শুক্রবার, ৩ আগস্ট, ২০১৮ ০০:০০ টা

তীব্র ছাত্র বিক্ষোভ সারা দেশে

সায়েন্স ল্যাব মোড়ে পুলিশের গাড়িতে আগুন, মিরপুরে সংঘর্ষ, পথে পথে অবস্থান

বিশেষ প্রতিনিধি

তীব্র ছাত্র বিক্ষোভ সারা দেশে

শাহবাগে গতকাল সড়কে শিক্ষার্থী। ধানমন্ডিতে মোটরসাইকেলে আগুন। মিরপুরে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ —বাংলাদেশ প্রতিদিন

নিরাপদ সড়কের দাবিতে চলমান তীব্র ছাত্রবিক্ষোভ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। ছাত্রবিক্ষোভের মুখে দেশের যোগাযোগব্যবস্থা কার্যত অচল হয়ে পড়ে। শিক্ষার্থীদের বাধার মুখে গতকাল সকাল ১০টার পর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত রাজধানীর প্রধান সড়কগুলোয় যান চলাচল বন্ধ থাকে। শিক্ষার্থীরা প্রধান সড়কগুলোয় অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ ও মিছিল করেছে। তাদের বাধার মুখে অধিকাংশ সড়কে যাত্রীবাহী যানবাহন চলাচল করেনি। রাজধানীর সঙ্গে অধিকাংশ জেলার সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা রাজধানীর রাজপথে অবস্থান নিয়ে ব্যক্তিগত গাড়ির চালকদের ড্রাইভিং লাইসেন্স পরীক্ষা ও ট্রাফিক ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করে। একই অবস্থা বিভিন্ন জেলা ও বিভাগীয় শহরগুলোযও। ছাত্রবিক্ষোভের মুখে প্রায় অচল হয়ে পড়ে ঢাকার যোগাযোগব্যবস্থা। শিক্ষার্থী আন্দোলনের পঞ্চম দিনের মাথায় এসে আন্দোলনকারীদের ভিড়ে অছাত্র ও স্বার্থান্বের্ষী মহল ঢুকে পড়ার অভিযোগ উঠেছে। ড্রাইভিং লাইসেন্স পরীক্ষার নামে ছাত্র নয় এমন অসংখ্য যুবক রাস্তায় নেমে ব্যক্তিগত গাড়ির চালকদের হয়রানি করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এদিকে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন দাবির প্রতি সব মহল সহানুভূতি জানিয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, শিক্ষার্থী হত্যার ঘটনায় মামলা দায়ের, আসামি গ্রেফতার, দ্রুত বিচারের ব্যবস্থাসহ সব ধরনের আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের প্রতি সরকারও সহানুভূতিশীল। পুলিশ তাদের আন্দোলনে শুরু থেকেই কোনো বাধা দেয়নি। নিহত দুই শিক্ষার্থীর পরিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে গণভবনে দেখা করতে গিয়ে দোষীদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তি প্রদানে সরকারপ্রধানের আশ্বাস পেয়ে আন্দোলন প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়েছে। অন্যদিকে টানা পাঁচ দিনের বিক্ষোভের মাথায় গতকাল রাজধানীতে বিচ্ছিন্ন কিছু সহিংস ঘটনা ঘটেছে। ধানমন্ডির সায়েন্সল্যাব এলাকায় ড্রাইভিং লাইসেন্স চেক করার জের ধরে তর্কাতর্কির এক পর্যায়ে শিক্ষার্থীরা এক ট্রাফিক সার্জেন্টের ওপর হামলা করেছে। তাকে মারধরের পর তার সরকারি মোটরসাইকেলও পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। মিরপুর ও বাংলামোটরে ধাওয়ার শিকার হয়েছে শিক্ষার্থীরা। দুর্ঘটনার পর থেকেই জাবালে নূর পরিবহনের দুটি বাসের দুই চালক ও একজন হেলপারকে গ্রেফতার করে আইনের আওতায় এনেছে পুলিশ। পরিবহনটির মালিক শাহাদাত হেসেনকেও গ্রেফতার করে সাত দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। এদিকে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে স্বার্থান্বেষী মহলের অনুপ্রবেশ ঘটেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। সন্ধ্যায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছাত্রদের ঘরে ফিরে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। র‌্যাব মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ এক ব্রিফিং করে নিরাপত্তার স্বার্থে রাস্তা থেকে শিক্ষার্থীদের সরিয়ে নিতে অভিভাবক, স্কুল-কলেজের শিক্ষক ও ম্যানেজিং কমিটির কাছে অনুরোধ জানিয়েছেন। সব দাবি মেনে নেওয়ার প্রেক্ষাপটে শিক্ষার্থীদের রাস্তা ছেড়ে ঘরে ফিরে যাওয়ার তাগিদ দিয়েছে বিভিন্ন মহল।

সায়েন্সল্যাবে পুলিশের ওপর হামলা : সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড়ে এক ট্রাফিক সার্জেন্টের ওপর হামলা চালিয়ে তার মোটরসাইকেল পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। বেলা আড়াইটার দিকে সেখানে দায়িত্বরত ট্রাফিক সার্জেন্ট বায়েজিদের মোটরবাইকের লাইসেন্স দেখতে চায় শিক্ষার্থীরা। এ সময় তিনি লাইসেন্স না দেখিয়ে বরং ছাত্রদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন বলে অভিযোগ করেন ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটির একজন ছাত্র। ছাত্ররা বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠলে তিনি মোটরবাইক ফেলে দৌড় দেন। পরে তাকে ঘিরে ফেলে পিটুনি দেওয়া হয়। আহত ট্রাফিক সার্জেন্ট বায়েজিদকে পরে সায়েন্সল্যাব মোড়ের পুলিশ বক্সে নিয়ে যাওয়া হয়। এদিকে বিক্ষোভকারীরা তার মোটরসাইকেলটি জ্বালিয়ে দেয়।

‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ : ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ স্লোগানে নিরাপদ সড়কসহ সাত দফা দাবিতে রাস্তায় বিক্ষোভ করে শিক্ষার্থীরা। সকাল থেকে তারা রিকশা ও বাইসাইকেল ছাড়া সব ধরনের যানবাহনের বৈধ কাগজপত্র ও ড্রাইভিং লাইসেন্স পরীক্ষা করে। দু-একটি ব্যক্তিগত গাড়ি চললেও বন্ধ ছিল গণপরিবহন। এ সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে। কোথাও তাদের ওপর হামলারও ঘটনা ঘটে। উত্তাল এ পরিস্থিতিতে ভোগান্তি আর দুর্ভোগের নাভিশ্বাস ওঠে সাধারণ মানুষের। তারা হেঁটে নিজ নিজ গন্তব্যে পৌঁছায়।

সকাল থেকেই রাজধানীর মহাখালী, কাকলী, শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের সামনে, কুড়িল বিশ্বরোড, গুলশান-২ গোলচত্বর, জিল্লুর রহমান ফ্লাইওভার, নতুনবাজার মোড় ও নর্দ্দা, উত্তরায় বিক্ষিপ্তভাবে অবস্থান নেয় ছাত্রছাত্রীরা। ওই এলাকা দিয়ে চলাচল করা প্রতিটি গাড়ির কাগজপত্র পরীক্ষা করে দেখে তারা। বাদ পড়েনি আইনশৃঙ্খলা, নিরাপত্তা ও সরকারি বিভিন্ন দফতরের গাড়িও। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা উপেক্ষা করে বেলা ১১টা থেকে মহাখালী মোড়ে জড়ো হন ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ, বি এ এফ শাহীন কলেজ ও আদমজী কলেজের ছাত্রছাত্রীরা। এ সময় প্রত্যেকে নিরাপদ সড়কের দাবিতে প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে রাস্তায় বসে পড়েন। তারা বনানী ও গুলশানের দিক থেকে আসা গাড়ির লাইসেন্স পরীক্ষা করতে থাকেন। যাদের কাগজপত্র ঠিক ছিল না তাদের গাড়ির চাবি নিয়ে নেন এবং গাড়ি রাস্তার এক পাশে থামিয়ে রাখেন দিনভর। এর প্রায় আধা ঘণ্টা পর কাকলী থেকে কিংস কলেজ, সরকারি তিতুমীর কলেজ ও ক্যামব্রিয়ান কলেজের শিক্ষার্থীদের একটি মিছিল মহাখালীতে এসে যোগ দেয়।

