বুধবার, ১৫ আগস্ট, ২০১৮ ০০:০০ টা

আওয়ামী লীগ নেতারা কোথায় ছিলেন

নিজস্ব প্রতিবেদক

’৭৫-এর ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর সামরিক-বেসামরিক পাল্টা আঘাতের শঙ্কায় ছিল খুনিরা। ৩২ নম্বরে হত্যাকাণ্ডের পর প্রতিআক্রমণ মোকাবিলার জন্য তারা প্রায় ঘণ্টা চারেক প্রস্তুতি নিয়ে বসে ছিল কিন্তু চার ঘণ্টা কেন, রাত পেরিয়ে দিন গড়ালেও প্রতিরোধ গড়তে ব্যর্থ হয় আওয়ামী লীগ। রাজপথেও দেখা যায়নি আওয়ামী লীগ নেতা ও বিভিন্ন সরকারি পদে দায়িত্বশীলদের। বরং খুনিদের নতুন সরকারে যোগ দিয়েছেন একদল তথাকথিত রাজনীতিক ও কর্মকর্তারা। নিয়েছেন তারা আগের চেয়ে বড় পদ ও সুযোগ-সুবিধা। মন্ত্রিপরিষদ গঠনের শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেছেন প্রভাবশালী আমলারা। জানা যায়, জাতির জনককে হত্যার আগে টানা তিন দিন গভীর রাতে কুমিল্লার বার্ডে জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থা এনএসআইর প্রধান এবিএস সফদারের সঙ্গে বৈঠক করেন বঙ্গবন্ধুর কেবিনেটের বাণিজ্যমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমেদ, তথ্য প্রতিমন্ত্রী তাহের উদ্দিন ঠাকুর ও সাবেক আমলা মাহবুব আলম চাষী। এই কয়েকদিন তাদেরকে দেখা যায়নি প্রকাশ্যে। কিন্তু ১৫ আগস্টে আওয়ামী লীগের এই তিন নেতাকে ঢাকায় হাস্যোজ্জ্বল অবস্থায় দেখা যায়। খন্দকার মোশতাক বসে যান রাষ্ট্রপতির আসনে। ডাকেন মন্ত্রিসভার বৈঠক। জেলখানায় নিহত জাতীয় চার নেতা ছাড়া বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার প্রায় সবাই সেদিন উপস্থিত ছিলেন বৈঠকে। অবশ্য জোর করেও উপস্থিত করা হয়েছে কাউকে কাউকে। যেমন বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার প্রবীণ সদস্য ফণি ভূষণ মজুমদারকে পিজি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থা থেকে সরাসরি নিয়ে যাওয়া হয়েছে বঙ্গভবনে। মন্ত্রীদের নিয়ে সেদিন গুরুত্বপূর্ণ কী ধরনের আলোচনা খন্দকার মোশতাক করেছিলেন, তার তেমন কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে এটা ঠিক সেদিন বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড নিয়ে একটি কথাও হয়নি মন্ত্রিসভায়। বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রীরা জাতির জনক হত্যাকাণ্ড নিয়ে জানতেও চাননি। যতদূর জানা গেছে, খন্দকার মোশতাক সেই বৈঠকে বাংলাদেশের জাতীয় পোশাক কী হতে পারে তা নিয়ে জানতে চেয়েছিলেন উপস্থিত মন্ত্রীদের কাছ থেকে।

