বুধবার, ২১ নভেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তির সঙ্গে আপস করবে না ভারত

কূটনৈতিক প্রতিবেদক

বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধবিরোধী কোনো শক্তির সঙ্গে কোনো ধরনের আপস করবে না ভারত।  এ কারণে বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ভারতের নিয়মিত যোগাযোগ থাকলেও জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রাখে না নয়াদিল্লি বা ঢাকার ভারতীয় হাইকমিশন। তবে জামায়াতের সঙ্গে জোটে থাকা অন্যান্য রাজনৈতিক দলের বিষয়ে ভারতের ভিন্ন কোনো অবস্থান নেই। সেক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সব দলকেই সমান গুরুত্ব দেয় ভারত। আসন্ন নির্বাচনে বাংলাদেশের জনগণ যে দলকেই নির্বাচিত করুক, তার সঙ্গে কাজ করতে প্রস্তুত রয়েছে ভারত। ঢাকায় কর্মরত ভারতের শীর্ষস্থানীয় এক কূটনীতিক গতকাল এসব কথা জানিয়েছেন। শীর্ষস্থানীয় ওই কূটনীতিক বলেন, ভারত মনে করে যে কোনো দেশের নির্বাচন সম্পূর্ণভাবেই সে দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এ কারণে বাংলাদেশের নির্বাচনেও কোনো ধরনের হস্তক্ষেপের বিষয়ে ভারত আগ্রহী নয়। তবে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ যেন অস্থিতিশীল হয়ে না ওঠে সে বিষয়ে বিশেষ দৃষ্টি আছে ভারতের। কারণ বাংলাদেশ অস্থিতিশীল হলে ভারতের জন্যও তা উদ্বেগের। যেভাবে ভারত অস্থিতিশীল হলে বাংলাদেশের জন্য তা উদ্বেগজনক। সম্প্রতি বিকল্পধারার প্রেসিডেন্ট ডা. এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর সঙ্গে ভারতের হাইকমিশনার হর্ষবর্ধন শ্রিংলার বৈঠকের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে ভারতীয় কূটনীতিক বলেন, শুধু বদরুদ্দোজা চৌধুরী নয়, বাংলাদেশের বেশিরভাগ রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে হাইকমিশনের নিয়মিত যোগাযোগ হয়। বদরুদ্দোজা চৌধুরী বাংলাদেশের সাবেক প্রেসিডেন্ট এবং সম্মানিত ব্যক্তি। এটা সম্পূর্ণরূপে সৌজন্যমূলক এবং হাইকমিশনারের সঙ্গে তার প্রথম সাক্ষাৎ। তিনি হাইকমিশনারকে লাঞ্চের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। পরে সেখানে মিডিয়ার উপস্থিতি দেখা গেল। যদিও হাইকমিশনারের এ ধরনের সাক্ষাৎ বা বৈঠকে সাধারণত মিডিয়াকে জানানো হয় না। যেমন হাইকমিশনারের সঙ্গে সম্প্রতি বিএনপি নেতা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, জাতীয় পার্টির হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, রওশন এরশাদ ও রুহুল আমিন হাওলাদার, জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের কয়েকজন নেতাসহ জাসদ, বাসদ, জাকের পার্টিসহ বিভিন্ন দলের নেতাদের সাক্ষাৎ হয়েছে। যেভাবে আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গেও বিভিন্ন সময়ে সাক্ষাৎ হয়। শুধু হাইকমিশনার শ্রিংলা নন, ভারতীয় হাইকমিশনের পলিটিক্যাল শাখার দায়িত্বশীল কূটনীতিকদের সঙ্গেও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের নিয়মিত যোগাযোগ হয়। তবে জামায়াতে ইসলামী নেতাদের সঙ্গে ভারতের হাইকমিশন কোনো ধরনের যোগাযোগ রাখে না উল্লেখ করে ভারতীয় কূটনীতিক জানান, ভারত কখনই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তির সঙ্গে হাত মেলাবে না। কারণ, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে ভারতীয় সেনাবাহিনীও যুদ্ধ করেছে। সেখানে ভারতীয় সেনাদেরও রক্ত ঝরেছে, অনেক ভারতীয় মা তাদের সন্তান হারিয়েছেন। আর জামায়াত সেসময় মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে সরাসরি পাকিস্তানিদের সহযোগিতায় যুদ্ধ করেছে। জামায়াতের সেই প্রো-পাকিস্তানি মনোভাবের এখনো কোনো পরিবর্তন হয়নি। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে জামায়াত এখনো আদর্শগত যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। জামায়াতের দলীয় গঠনতন্ত্র এখনো পরিবর্তন হয়নি। যে জামায়াতের হাতে ভারতীয় যোদ্ধাদের রক্ত তাদের সঙ্গে ভারত কখনই হাত মেলাবে না। তাহলে জামায়াতের সঙ্গে জোটে থাকা অন্যান্য রাজনৈতিক দলের বিষয়ে নয়াদিল্লির অবস্থান কী?— এমন প্রশ্নের জবাবে ভারতীয় কূটনীতিক বলেন, এটা আসলেই জটিল। কিন্তু অন্য যে রাজনৈতিক দলগুলো জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে হাঁটছে ভারত তাদের বিরোধিতা করে না। কারণ তারাও বাংলাদেশি। বাংলাদেশের জনগণ যদি তাদের নির্বাচিত করে তাহলে ভারতের কোনো বক্তব্য থাকে না বা থাকতে পারে না। গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে ভারত বাংলাদেশের সবারই মতামত গুরুত্ব দেয়।