কাকলী মোড় : বৃষ্টি উপেক্ষা করে দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে কাকলী মোড়ে অবস্থান নেন আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, অতীশ দীপঙ্করসহ বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। মহাখালী থেকে বিমানবন্দরমুখী রাস্তাটি ক্যান্টনমেন্ট মিনি সার্ভিস নামে একটি বাস দিয়ে ব্যারিকেড দিয়ে বন্ধ করে দেন। বিমানবন্দর থেকে আসা বনানীমুখী অন্য পাশের রাস্তাটি বিআরটিসির আরেক বাস দিয়েও বন্ধ রাখা হয়। ফলে ওই সড়ক দিয়ে সব যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। পাশ দিয়ে চলা সব মোটরসাইকেলের কাপজপত্র যাচাই করতে থাকেন বিক্ষুব্ধরা। যাদের ড্রাইভিং লাইসেন্স ছিল না গাড়িসহ তাদের নিকটবর্তী ট্রাফিক পুলিশ সার্জেন্টের কাছে তুলে দেন।

শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজ : সকাল সাড়ে ১০টা থেকে এ এলাকায় অবস্থান নেন কলেজটির শিক্ষার্থীরা। এ সময় তারা রাস্তায় দাঁড়িয়ে প্রতিটি গাড়ি থামিয়ে কাগজপত্র পরীক্ষা করেন। কলেজটির সামনে বিপুলসংখ্যক পুলিশ সতর্কাবস্থায় থাকে। সিএনজিচালিত অটোরিকশা, প্রাইভেট কার, মাইক্রোবাস, মোটরসাইকেল ও পিকআপ ভ্যান থামিয়ে সেগুলোর কাগজপত্র দেখতে চাওয়া হয়। যাদের কাগজপত্র ছিল না তাদের পাশের ট্রাফিক পুলিশ বক্সে হস্তান্তর করা হয়। শিক্ষার্থীদের কেউ কেউ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে লাইভ করে সম্প্রচার করেন তাদের কার্যক্রম। শিক্ষার্থীরা জানান, পুলিশের অন্তত ১৭০টি গাড়ি তারা থামিয়েছিলেন; যার একটিরও ড্রাইভিং লাইসেন্স ছিল না।

উত্তরায় তারকারা : সকাল পৌনে ১০টা থেকে উত্তরা হাউস বিল্ডিং এলাকায় সড়কে অবস্থান নেন শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের সড়ক অবরোধের ফলে উত্তরায় ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে যান চলাচল থেমে যায়। সে সময় সেখানে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে ‘সন্তান আমার ঘরে ফিরবে তো?’ স্লোগানসংবলিত প্ল্যাকার্ড হাতে যোগ দেন বেশ কয়েকজন অভিভাবকও। বেলা পৌনে ১২টার দিকে শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়কের দাবি নিয়ে চলমান আন্দোলনে একাত্মতা প্রকাশ করেন বিনোদনজগতের তারকারা। উত্তরায় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের পদযাত্রায় তারকা, শিল্পী, কলাকুশলীরা অংশ নেন।

গুলশান-২ মোড়ে অবরোধ : গুলশান-২ মোড়ে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করেন শাহাবুদ্দিন মেডিকেল কলেজ, মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, ক্যামব্রিয়ান ও কিংস কলেজের শিক্ষার্থীরা। এ সময় তাদের আন্দোলনে সংহতি জানান বেশ কয়েকজন শিক্ষক। ফলে ওই এলাকা দিয়ে সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এতে নতুন বাজার থেকে গুলশান পর্যন্ত সড়কটিতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে থাকে শতাধিক গাড়ি। ঢাকায় অবস্থিত বিভিন্ন রাষ্ট্রের দূতাবাসের প্রতিনিধিরা হেঁটে নিজ নিজ গন্তব্যে পৌঁছান এবং পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় আন্দোলনের চিত্র ধারণ করেন নিজ নিজ মোবাইল ফোনে।