সূত্র মতে, ১৯৭৫-এর জানুয়ারিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাকশাল গঠনের সিদ্ধান্ত নিলে এর তীব্র প্রতিবাদ জানান মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়কের দায়িত্ব পালন করা জেনারেল এম এ জি ওসমানী। প্রতিবাদে জাতীয় সংসদ সদস্যের পদ থেকে পদত্যাগ করেন তিনি। কিন্তু সেই ওসমানীই আবার কোনো রকম বিবেকের দংশন ছাড়াই মোশতাকের নিরাপত্তা উপদেষ্টার পদ গ্রহণ করেন। মোশতাক সরকারের পুরোটা সময়ই তিনি এই দায়িত্বে ছিলেন। হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়ার মাত্র কয়েকদিন আগে ৮ আগস্ট বঙ্গবন্ধু তার মন্ত্রিসভায় স্থান দেন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে। তাকে এর আগে রাষ্ট্রপতিও বানিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। সেই আবু সাঈদ চৌধুরীকে মোশতাক সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব দেন। আবু সাঈদ চৌধুরী পরবর্তীতে এ নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করে বলেছিলেন, তাকে জোর করে নেওয়া হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন ১৫ আগস্টের আগে সরকারি কাজে বিদেশ সফরে ছিলেন। জাতির জনককে হত্যার খবর পাওয়ার পর তিনি দেশে আসতে অস্বীকৃতি জানান। অভিযোগ আছে, বঙ্গবন্ধুর জীবিত দুই কন্যার একজন তখন ড. কামাল হোসেনকে লন্ডনে মোশতাক সরকারের বিরুদ্ধে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করতে বললেও তখন তা করেননি বঙ্গবন্ধু একান্ত সহচর ড. কামাল।

মুুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার ও স্পিকার নির্বাচিত হওয়া আওয়ামী লীগ নেতা মোহাম্মদউল্লাহকে একসময় ১৯৭৩ সালে এক দফায় রাষ্ট্রপতিও করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। পরে ১৯৭৫-এর শুরুর দিকে মোহাম্মদউল্লাহকে মন্ত্রী হিসেবে নিজের মন্ত্রিসভায় স্থান দেন বঙ্গবন্ধু। সেই মোহাম্মদউল্লাহ বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর পরই খন্দকার মোশতাকের সরকারে যোগ দেন। ছিলেন মন্ত্রী জিয়ার সরকারেও। এমনকি জিয়া হত্যাকাণ্ডের পরে সাত্তার সরকারের একদিনের উপ-রাষ্ট্রপতির দায়িত্বও পালন করেন মোহাম্মদউল্লাহ। একাত্তরে মুজিবনগর সরকারের ঘোষণাপত্র পাঠ করা অধ্যাপক ইউসূফ আলী বঙ্গবন্ধু সরকারের শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন। ১৫ আগস্টের পর তিনিই আবার খুশি মনে যোগ দিয়েছেন খুনি মোশতাক সরকারে। ইউসূফ আলী পরে বিএনপিতে যোগ দিয়েছিলেন। ছাত্র নেতা থেকে আওয়ামী লীগে যোগ দেওয়া কে এম ওবায়দুর রহমান দলীয় এমপি ছাড়াও বঙ্গবন্ধুর আদেশে ডাক ও টেলিযোগাযোগ উপমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তিনিই ১৫ আগস্টের মোশতাক সরকারের ক্ষমতাধর মন্ত্রী হিসেবে দেখা দেন। মুক্তিযুদ্ধের পরের প্রথম সংসদে আওয়ামী লীগের হুইপ শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন ও শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী তাহের উদ্দিন ঠাকুর একইভাবে আওয়ামী লীগের আশীর্বাদ পাওয়া সত্ত্বেও পল্টি দিয়েছেন রাতারাতি। অন্যদিকে কাদের সিদ্দিকীসহ অনেক আওয়ামী লীগ নেতার অভিযোগ খুনিরা ১৫ আগস্ট রাতে ট্যাংক নিয়ে সশস্ত্র অবস্থায় ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িতে আক্রমণ চালালে তৎকালীন সেনাবাহিনী মেজর জেনারেল কে এম শফিউল্লাহকে ফোন করেন বঙ্গবন্ধু। প্রেসিডেন্টের বাসভবনে যাওয়ার জন্য আদেশ পান সেনাপ্রধান। কিন্তু যে কোনো কারণেই হোক সেই রাতে ৩২ নম্বরে যাননি কে এম শফিউল্লাহ। কিন্তু বঙ্গবন্ধু হত্যার পর খুনি মোশতাকের সরকারের প্রতি সেনাবাহিনী প্রধান হিসেবে আনুগত্য প্রকাশ করতে খুব একটা দেরি হয়নি কে এম শফিউল্লাহর। বরং বিমান বাহিনী প্রধান এ কে খন্দকার ও নৌবাহিনী প্রধান এম এইচ খানসহ মোশতাক সরকার গঠনের প্রথম দিনেই আনুগত্য প্রকাশ করে কে এম শফিউল্লাহ। পরে অবশ্য কয়েকদিনের মধ্যেই কে এম শফিউল্লাহ ও এ কে খন্দকার তাদের যথাক্রমে জিয়াউর রহমান ও এম জি তায়েবের কাছে সেনা ও বিমান বাহিনী প্রধানের পদ ছাড়তে হয়েছে। এর কয়েকদিন পরই কে এম শফিউল্লাহ বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব নিয়ে চলে যান বিদেশে। জিয়া ও এরশাদ সরকারের পুরোটা সময় তিনি বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ও হাইকমিশনারের দায়িত্ব পালন করেন। সেই কে এম শফিউল্লাহ আবার শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে এমপি নির্বাচিত হন। প্রায় একই ভাবে এ কে খন্দকারও বিদেশে বাংলাদেশের মিশনে দায়িত্ব নেন। প্রথমে অস্ট্রেলিয়া ও পরে ভারতের বাংলাদেশের হাইকমিশনের দায়িত্ব পালন করেন। ফিরে এসে এরশাদ সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে কিছুদিন কাজ করে দায়িত্ব নেন পরিকল্পনামন্ত্রীর। পরে বঙ্গবন্ধুকন্যার আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন প্রথম মেয়াদের সরকারে যোগ দিয়ে এমপি ও পরিকল্পনামন্ত্রীর দায়িত্ব পান এ কে খন্দকার। অবশ্য মুক্তিযুদ্ধে উপ-সর্বাধিনায়ক জীবনের শেষপর্যায়ে এসে নিজের বইতে বঙ্গবন্ধুর মুখে ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ বসাতে গিয়ে বিতর্কে পড়েন।

