বুধবার, ১৫ আগস্ট, ২০১৮ ০০:০০ টা

হত্যার আগে তৎপর সিআইএ পরে কেজিবি

বঙ্গবন্ধুকে সতর্ক করে ‘র’ ও ইন্দিরা

জুলকার নাইন

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার ষড়যন্ত্রের তথ্য পেয়েছিল ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উইং ‘র’ এবং মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা ‘সিআইএ’সহ একাধিক বিদেশি সংস্থা। অভ্যুত্থানের আশঙ্কা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুকে সতর্কও করেছিলেন ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীও। ‘র’-এর   পক্ষ থেকে ’৭৪-এর ডিসেম্বরে এবং ’৭৫-এর মার্চে সামরিক অভ্যুত্থানের বিষয়ে সতর্ক করা হয়। এ ছাড়া সুইডেনে প্রকাশিত এক রিপোর্টেও ক্যু সম্পর্কে সতর্ক করা হয়েছিল। অবশ্য মার্কিন দলিলপত্রে ’৭৪-এর মাঝামাঝি থেকে ধারাবাহিকভাবেই সম্ভাব্য ক্যু এবং তার পরবর্তী সম্ভাব্য পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা ছিল। মুজিব হত্যার পরপরই তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবির বিশাল এজেন্ট বাহিনী এদেশে সক্রিয় হয়ে ওঠে। অন্যদিকে, মুজিব হত্যার পরদিনই স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় সৌদি আরব। চীন স্বীকৃতি দিয়েছিল বঙ্গবন্ধু হত্যার সপ্তাহ দুয়েক পরে। ‘ইন্দিরা গান্ধী : এ বায়োগ্রাফি’ শীর্ষক বইয়ে ভারতীয় লেখক পুপুল জয়কর লিখেছেন, ‘বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারকে ১৫ আগস্টের প্রভাতের শুরুতে বিদ্রোহী সেনাদল কর্তৃক হত্যার সংবাদ দেয়। মুজিব, তাঁর স্ত্রী, তাঁর তিন পুত্র, তাঁর দুই পুত্রবধূ এবং তাঁর দুই ভাগ্নে নিহত হন। আমি আন্দাজ করতে পারি, এ সংবাদ ইন্দিরার ওপর কী প্রতিক্রিয়া করবে। যদিও ‘র’-এর তৎকালীন প্রধান রামেশ্বর নাথ কাও ১৯৭৪ সাল থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র সম্পর্কে তথ্য পেয়েছেন। তিনি (আর. এন. কাও) গোপন রিপোর্ট পান যে, বাংলাদেশি প্রতিরক্ষা বাহিনীর মধ্যে বিদ্রোহ পাকিয়ে তোলা হচ্ছে। এ বিষয়ের ওপর তিনি ব্যক্তিগতভাবে ইন্দিরা গান্ধীকে সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেন। পরে ইন্দিরা গান্ধী ষড়যন্ত্র সম্পর্কে মুজিবকে অবহিত করার জন্য তাকে ঢাকায় পাঠান। আর এন কাওর ভাষায়— “আমরা বাগানে পাঁয়চারি করছিলাম। আমি মুজিবকে বলি যে, তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে, আমাদের কাছে তথ্য আছে; কিন্তু তিনি (বঙ্গবন্ধু) ছিলেন প্রফুল্ল। বললেন, ‘আমার কিছুই হতে পারে না, তারা আমার লোক।’ আমরা যতটুকু জানতে পেরেছি সেই তথ্যের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ আমি তাকে দেওয়া সত্ত্বেও তিনি এমন বললেন।” ১৯৭৫ সালের মার্চ মাসে কাওয়ের কাছে আরও খবর পৌঁছে যায়। সেটা হলো, বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর মধ্যে মুজিবের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র সংগঠিত হচ্ছে। ইন্দিরা দ্রুতবেগে মুজিবকে অবহিত করেন, কিন্তু তিনি বিশ্বাস করতে অসম্মত হন; তিনি তো বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশের রাষ্ট্রপিতা, তিনি তাঁর আপন লোকজনের দ্বারা গুপ্তহত্যার শিকারে পরিণত হতে পারেন না। প্রতিবেদনগুলো ১৯৭৪ সালেও হালনাগাদ ছিল যে, বাইরের দেশের শক্তি কর্তৃক ষড়যন্ত্রের কর্মসূচি পরিকল্পিত ও পরিচালিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু হত্যার খবর পাওয়ার পর ইন্দিরা গান্ধীর প্রতিক্রিয়া নিয়ে লেখক পুপুল জয়কর লিখেছেন, ‘আমি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সন্ধ্যার সময় তাঁর (ইন্দিরা গান্ধী) বাসভবনে যাই। দেখতে পাই, তিনি নিজেও নিরাপত্তাহীনতার বিষয়ে মহাআতঙ্কিত। তিনি (ইন্দিরা) আমাকে বলেন যে, মুজিবহত্যা হচ্ছে ষড়যন্ত্রের প্রথম ঘটনা। এটাই উপমহাদেশকে ডুবিয়ে দেবে। প্রথমত, মুজিব প্রস্থান করলেন। প্রমাণ, যুক্তি ইত্যাদির সাহায্যে দৃঢ় প্রত্যয়ে ইন্দিরা বলেন, পরবর্তী লক্ষ্যবস্তু হবেন তিনি নিজেই। মুজিবের শিশু ছেলেকে হত্যার সংবাদ সব স্বচ্ছ চিন্তাভাবনা সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দেয়। ভয় ভীতিগুলো প্রকট আকার ধারণ করে। ইন্দিরা বলেন, ‘আমি গোয়েন্দা প্রতিবেদনগুলো অগ্রাহ্য করেছি, কিন্তু তেমনটি আমি আর করতে পারি না।’ রাজীবের পুত্র রাহুল মুজিবের পুত্রের সম-বয়স্ক। আগামীকাল তারও এমনটি হতে পারে। তারা আমাকে ও আমার পরিবারকে ধ্বংস করতে চায়।’ আত্মজীবনীর লেখক পুপুল জয়কর আরও লিখেছেন, ‘১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ইন্দিরার সঙ্গে মতবিনিময় করা কঠিন হয়ে পড়ে। তিনি আমার সঙ্গে যখন দেখা করেন তখনো তার দুই চোখ সবসময় সতর্ক থাকত।’

