ডবল করেন ক্রোয়েশিয়ার পেরিশিচ। ফ্রান্সের জোরালো আবেদনের ভিত্তিতে ভিএআরের সাহায্য নিয়ে পেনাল্টির সিদ্ধান্ত দেন আর্জেন্টাইন রেফারি নেস্তর পিতানা। একটা আত্মঘাতী গোল আর একটা পেনাল্টির পর কোনো দলেরই মনোবল ঠিক থাকতে পারে না। ফাইনালের মতো মঞ্চে তো নয়ই। তারপরও ক্রোয়েশিয়া আক্রমণের ধার কমায়নি। এরই মধ্যে আরও একটা গোল হজম করে ইউরোপিয়ান ফুটবলের নতুন পাওয়ার হাউস ক্রোয়েশিয়া। ম্যাচের ৫৯তম মিনিটে পল পগবার গোলে ৩-১ ব্যবধানে এগিয়ে যায় ফ্রান্স। এমবাপ্পের গতির সঙ্গে তাল মেলাতে পারেনি ক্রোয়েশিয়ার ডিফেন্ডাররা। কয়েকজনের পা হয়ে বল পেয়ে যান পগবা। সুবাচিচ বলের দিক নির্ণয় করতে করতেই পগবার শট গিয়ে ক্রোয়েশিয়ার জালে ঠেকে। এমবাপ্পে, পেলের পর দ্বিতীয় তরুণ হিসেবে বিশ্বকাপ ফাইনালে গোল করার গৌরব অর্জন করেন তিনি। ম্যাচের ৬৫তম মিনিটে লুকাস হার্নান্দেজের পাস থেকে বল পেয়ে ডি বক্সের অনেকটা বাইরে থেকে গোল করেন এমবাপ্পে। ৪-১ ব্যবধানে এগিয়ে যাওয়ার পর শিরোপা নিয়ে বাড়ি ফেরার ব্যাপারে আর কোনো সন্দেহ রইল না ফ্রান্সের। ৬৯তম মিনিটে হুগো লরিসের ভুলে ব্যাক পাসে বল পেয়ে ক্লিয়ার করতে গিয়ে মারিও মানজুকিচ বল পেয়ে যান। গোল করেন তিনি ডান পায়ের আলতো ছোঁয়ায় (৪-২)। কিন্তু ততক্ষণে ফ্রান্স অনেকদূর এগিয়ে গেছে। ফাইনাল জিতে আনন্দে মেতে উঠতে তাদের কেবল শেষ বাঁশিটার অপেক্ষা ছিল। উরুগুয়ে ও আর্জেন্টিনার পর তৃতীয় দল হিসেবে দুটি করে বিশ্বকাপ জয়ের গৌরব এখন ফরাসিদেরও। ম্যাচের ৫২তম মিনিটে হঠাৎ করেই গ্যালারির ব্যারিয়ার টপকে মাঠে প্রবেশ করেন তিন পাগল ফুটবলপ্রেমী। দুজন মেয়ে ও একজন ছেলে। প্রিয় তারকাদের সঙ্গে হাত মেলাতে নিরাপত্তা প্রহরীদের পেছনে ফেলে ছুটে যান তারা। ফুটবলারদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে বসে পড়েন মাঠেই। তাদেরকে ভলান্টিয়ার ও নিরাপত্তারক্ষীরা টেনে-হিঁচড়ে মাঠের বাইরে নিয়ে আসেন। অবশ্য সারা জীবন মনে রাখার মতো একটা গল্প পেয়ে গেলেন তারা।

 ক্রোয়েশিয়ার সঙ্গে কাঁদল আকাশও! না হলে ওরা রানার্সআপের মেডেল নিয়ে মঞ্চ ছাড়তেই কেন অঝোর ধারায় বৃষ্টি নামল লুঝনিকিতে! ক্রোয়েশিয়ার সঙ্গে আকাশ কাঁদলেও ফরাসিরা ততক্ষণে অনেকটা উন্মাদের মতোই উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে লাগল। বিশ্বকাপ জয়ের আনন্দ উন্মাদ না হয়ে প্রকাশ করা যায় নাকি! ফরাসিদের এই উৎসবের মধ্যেই ফুল ভলিউমে স্টেডিয়ামে বাজছিল, ‘ফিল দ্য ম্যাজিক ইন দ্য ইয়ার’ গানটি। সত্যিই ফাইনালের বাতাসে ম্যাজিক ছিল। না হলে ওরকম গোল বন্যার একটা ফাইনাল দেখার সৌভাগ্য হয় নাকি!

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর