মঙ্গলবার, ১৬ অক্টোবর, ২০১৮ ০০:০০ টা

আলোচনায় মিথ্যা বললে জেল-জরিমানা

সম্প্রচার আইনে ২৪ অপরাধ, আছে বিভিন্ন ধারায় জেল ও পাঁচ কোটি টাকা দণ্ড হ মন্ত্রিসভায় খসড়া অনুমোদন

নিজস্ব প্রতিবেদক

সম্প্রচার মাধ্যমে আলোচনা অনুষ্ঠানে মিথ্যা, অসত্য, বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রচার করলে তিন বছরের কারাদণ্ড বা পাঁচ কোটি টাকা অর্থদণ্ড এবং লাইসেন্স ও নিবন্ধন সংক্রান্ত অপরাধের জন্য সাত বছরের কারাদণ্ড ও পাঁচ কোটি টাকা জরিমানার বিধান রেখে বেতার, টেলিভিশন ও অনলাইন সংবাদমাধ্যমগুলোর জন্য প্রস্তাবিত সম্প্রচার আইন-২০১৮ এর খসড়া নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। প্রস্তাবিত আইনে সম্প্রচার কমিশন গঠনের বিধান রাখা হয়েছে। একই সঙ্গে মন্ত্রিসভা গণমাধ্যমকর্মী (চাকুরির শর্তাবলি) আইন-২০১৮ নামে গণমাধ্যমকর্মীদের জন্য প্রস্তাবিত নতুন আরেকটি আইনের খসড়া নীতিগত অনুমোদন দেয়। গতকাল সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সভাকক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকে এ দুটি আইনসহ আরও তিনটি ও একটি নীতিমালার খসড়া নীতিগতভাবে অনুমোদন করা হয়। বৈঠক শেষে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম প্রস্তাবিত এসব আইনের বিষয়ে ব্রিফিং করেন।

মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, প্রস্তাবিত সম্প্রচার আইনটি করা হচ্ছে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা করে। এতে সাত সদস্যের একটি সম্প্রচার কমিশন গঠনের কথা বলা হয়েছে, যার সদস্যদের নিয়োগ করা হবে পাঁচ সদস্যের সার্চ কমিটির মাধ্যমে। ওই কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতি কমিশনের সদস্য নিয়োগ দেবেন।

মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, এ কমিশন সম্প্রচার ব্যবস্থাকে শক্তিশালী ও গতিশীল, মান উন্নয়ন, আন্তর্জাতিক মানদণ্ড নির্ণয়ে কাজ করবে এবং সম্প্রচার যন্ত্রপাতির লাইসেন্স প্রদানের জন্য সুপারিশ করবে। সরকারের অনুমতি সাপেক্ষে কমিশনই সম্প্র্রচার লাইসেন্স দেবে। আর অনলাইন গণমাধ্যমের নিবন্ধন দেওয়ার ক্ষেত্রে কমিশনের একক কর্তৃত্ব থাকবে।

মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, প্রস্তাবিত আইনের খসড়ায় সম্প্রচার কমিশন গঠনের পাশাপাশি কমিশনারদের নিয়োগ, যোগ্যতা-অযোগ্যতা, মেয়াদ, পদত্যাগ, অপসারণ, পদমর্যাদা, পারিশ্রমিক ছাড়াও বিভিন্ন বিষয়ের বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেওয়া আছে। তিনি বলেন, কমিশনের চেয়ারম্যান হতে কমপক্ষে ১৫ বছরের অভিজ্ঞতার কথা বলা হয়েছে প্রস্তাবিত আইনে। কমিশনের মেয়াদ হবে পাঁচ বছর।