নতুন বাজার ও নর্দ্দা : নতুন বাজার এলাকায় সিমেন্ট কোম্পানির রেডিমিক্সের দুটি গাড়ি দিয়ে রাস্তায় ব্যারিকেড দেন গুলশান কমার্স কলেজ, সাকিব প্রিপারেটরি স্কুল, গ্রিন লাইভ স্কুলের শিক্ষার্থীরা। নতুন বাজার থেকে নর্দ্দা পর্যন্ত সড়কের মাঝখানে সুপ্রভাত পরিবহনের একটি বাস ভাঙচুর করে তা দিয়ে রাস্তায় ব্যারিকেড দেন এবং বিপরীত পাশের সড়কেও বিআরটিসির ডাবল ডেকারের দুটি বাস রেখেও ব্যারিকেড দেওয়া হয়। বিক্ষিপ্তভাবে নর্দ্দা থেকে কুড়িল বিশ্বরোড পর্যন্ত অবস্থান নেন বনানী বিদ্যানিকেতন, নর্থ সাউথ ও ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা। বিকালে নর্দ্দা দিয়ে মোটরসাইকেল নিয়ে শহিদুল নামে এক পুলিশ কনস্টেবল যেতে চাইলে তার পথরোধ করেন আন্দোলনরতরা। এ সময় তার কাগজপত্র দেখতে চাইলে তিনি তা দেখাতে ব্যর্থ হলে ‘ভুয়া, ভুয়া’ স্লোগানে সরব হয়ে ওঠে এলাকাটি। পরে তাকে পুলিশ বক্সে নিয়ে যাওয়া হয়।

দিনভর রামপুরায় : রামপুরা ব্রিজের ওপর ১০-১২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা সকাল থেকেই জড়ো হয়ে স্লোগান দিতে থাকেন। তারা যান চলাচল বন্ধ করে দেন। রামপুরা ব্রিজের দুই পাশে আড়াআড়িভাবে দুটি পিকআপ রেখে দেন শিক্ষার্থীরা। এ সময় উত্তরাগামী সব যান বন্ধ হয়ে যায়। বেলা ১১টায় মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হলে বৃষ্টিতে ভিজেই তারা মুহুর্মুহু স্লোগান দিতে থাকেন। ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি, সিটি কলেজ, তেজগাঁও কলেজ, সরকারি বিজ্ঞান কলেজ, ক্যামব্রিয়ান কলেজ, মতিঝিল আইডিয়াল কলেজ, ন্যাশনাল আইডিয়াল কলেজ, ঢাকা ইমপেরিয়াল কলেজ, রাজউক কলেজ, রামপুরা একরামুন্নেসা ডিগ্রি কলেজ, খিলগাঁও সরকারি উচ্চবিদ্যালয়সহ নানা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীরা আন্দোলনে অংশ নেন। বিকাল ৪টা পর্যন্ত লাইসেন্স থাকলেও কোনো মোটরসাইকেলও চলতে দেননি আন্দোলনকারীরা।

মিরপুরে বিক্ষোভ : আন্দোলনরত শত শত শিক্ষার্থী মিরপুর-১০ নম্বর গোলচত্বর অবরোধ করেন। বেলা ১১টা থেকে মিরপুর-১০ নম্বরে জড়ো হতে থাকেন শিক্ষার্থীরা। দল বেঁধে রাস্তার ঠিক মাঝখানে অবস্থান নেন মিরপুর ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ, আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজ, মিরপুর কলেজ, জার্মান টেকনিক্যালসহ আশপাশের স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা। আন্দোলনে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে ব্যস্ততম মিরপুর-১০ নম্বরসহ আশপাশ এলাকা। মিরপুর-১, ১২ ও ১৪ নম্বর, শেওড়াপাড়ার দিক থেকে আসা সব ধরনের যানবাহন, প্রাইভেট কার, সিএনজি, পিকআপ আটকিয়ে দেন তারা। কোনো গাড়ির চালকের লাইসেন্স না থাকলে চাবি নিয়ে তা পুলিশের কাছে দিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিছু গাড়িতে কালি দিয়ে ‘লাইসেন্স নেই’ লিখে দেওয়া হয়েছে। শিক্ষার্থী বলছেন, সব শিক্ষার্থী এক হয়ে দাবি আদায়ে রাজপথে নেমেছেন। আমাদের দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলনে থাকবই। পান্থপথে চার রাস্তার মোড় অবরোধ করেন কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী। ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি, ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, সিটি ইউনিভার্সিটি, সোনারগাঁও ইউনিভার্সিটি, এশিয়া প্যাসিফিক ইউনিভার্সিটি, নাজনীন স্কুল অ্যান্ড কলেজ, মোহাম্মদপুর স্কুল, হামদর্দ কলেজের শিক্ষার্থীরা সড়ক অবরোধ করে নিরাপদ সড়কের দাবিতে স্লোগান দিয়েছেন।