দক্ষিণ এশিয়ার দেশ শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ ও নেপালের নির্বাচনের মতো বাংলাদেশেও চীন ও ভারত কোনো প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হতে যাচ্ছে কিনা—এমন প্রশ্নের জবাবে ভারতীয় কূটনীতিক বলেন, ভারত তার প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্ককে গুরুত্ব দেয় এটা সত্য কিন্তু ভারত কারও সঙ্গে প্রতিযোগিতায় বিশ্বাসী নয়। ভারত প্রতিবেশী জনগণের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্কে বিশ্বাস করে। তাই প্রতিবেশী দেশগুলোর জনগণের জীবনমান উন্নয়নে প্রতিবেশীদের চাহিদা ও ইচ্ছা অনুসারে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়। এটা কোনো একক নির্বাচনের ওপর নির্ভর করে না বরং দীর্ঘমেয়াদ ধরে চলতে থাকে। শ্রীলংকায় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বী তিনজনের সঙ্গেই নয়াদিল্লির আন্তরিক সম্পর্কের উদাহরণ অন্য দেশগুলোর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরের পর গত তিন বছরে দুই দেশের সম্পর্কে ‘ঈর্ষণীয় ও অবিশ্বাস্য’ উন্নতি হয়েছে উল্লেখ করে ভারতীয় কূটনীতিক বলেন, গত তিন বছরে দুই দেশের মধ্যে ৯২টি চুক্তি হয়েছে। এগুলোর বেশির ভাগই হাইটেক প্রযুক্তি খাতে সহযোগিতা বিষয়ক। দুই দেশের মধ্যে এতগুলো চুক্তি স্বাক্ষর আসলেই সহযোগিতার মাত্রা যে অনন্য উচ্চতায় আছে তা প্রমাণ করে। এ ছাড়া এই সময়ে বাংলাদেশ-ভারত তাদের স্থল ও সমুদ্রসীমার মীমাংসা করেছে, সীমান্ত অতিক্রম করা ৫৫৩ জন বাংলাদেশি জেলেকে কোন রকমের আইনি পদক্ষেপ ছাড়া বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে, দুই দেশের সীমান্তে তৈরি করা হয়েছে ক্রাইম ফ্রি জোন, বাংলাদেশের চার হাজার সরকারি কর্মকর্তা ও তিন হাজার বিচারবিভাগীয় কর্মকর্তাকে ভারতে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা হয়েছে। এ সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ-ভারত ২৫টি চিঠি হস্তান্তরের তথ্য জানিয়ে ওই কূটনীতিক বলেন, ভিসা ব্যবস্থার উন্নয়নে বড় ধরনের সংস্কার এসেছে গত তিন বছরে। এখন বেনাপোল-পেট্রাপোল বন্দর ২৪ ঘণ্টাই কাজ করছে। এ সময়ে বাংলাদেশে যেমন ভারতের বিনিয়োগ বেড়েছে তেমনি প্রথমবারের মতো বাংলাদেশি পণ্য ভারতের বাজারে তাদের মার্কেট তৈরি করতে পেরেছে। ভারতেও বাংলাদেশের বিনিয়োগ আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় বেড়েছে বলে মন্তব্য করেন ভারতীয় হাইকমিশনের শীর্ষস্থানীয় এই কর্মকর্তা।

 

 

সর্বশেষ খবর