১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে পরিবারসহ হত্যার পর ২৩ আগস্ট মোশতাক সরকার গ্রেফতার করে বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহযোগী সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন (অব.) এম মনসুর আলী, তাজউদ্দীন আহমদ, এ এইচ এম কামরুজ্জামান, শেখ আবদুল আজিজ, আবদুস সামাদ আজাদ, এম কোরবান আলী, আবদুল কুদ্দুস মাখন, হাশেম উদ্দিন পাহাড়ীসহ আরও বেশ কয়েকজন নেতাকে। ৩ নভেম্বর কারাগারে গ্রেফতার অবস্থায় নির্মমভাবে হত্যা করা হয় সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন (অব.) এম মনসুর আলী, তাজউদ্দীন আহমদ, এ এইচ এম কামরুজ্জামানকে। এর আগে ৬ সেপ্টেম্বর জিল্লুর রহমান, আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ এবং কয়েকদিনের ব্যবধানে আমির হোসেন আমু, গাজী গোলাম মোস্তফা, এম এ জলিল, এম এ মান্নান, সরদার আমজাদ হোসেন, নুরুল হক, এম শামসুদ্দোহা, এম মতিউর রহমানসহ বেশ কিছু নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতার এড়াতে প্রতিবেশী ভারতে চলে যান আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ, শেখ সেলিম, ওবায়দুল কাদের, ইসমত কাদির গামা, মো. নাসিম, মোস্তফা মহসিন মন্টু, শাহ মোহাম্মদ আবু জাফর, লতিফ সিদ্দিকী, পংকজ ভট্টাচার্য, ডা. এস এ মালেক, এস এম ইউসুফ, মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, খোকা রায়, রবিউল মুক্তাদিরসহ অসংখ্য আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী। তবে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বেশকিছু অনুসারীসহ মেঘালয়ে আশ্রয় নিয়ে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণ ও খুনিদের বিতাড়িত করার জন্য প্রতিরোধের ডাক দেন। তিনি সশস্ত্র যুদ্ধ করেন কয়েক বছর জিয়াউর রহমান সরকারের বিরুদ্ধে সীমান্ত এলাকায়। হত্যাকাণ্ডের প্রায় তিন বছর পর ১৯৭৮ সালের ৩-৫ মার্চ ঢাকায় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের তিন দিনব্যাপী দ্বিবার্ষিক কাউন্সিলে কারাগারে আটক আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের মুক্তি এবং ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ড এবং জেলহত্যার বিচার দাবি করা হয়।

সর্বশেষ খবর