বুধবার, ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা
টিভি অনুষ্ঠানে দুই সচিব

কারাগার রূপান্তর হচ্ছে সংশোধনাগারে

নিজস্ব প্রতিবেদক

কারাবন্দীদের সমস্যা, কারা সংস্কার, বন্দীদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নসহ কারাগারের নানা বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন আইন সচিব (আইন ও বিচার বিভাগ) আবু সালেহ শেখ মো. জহিরুল হক ও স্বরাষ্ট্র সচিব (সুরক্ষা সেবা বিভাগ) ফরিদ উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী। তারা বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে কারাগারকে বন্দীশালা থেকে সংশোধনাগারে রূপান্তরের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। লঘুদণ্ড বা ছোট মামলার আসামিদের বিশেষ ব্যবস্থায় মুক্তির যে ব্যবস্থা করা হচ্ছে, এটা ইতিহাসে বিরল। গতকাল রাতে আনোয়ার সাদির উপস্থাপনায় নিউজ টোয়েন্টিফোর টেলিভিশনের ‘পরিচিত সব গল্প’ নামে অনুষ্ঠানে তারা এসব কথা বলেন। অনুষ্ঠানে বিশিষ্ট সংগীতশিল্পী হায়দার হোসেনও ছিলেন। স্বরাষ্ট্র সচিব বলেন, মূলত কারাগারকে বন্দীশালা বলা যায়। মানুষকে বন্দী করার জন্য কারাগার। কিন্তু মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এটিকে সংশোধনাগারে রূপান্তর করছেন। তিনি এটি করার পাশাপাশি কারাগারের ধারণক্ষমতা বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছেন। তিনি বলেন, বর্তমানে কারাগারে ধারণক্ষমতা আছে ৩৬ হাজার ৬১৪ জনের। আজকে পর্যন্ত (মঙ্গলবার) কারাগারে বন্দী আছেন ৮৯ হাজার ৬৭ জনের মতো। যেখানে ৩৬ হাজার থাকার কথা সেখানে থাকছে ৮৯ হাজারের মতো। এর মধ্যে মাদকের আসামি আছে ৩০ হাজার ৪২৫ জন। সব বন্দীর ৩৪ শতাংশ মাদকের আসামি। তিনি বলেন, বর্তমান সরকার দুই মেয়াদের প্রথম যখন ক্ষমতা গ্রহণ করে, তখন বন্দীর ধারণক্ষমতা ছিল ২৮ হাজারের মতো। এটি এখন উন্নীত হয়ে ৩৬ হাজার হয়েছে। এখন যে প্রকল্পগুলো চলছে তাতে আগামী এক-দেড় বছরে ধারণক্ষমতা দাঁড়াবে প্রায় ৪০ হাজারে। এতেও কোনোভাবে কাভার করা যাচ্ছে না। কোনো কোনো কারাগারে দেখা যাচ্ছে একগুণ, দ্বিগুণ, তিনগুণ বন্দী থাকছে, এমনকি কোনো কোনো কারাগারে সাতগুণ পর্যন্ত বন্দী আছে। স্বরাষ্ট্র সচিব বলেন, কারাগারে যারা রয়েছেন এদের অনেকেই আছেন লঘুদণ্ডের। দেখা যায় অল্প অপরাধ করেছে এদের সংখ্যাই অনেক বেশি। পাশাপাশি অনেক বয়স্ক লোক আছেন, যারা কারাগারে দীর্ঘদিন থাকছেন। লঘুদণ্ড পেয়ে কারাগারে বন্দী আছেন পাঁচ হাজার ৩১ জনের মতো। এ ছাড়া ৭০ বছরের ওপরের বয়সী বন্দী আছেন ৩৬৪ জন। ক্যান্সারে আক্রান্ত আছেন ২০ জন। প্যারালাইজড অবস্থায় আছেন ৩৯ জন, মানসিক ভারসাম্যহীন আছেন ৪১৬ জন। এগুলো সব বিভিন্ন প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত। আমাদের মূল লক্ষ্য হলো, যারা বয়স্ক, বৃদ্ধ কিংবা অসুস্থ অবস্থায় আছেন, তাদেরকে কীভাবে মুক্ত করা যায় এবং এর পাশাপাশি লঘুদণ্ডে যারা আছেন তাদের মুক্ত করা। স্বরাষ্ট্র সচিব বলেন, লঘুদণ্ডের আসামিদের আইনি প্রক্রিয়ায় মুক্ত করার উদ্যোগ নিয়েছি। এ বিষয়টি মাননীয় প্রধান বিচারপতিও অবগত আছেন এবং তিনিও এতে সম্মতি দিয়েছেন। ধারণক্ষমতা যেমন বাড়ানোর প্রচেষ্টা চলছে তেমনি লঘুদণ্ডপ্রাপ্তদের মধ্যে সামর্থ্য কিংবা যথাসময়ে মামলা চলমান না থাকাসহ বিভিন্ন বিষয়ে কারাগারে দীর্ঘদিন থাকছেন। এই সংখ্যা ন্যূনতম পর্যায়ে আনতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা আছে। ফরিদ উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী বলেন, সারা দেশ এই উদ্যোগের আওতায় আসবে এর কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। তবে আমরা সিলেট জেলা কারাগার দিয়ে এ কাজ শুরু করেছি। এটা পর্যায়ক্রমে প্রতিটি কারাগারেই করা হবে। আর সিলেটে যখন আমরা যাই তখন সেখানকার বন্দীরা এই প্রক্রিয়ায় আসতে চায়নি। কারণ বাংলাদেশের জেল ব্যবস্থাপনায় এ উদ্যোগ প্রথম। কারাগারে সবাইকে নিয়ে বসার পর তাদের বোঝানোর পরিপ্রেক্ষিতে প্রায় সবাই তখন রাজি হয়ে যায়। এই প্রক্রিয়ার শুরুতে আমরা অত্যন্ত গোপনীয়তা রক্ষার চেষ্টা করেছি। প্রতিটি বিভাগের একটা বড় জেলা বেছে নিয়ে এই প্রক্রিয়া এগিয়ে নেওয়া হবে। এভাবে প্রায় ২০ হাজারের মতো বন্দী এর আওতায় আসবে। এ বিষয়ে আইন সচিব আবু সালেহ শেখ মো. জহিরুল হক বলেন, দেশের কারাগারগুলোতে বন্দীর চাপ কমাতে ছোট বা কম সাজার মামলার আসামিদের মুক্তি দিতে আইন সংশোধনের প্রয়োজন নেই। প্রচলিত আইনেই এসব কারাবন্দীকে মুক্তি দেওয়া সম্ভব। তিনি বলেন, কারাগারে থাকা বন্দীদের জন্য আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে উদ্যোগ নিয়েছেন, এটা বিশ্বের ইতিহাসে প্রথম। আইন সচিব বলেন, কারাগারে বন্দীরা কত কষ্টে জীবন যাপন করেন, সেখানে না গেলে এটা বোঝা যাবে না। যেখানে ২০ জন থাকার কথা সেখানে ১০০ জন থাকছে। এসব বিষয় ভেবেই লঘুদণ্ডের মামলার আসামিদের মুক্তির বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্যোগ নেন। প্রধানমন্ত্রীর এই উদ্যোগের পর স্বরাষ্ট্র সচিবকে সঙ্গে নিয়ে আমি প্রধান বিচারপতির কাছে গিয়েছিলাম। প্রধান বিচারপতিও এ উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন। তিনি বলেন, আমাদের দেশে ব্রিটিশ আমলে কারাগারকে বন্দীশালা হিসেবে গড়ে তোলা হলেও, আমাদের প্রধানমন্ত্রী চান কারাগার হবে সংশোধনাগার। কারাগার থেকে মুক্তির পর একজন মানুষ যেন স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারেন, সে বিষয়টিও নিশ্চিত করতে বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। লঘুদণ্ডের আসামিদের মুক্তির প্রক্রিয়া সম্পর্কে তিনি বলেন, ধরুন কোনো মামলায় সর্বোচ্চ সাজা হতে পারে ছয় মাস আর সর্বনিম্ন এক মাস। অথচ ওই আসামি দুই মাস ধরে কারাগারে রয়েছেন। বিচার শুরু হচ্ছে না। ওই সব মামলায় তাকে আদালতে উপস্থাপনের পর যদি দোষ স্বীকার করে ভবিষ্যতে অপরাধ না করার প্রতিশ্রুতি দেন, তাহলে তাকে মুক্তির বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেওয়া যেতে পারে। কারাগারে বন্দীর চাপ কমাতে সরকার নানা বিকল্প পদ্ধতি নিয়েছে জানিয়ে আইন সচিব বলেন, সরকার প্রতি জেলায় বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি (এডিআর) ব্যবস্থা চালু করেছে। প্রতিটি জেলা লিগ্যাল এইড অফিসে একজন এডিআর কর্মকর্তা থাকছেন। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মামলা হওয়ার আগে সমঝোতার মাধ্যমে অভিযোগের নিষ্পত্তি করা হচ্ছে। ওই অভিযোগটা মামলা হয়ে আর আদালতে আসছে না। এটাতে অনেক সাড়া পাওয়া যাচ্ছে বলেও জানান আইন সচিব। ছোটখাটো মামলা হলেই একজন মানুষকে জেলে কেন নিতে হবে, বিশিষ্ট সংগীতশিল্পী হায়দার হোসেনের এমন প্রশ্নে স্বরাষ্ট্র সচিব বলেন, ছোটখাটো অপরাধে জেলে নেওয়া একটা আইনি প্রক্রিয়া।’

সর্বশেষ খবর