মন্ত্রিপরিষদ সচিব জানান, সম্প্রচার লাইসেন্স নবায়ন কত বছর পর হবে সেটি নির্ধারণ করা হবে বিধিমালার মাধ্যমে। প্রস্তাবিত আইনে ১৯ ধারায় যোগ্যতার মানদণ্ড, লাইসেন্স ও নিবন্ধন বাতিল, স্থগিতকরণ ও অন্যান্য ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়ে বলা হয়েছে, প্রস্তাবিত আইনের অধীন কোনো আবেদনকারী লাইসেন্স ও নিবন্ধনপ্রাপ্তির যোগ্য হবেন না যদি তিনি সাতটি মানদণ্ডের অন্তর্ভুক্ত না হন। এগুলো হচ্ছে— যদি উপযুক্ত আদালত কর্তৃক বিকৃতমস্তিষ্ক ঘোষিত হন, যদি দুই বছর বা তদূর্ধ্ব মেয়াদের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন বা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হলে বিভাগীয় মামলায় যদি দণ্ডিত হন এবং উক্ত দণ্ড হইতে মুক্তি পাওয়ার পর যদি পাঁচ বছর অতিক্রান্ত না হয়। এই আইনের অধীনে যদি কোনো অপরাধ সংঘটনের দায়ে দণ্ডিত হয়ে থাকেন এবং উক্ত দণ্ড থেকে মুক্তি পাওয়ার পর পাঁচ বছর অতিক্রম না হয়; আদালত কর্তৃক দেউলিয়া ঘোষিত হলে এবং দেউলিয়াত্বের দায় হতে অব্যাহতি না পেলে; ঋণখেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হলে; বিগত পাঁচ বছরের মধ্যে তার লাইসেন্স বা নিবন্ধন বাতিল করা হয়ে থাকে এবং কমিশন নির্ধারিত অন্য কোনো মানদণ্ডে দণ্ডিত হলে। মন্ত্রিপরিষদ সচিব জানান, প্রস্তাবিত আইনের ১৯ ধারা লঙ্ঘন হলে এই আইনেরই ২৯ ধারায় বলা হয়েছে, উপরোক্ত অপরাধের জন্য অনধিক সাত বছরের কারাদণ্ড বা কোটি টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা যাবে।

মন্ত্রিপরিষদ সচিব জানান, আইনের সপ্তম অধ্যায়ে ২৮ ধারায় বলা হয়েছে, ২৪টি অপরাধ যেমন কোনো অনুষ্ঠানে সরাসরি বা বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে দেশবিরোধী এবং জনস্বার্থবিরোধী বক্তব্য প্রচার; আলোচনা অনুষ্ঠানে বিভ্রান্তিকর ও অসত্য তথ্য বা উপাত্ত প্রচার; রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানের ভাষণ, জরুরি আবহাওয়া বার্তা, স্বাস্থ্য বার্তা, গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা, প্রেসনোট ও অন্যান্য জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান সম্প্রচার/প্রচারের জন্য সরকার কর্তৃক প্রদত্ত নির্দেশনা অমান্য করলে; মহান মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও চেতনা, রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি এবং বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় আদর্শ ও নীতিমালার পরিপন্থী অনুষ্ঠান বা বিজ্ঞাপন প্রচার; দেশীয় সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও ভাবধারার পরিপন্থী অনুষ্ঠান বা বিজ্ঞাপন প্রচার; শিশু ও নারীর প্রতি সহিংসতা, বৈষম্যমূলক আচরণ ও হয়রানিমূলক কর্মকাণ্ডকে উদ্বুদ্ধ করে এমন কোনো অনুষ্ঠান প্রচার; শিশুদের মনস্তাত্ত্বিক, মানবিক এবং নৈতিক গঠনকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে এমন ধরনের অশ্লীল, তথ্যগতভাবে ভুল ও ভাষাগতভাবে অশোভন এবং সহিংসতামূলক অনুষ্ঠান প্রচার; মানবিক অনুভূতিকে আঘাত করে এমন দৃশ্য যেমন হত্যাকাণ্ড, দুর্ঘটনায় নিহত ও আত্মহত্যাকারীর মৃতদেহ, মানুষ ও প্রাণী নির্যাতন এবং ধর্ষণ ও ব্যভিচার দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত কোনো নারী বা শিশুর স্থির বা চলচ্চিত্র প্রদর্শন; অনুষ্ঠান ও বিজ্ঞাপনে হিংসাত্মক ও সংন্ত্রাসমূলক কোনো দৃশ্য প্রদর্শন; ঔষধ জাতীয় পণ্য, হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার, স্বাস্থ্য কেন্দ্র ইত্যাদির ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমোদন/ছাড়পত্র না থাকলে এর বিজ্ঞাপন প্রচার; রাষ্ট্রীয়ভাবে সংরক্ষিত গুরুত্বপূর্ণ ভবন, স্থাপনা, কার্যালয় যেমন জাতীয় সংসদ ভবন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, রাষ্ট্রপতির কার্যালয়, বাংলাদেশ সচিবালয়, কোর্ট বা আদালত ও আদালতের কার্যক্রম, সেনানিবাস এলাকা ইত্যাদি পণ্যের বিজ্ঞাপন চিত্রের প্রদর্শন; শারীরিক ও মানসিক অক্ষমতা, দৈহিক আকার ও বর্ণকে কেন্দ্র করিয়া কোনো বিজ্ঞাপন প্রচার; শিশুর নৈতিক, মানসিক ও শারীরিক ক্ষতি করতে পারে এমন কোনো বিষয় বিজ্ঞাপনে অন্তর্ভুক্ত করা; বিজ্ঞাপনে শিশুদের পরনিন্দা, বিবাদ ও কলহের দৃশ্য এবং ঝুঁকিপূর্ণ কাজে অংশগ্রহণের দৃশ্য প্রদর্শন; বিজ্ঞাপনে ও অনুষ্ঠানে ধর্ষণ, ব্যভিচার, অশ্লীল ছবি ও চলচ্চিত্র, নির্যাতন এবং স্নায়ুর ওপর চাপ সৃষ্টি করে এমন দৃশ্য, যেমন ফাঁসি, শ্বাসরোধ, আত্মহত্যা, অঙ্গবিচ্ছেদ ইত্যাদি প্রদর্শন; কোনো অনুষ্ঠানে অথবা বিজ্ঞাপনে জাতীয় আদর্শ ও উদ্দেশ্যের প্রতি কোনো প্রকার ব্যঙ্গ অথবা বিদ্রূপ, বাংলাদেশের জনগণের অবমাননা অথবা স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশর অখণ্ডতা ও সংহতি বিনষ্ট করতে পারে এমন দৃশ্য অথবা বক্তব্য প্রচার; বিচ্ছিন্নতা ও অসন্তোষ সৃষ্টির লক্ষ্যে জাতি বা শ্রেণিবিদ্বেষ প্রচার, কোনো ধর্মের প্রতি বিদ্রূপ, অবমাননা অথবা আক্রমণ, বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়, বর্ণ বা মতাবলম্বীদের মধ্যে বিদ্বেষ ও বিভেদ সৃষ্টি করতে পারে এমন দৃশ্য ও বক্তব্য প্রচার; কোনো ব্যক্তির ব্যক্তিগত, গোপনীয় ও মর্যাদাহানিকর তথ্য প্রচার; রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে এমন কোনো সামরিক, বেসামরিক ও সরকারি তথ্য প্রচার; আইনশৃঙ্খলা ভঙ্গ করতে উৎসাহ সৃষ্টি করতে পারে বা আইনশৃঙ্খলা ভঙ্গের প্রতি সহানুভূতি সৃষ্টি করতে পারে এমন অনুষ্ঠান বা বক্তব্য প্রচার; কোনো বিদেশি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এমন ধরনের প্রচারণা যাহার ফলে বাংলাদেশের সহিত সুসম্পর্ক নষ্ট হতে পারে; কোনো জনগোষ্ঠী, জাতি ও দেশের মর্যাদা ও ইতিহাসের জন্য ক্ষতিকর ঘটনা ও দৃশ্যবিন্যাস এবং তথ্যের বিকৃতি ঘটায় এমন কোনো কিছু প্রচার; জনস্বার্থ বিঘ্নিত হতে পারে এমন কোনো বিদ্রোহ, নৈরাজ্য এবং হিংসাত্মক ঘটনা প্রদর্শন এবং দুর্নীতিকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে উৎসাহ প্রদান করে এমন কোনো অনুষ্ঠান ও বিজ্ঞাপন প্রচার করলে অনধিক পাঁচ বছরের কারাদণ্ড বা পাঁচ কোটি টাকা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার বিধান রাখা হয়েছে প্রস্তাবিত আইনে। কেউ এসব অপরাধ চলমান রাখলে প্রতিদিন এক লাখ টাকা করে জরিমানার বিধান রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে।