মার্কিন দলিলেও অভ্যুত্থানের আগাম তথ্য : সম্প্রতি উন্মোচন করে দেওয়া গোপনীয় মার্কিন বার্তাগুলোর বিশ্লেষণে দেখা যায়, মুজিবের সেনা মোতায়েন শিরোনামে ১৯৭৪ সালের ৩ এপ্রিল ঢাকার মার্কিন দূতাবাস থেকে ওয়াশিংটনে পাঠানো বার্তার বিষয়বস্তু ছিল বাংলাদেশের বেসামরিক যোগাযোগ, দুর্নীতি, ভিন্নমতাবলম্বী উপদল, সেনা মোতায়েন। ’৭৪-এর ২ আগস্ট ঢাকা থেকে পাঠানো আরেক সিক্রেট বার্তার শিরোনাম ছিল ‘সম্ভাব্য সরকার পরিবর্তনের বিষয়ে আরও বিস্তারিত’। ’৭৪-এর ২৯ আগস্ট ওয়াশিংটন থেকে ঢাকার পরিস্থিতি জানতে চেয়ে পাঠানো তার বার্তার শিরোনাম ছিল, ‘রাজনৈতিক পরিস্থিতি মূল্যায়নের অনুরোধ’। আবার ’৭৪-এর ৪ সেপ্টেম্বর ঢাকা থেকে ওয়াশিংটনে পাঠানো আরেকটি গোপন বার্তার শিরোনাম ‘অস্থিরতার সম্ভাবনা এবং বাংলাদেশে রাজনৈতিক পরিবর্তন।’ ‘মিসেস গান্ধী এবং সিআইএ’ শিরোনামে আরেকটি বার্তা পাঠানো হয় ১৯৭৫ সালের ২৯ জুলাইয়ে। এমন আরও বেশ কিছু তারবার্তা ইতিমধ্যেই প্রকাশিত হয়েছে। এগুলো নিয়ে ঢাকার এক স্বনামখ্যাত সাংবাদিকের বইও বেরিয়েছে। অন্যদিকে, ইউএস ওরাল হিস্টোরি প্রোগামের আওতায় চার্লস স্টুয়ার্ট কেনেডি নামের এক ইতিহাসবিদকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ১৯৭৫ সালে ওয়াশিংটনে স্টেট ডিপার্টমেন্টে বাংলাদেশ ডেস্কের কর্মকর্তা স্টিফেন আইজেন ব্রাউন দাবি করেন, সম্ভাব্য সামরিক অভ্যুত্থান সম্পর্কে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর খবরের ভিত্তিতে ঢাকার দূতাবাস থেকে শেখ মুজিবকে সতর্ক করা হয়েছিল। এ কারণে তারা অভ্যুত্থানের খবর ও অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারীদের বিষয়ে জেনে খুব একটা বিস্ময়বোধ করেননি। অবশ্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা বা বাংলাদেশে কোনো সেনা অভ্যুত্থান বিষয়ে ১৯৭৪ সালের শুরুর দিক থেকেই নানান ধরনের বার্তা চালাচালি করেছে ওয়াশিংটনে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর এবং ঢাকা, দিল্লি ও ইসলামাবাদের মার্কিন দূতাবাস।