সংঘর্ষ, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া : শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মধ্যে মিরপুরে পুলিশের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ হয়েছে। একদল যুবককেও লাঠি হাতে শিক্ষার্থীদের ওপর চড়াও হতে দেখা যায়। গতকাল বিকাল ৪টার দিকে মিরপুর-১৩ ও ১৪ নম্বরের মধ্যে বিআরটিএ থেকে কাফরুল থানা হয়ে পাবলিক অর্ডার ম্যানেজমেন্টের গেট পর্যন্ত সড়কে এই ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। সংঘর্ষে বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। এদের কয়েকজনের মাথা ফেটে যায়।

আহত এক কলেজছাত্র বলেন, মিরপুর-১৪ নম্বর এলাকায় কর্মসূচি চলছিল। পুলিশ তাদের সরাতে গেলে শিক্ষার্থীদের মাঝ থেকে কয়েকজন ইটপাটকেল ছুড়তে শুরু করেন। তখন পুলিশ লাঠিচার্জ শুরু করে। এতে পুরো এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। শিক্ষার্থীরা ছোটাছুটি শুরু করেন। ওই এলাকায় পুলিশের সঙ্গে বেশ কিছু সময় বিক্ষোভকারীদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া চলে। এ সময় পুলিশের সঙ্গে একদল যুবককেও লাঠি হাতে শিক্ষার্থীদেও পেটাতে দেখা যায়।

ঢাকা মহানগর পুলিশের পল্লবী জোনের সহকারী কমিশনার ইয়াসমীন সাইকা পাশা গত রাতে বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের মাঝে অছাত্র দেখা গেছে সেখানে। কোনো কারণ ছাড়াই কাফরুল থানায় হামলার চেষ্টা করে। পাবলিক অর্ডার ম্যানেজমেন্ট বিভাগের প্রধান ফটক ভেঙে ফেলার চেষ্টা করে। তারা পুলিশের দিকে ইটপাটকেল ছোড়ে। পরে পুলিশ তাদের সরিয়ে দেয়। তখন তারা সরে ১০ নম্বও গোলচত্বরের দিকে যায়।’ সে সময় পুলিশের সঙ্গে লাঠি হাতে কারা ছিল— এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, প্রশ্নই ওঠে না। তবে শিক্ষার্থীদের মধ্যে অছাত্র বেশি ছিল সেখানে।

শিক্ষার্থীদের ঘরে ফেরার অনুরোধ ডিএমপির : অপপ্রচারে কান না দিয়ে শিক্ষার্থীদের ঘরে ফিরে যাওয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম। সেই সঙ্গে তিনি এ আন্দোলন বন্ধ ও আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের সরিয়ে আনার জন্য প্রত্যেক অভিভাবক ও শিক্ষকের সহযোগিতা কামনা করেছেন। দুপুরে ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে শিক্ষার্থীদের চলমান আন্দোলন নিয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ অনুরোধ করেন। মনিরুল ইসলাম বলেন, গাড়ি চেকিংয়ের কারণে দুর্ভোগ তৈরি হচ্ছে। তারা গাড়ি চেকিংয়ের নামে যা করছে তা কাম্য নয়। দুর্ভোগ হচ্ছে বিশেষ করে যারা হজযাত্রী ও রোগীদের। তাদের গাড়ি আটকানোর কারণে তারা বিপদে পড়ছেন। তাদের অনুরোধ করব, তোমরা স্ব-স্ব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিরে যাও। পর্যায়ক্রমে দাবিগুলো মেনে নেওয়া হবে। পাশাপাশি অভিভাবকদেরও অনুরোধ করব আপনারা আপনাদের সন্তানদের ঘরে নিয়ে যান। সঙ্গে শিক্ষকদেরও অনুরোধ করব তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য।