এদিকে সম্প্রচার আইন ছাড়াও গতকালের বৈঠকে কস্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্ট্যান্টস আইন-২০১৮ এর খসড়া চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া উদ্ভিদের জাত সংরক্ষণ আইন-২০১৮ এর খসড়া এবং বাংলাদেশ রিহ্যাবিলিটেশন কাউন্সিল আইন-২০১৮ এর খসড়া নীতিগত অনুমোদন এবং জাতীয় উদ্ভাবন ও মেধাসম্পদ নীতিমালা-২০১৮ এর খসড়া নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা।

আপাতত সংশোধন হচ্ছে না ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন

সম্পাদক পরিষদকে দেওয়া সরকারের তিন মন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী গতকালের মন্ত্রিসভা বৈঠকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের সংশোধন নিয়ে সম্পাদক পরিষদের দাবি এবং উদ্বেগের প্রসঙ্গটি আলোচনা হয়েছে। বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, বৈঠকে প্রস্তাবিত সম্প্রচার আইনের খসড়া উত্থাপনের সময় আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এবং তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু সম্পাদক পরিষদের বক্তব্যটি তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রীর সামনে। এ সময় আইনমন্ত্রী বলেন, সম্পাদক পরিষদ আইনের সঙ্গে একমত পোষণ করেছে। তবে তারা কয়েকটি বিষয় নিয়ে তাদের আপত্তি ও উদ্বেগের কথা জানিয়ে আইনটির সংশ্লিষ্ট ধারাগুলো সংশোধনের দাবি জানিয়েছেন।

বৈঠক সূত্র জানায়, এ বিষয়টি নিয়ে প্রায় এক ঘণ্টা আলোচনা হয়। আলোচনায় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, এই আইন সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে নয়, তাদের ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আপাতত আইনটি সংশোধনের সম্ভাবনা নেই জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, যেটা পাস হয়ে গেছে সেটা নিয়ে এখানে আলোচনার কিছু নেই। যদি এর অপপ্রয়োগ হয় তাহলে তখন সংশোধনের বিষয় আলোচনা হবে।  

সূত্র জানায়, বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, সম্পাদক পরিষদ তো নয়, দু-একজন সম্পাদক আন্দোলন করছেন। তিনি অভয় দিয়ে বলেছেন, সাংবাদিকদের ভয় পাওয়ার কিছু নেই। কেউ যদি ইনটেনশনাল কিছু না লিখে বা রিপোর্ট না করে তাহলে ভয়ের কিছু নেই। এ সময় প্রধানমন্ত্রী ওয়ান-ইলেভেন সরকারের সময়ে তাঁর বিরুদ্ধে একাধিক পত্রিকায় প্রকাশিত মিথ্যা সংবাদের তথ্য তুলে ধরে বলেন, ক্ষতি করে তারপর দুঃখ প্রকাশ করেছে। যে ক্ষতি হয়েছে সেটা তো পূরণ হওয়ার নয়।

সর্বশেষ খবর