আরও সতর্কতা : আরও কয়েক দফায় বঙ্গবন্ধুকে সতর্ক করা হয়েছে বলে বিভিন্ন সময়ের সাক্ষাৎকারও প্রকাশিত বইতে উঠে এসেছে। যেমন ১৯৭৪ সালের অক্টোবর থেকে বঙ্গবন্ধু সরকারের পররাষ্ট্র সচিব থাকা ফখরুদ্দিন আহমেদ দাবি করেছেন, সুইডেনে প্রকাশিত এক রিপোর্টের আলোকে তিনি  শেখ মুজিবকে সেনাবাহিনীর মধ্যকার ব্যাপক অসন্তোষ ও সম্ভাব্য ক্যুয়ের বিষয়ে অবহিত করেন। এ ছাড়া সে সময়ের সশস্ত্র বাহিনীর গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান ব্রিগেডিয়ার রউফও এক সাক্ষাৎকারে দাবি করেন, আত্মস্বীকৃত খুনি কর্নেল ফারুক রহমানের নেতৃত্বাধীন সেনাবাহিনীর ট্যাংক রেজিমেন্ট  যে একটি সম্ভাব্য শোডাউন বা শক্তি প্রদর্শনের চেষ্টা করতে পারে, সে ব্যাপারে তিনি বঙ্গবন্ধুকে সতর্ক করেছিলেন। এমনকি তৎকালীন সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল কে এম সফিউল্লাহও পরবর্তী সময়ে দাবি করেছেন, রাষ্ট্রপতি মুজিবকে সম্ভাব্য সামরিক অভ্যুত্থানের বিষয়ে তিনি সতর্ক করেছিলেন।

হত্যার পর সক্রিয় হয় কেজিবি : সোভিয়েত গোয়েন্দা সংস্থা  কেজিবি দাবি করে, বাংলাদেশে সে সময় নাকি তাদের ২০ জন এজেন্ট সক্রিয়; দুজন রীতিমতো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মন্ত্রিসভায়। সেই কেজিবি বঙ্গবন্ধু হত্যার পরপরই মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএকে জড়িয়ে প্রোপাগাণ্ডায় লিপ্ত হয়। কেজিবির পক্ষত্যাগী এক গোয়েন্দার দেয়া তথ্য পরবর্তীতে ব্রিটিশ গোয়েন্দারা প্রকাশ করে। এতে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে পনেরোই আগস্ট সম্পর্কে তাতে পাওয়া যাচ্ছে সামান্য তথ্য: ‘মুজিব হত্যাকাণ্ডের পরই কেজিবি সিআইএর বিরুদ্ধে প্রোপাগাণ্ডায় নেমে পড়ে। এতে শুধু বাংলাদেশের নয়, বিদেশের গণমাধ্যমকেও তারা ব্যবহার করে।’ অবশ্য শেষ পর্যন্ত কেজিবি ঘোষণা দেয় যে, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের জন্য সিআইএ দায়ী নয়।

সর্বশেষ খবর