শনিরআখড়ায় এমপি অবরুদ্ধ, পুলিশ আহত : শনিরআখড়ায় রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। বেলা ১১টার দিকে হঠাৎ করেই তিন-চারটি পিকআপে করে একদল শিক্ষার্থী এসে শনিরআখড়ায় দনিয়া বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের সামনের মহাসড়ক অবরোধ করে। এর ফলে নারায়ণগঞ্জের সাইনবোর্ড থেকে মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভার পর্যন্ত গুলিস্তানমুখী পাবলিক পরিবহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। অন্যদিকে ফ্লাইওভার থেকে সাইনবোর্ডমুখী সড়কে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। দনিয়া বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, ক্যামব্রিয়ান স্কুল অ্যান্ড কলেজ, যাত্রাবাড়ী আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, ঢাকা সিটি কলেজ, সিসিআর কলেজ, গোলাম মোস্তফা মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, নবারুণ স্কুল অ্যান্ড কলেজ, ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজ, শামসুল হক খান স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থীরা এ বিক্ষোভে অংশ নেন। ঘটনাস্থলে উপস্থিত ডিএমপির ওয়ারী জোনের উপ-পুলিশ কমিশনার নুরুল আমিন বলেন, ছাত্রদের সঙ্গে অনেক বহিরাগত এখানে রয়েছে। তারা যেন কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা সৃষ্টি না করতে পারে সে বিষয়গুলো আমরা দেখছি। যারা আন্দোলন করছে তারা অনেক ছোট। তাদের নানাভাবে প্রভাবিত করার চেষ্টা হচ্ছে। উসকানি দেওয়া হচ্ছে। এদিকে শনিরআখড়ায় গাড়িচালকের ড্রাইভিং লাইসেন্স দেখাতে না পারায় স্বেচ্ছাসেবক লীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক এমপি পঙ্কজ দেবনাথকে প্রায় ১ ঘণ্টা অবরুদ্ধ করে রাখেন শিক্ষার্থীরা। নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ থেকে ঢাকায় যাওয়ার পথে গতকাল দুপুর ১টার দিকে রাজধানীর রায়েরবাগে আন্দোলনকারীদের সামনে পড়ে পঙ্কজ দেবনাথের গাড়ি। এরপর এমপির গাড়ির চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্স পরীক্ষা করেন। চালকের লাইসেন্স মেয়াদোত্তীর্ণ থাকায় শিক্ষার্থীদের অবরোধের মুখে পড়েন এই এমপি।

পুলিশের মাথা ফাটালেন ছাত্ররা : লাইসেন্স দেখাতে না পারায় রাজধানীর শনিরআখড়ায় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে সাইফুল নামে পুলিশের এক উপ-পরিদর্শকের (এসআই) মাথা ফাটিয়ে দিয়েছেন আন্দোলনকারীরা। গতকাল দুপুর ১২টার দিকে শনিরআখড়ায় ফুটওভার ব্রিজের নিচে এ ঘটনা ঘটে। এসআই সাইফুল মোটরসাইকেলযোগে রায়েরবাগ থেকে যাত্রাবাড়ী থানায় যাচ্ছিলেন বলে জানা গেছে।

 

মন্ত্রী-এমপিদের গাড়ি আটক : প্রয়োজনীয় কাগজপত্র না থাকায় সংসদ সচিবালয়ে গাড়ি নিয়ে প্রবেশ করতে পারেননি কয়েকজন এমপি-মন্ত্রী। আসাদ গেটে গাড়ি রেখে হেঁটেই সংসদে প্রবেশ করেছেন গণশিক্ষামন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান। তার ড্রাইভারের কাগজপত্র ছিল না। কাগজপত্র না থাকায় সরকারি কর্মকর্তাদের গাড়ি আটকে করা হয়েছে মামলা। শিক্ষার্থীদের বক্তব্য ছিল, আইন সবার জন্য সমান। কে মন্ত্রী, কে এমপি আর কে বড় কর্মকর্তা তা আমরা দেখতে চাই না। এই পরিস্থিতি দেখে অনেকে সংসদ থেকে বের হতে গিয়ে তাড়াতাড়ি গাড়ি ঘুরিয়ে আবার সংসদে ঢুকে পড়েছেন। এসব কারণে বাতিল করা হয়েছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠক। তবে এত কিছুর মধ্যেও যথারীতি শপথ নিয়েছেন কুড়িগ্রাম-৩ আসনের উপনির্বাচনে নির্বাচিত সংসদ সদস্য ডা. মো. আক্কাছ আলী সরকার। গতকাল সংসদ ভবনে স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী তাকে শপথবাক্য পাঠ করান। তিনি জাতীয় পার্টির প্রার্থী হিসেবে উপনির্বাচনে জয়ী হন।

সর্বশেষ খবর