রবিবার, ২ ডিসেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

ব্যাপক সংঘর্ষ তাবলিগের দুই গ্রুপে

নিহত ১, আহত দুই শতাধিক, বিমানবন্দন সড়ক অবরোধ, শেষ ছিল না ভোগান্তির

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা গাজীপুর ও টঙ্গী প্রতিনিধি

ব্যাপক সংঘর্ষ তাবলিগের দুই গ্রুপে

গতকাল তাবলিগ জামাতের দুই গ্রুপের সংঘর্ষের পর বিমানবন্দরের সামনের সড়ক অবরোধ করে রাখা হয়। এতে ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয় —বাংলাদেশ প্রতিদিন

গাজীপুরের টঙ্গীতে বিশ্ব ইজতেমা ময়দানে জোড় ইজতেমাকে কেন্দ্র করে তাবলিগ জামাতের দুই পক্ষের মুসল্লির মধ্যে দফায় দফায় তুমুল সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। সংঘর্ষে ইসমাইল হোসেন (৭০) নামের একজন নিহত এবং উভয় পক্ষের দুই শতাধিক মুসল্লি আহত হয়েছেন। আহতদের উদ্ধার করে টঙ্গী সরকারি হাসপাতাল এবং কুর্মিটোলা ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। ভয়াবহ এই সংঘর্ষে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে উত্তরামুখী বিমানবন্দর সড়ক। পরে বিকালে সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের সভাপতিত্বে এবং প্রধানমন্ত্রীর সামরিক সচিব মেজর জেনারেল  মিয়া মোহাম্মদ জয়নুল আবেদীনের উপস্থিতিতে তাবলিগের দুই গ্রুপের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক শেষে পরিস্থিতি পুরো নিয়ন্ত্রণে আনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। গতকাল ভোর সাড়ে ৫টা থেকে দুপুর সোয়া ১২টা পর্যন্ত মাওলানা সা’দ কান্ধলভি ও মাওলানা জুবায়েরপন্থি তাবলিগ জামাতের মুসল্লিদের মধ্যে দফায় দফায় এ সংঘর্ষ চলে। সচিবালয়ে বৈঠক শেষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, জাতীয় নির্বাচনের আগে বিশ্ব ইজতেমা হচ্ছে না। পরে ইজতেমার তারিখ ঠিক করা হবে। প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা যায়, ভারতের দিল্লির মাওলানা সা’দ অনুসারী তাবলিগ জামাতের মুসল্লিরা গতকাল ফজরের নামাজের পর থেকে ইজতেমা মাঠে প্রবেশের চেষ্টা করেন। এ সময় র‌্যাব সদস্যরা ইজতেমা মাঠে সর্বশেষ অবস্থান করা সা’দ অনুসারীদের বের করে দিয়ে মাঠটি মুসল্লিমুক্ত করে দেন। অন্যদিকে আগে থেকেই ভিতরে থাকা মাওলানা জুবায়ের অনুসারী তাবলিগ জামাতের মুসল্লি ও মাদ্রাসার ছাত্ররা এ সময় তাদের ভিতরে প্রবেশে বাধা দেন। এতে সা’দ অনুসারীরা টঙ্গী-কামারপাড়া সড়কে ও ময়দানের প্রতিটি গেটে অবস্থান গ্রহণ করে তাসবিহ তাহলিম ও বয়ান করছিলেন। এ সময় পুলিশ সদস্যরা ভিতরে ঢুকে জুবায়ের অনুসারীদের সঙ্গে কথা বলতে থাকেন। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ১১টার দিকে ইজতেমা মাঠের টয়লেটের ছাদ থেকে জুবায়ের অনুসারী ছাত্ররা বাইরে অবস্থান নেওয়া সা’দ অনুসারীদের ওপর ইটপাটকেল নিক্ষেপ করতে থাকেন। এতে সা’দ অনুসারীদের অনেকেই আহত হন। পরে ইটপাটকেল দিয়ে তারাও জুবায়ের অনুসারীদের ওপর পাল্টা হামলা করেন। একপর্যায়ে সা’দ অনুসারীরা ইজতেমা মাঠে প্রবেশ করলে দুই পক্ষের মধ্যে মুখোমুখি সংঘর্ষ বেধে যায়। এ খবর টঙ্গীসহ আশপাশ এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। রাজধানীর মহাখালী থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত সড়ক পুরো অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। নির্দিষ্ট সময়ে বিমানবন্দরে পৌঁছতে না পারায় অনেকেই গতকাল ফ্লাইট মিস করেছেন। ভয়াবহ এ সংঘর্ষে দুই শতাধিক মুসল্লি ও মাদ্রাসাছাত্র আহত হন। বেলা ৩টার দিকে গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ ইজতেমা মাঠ খালি করে দেয়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তাবলিগের শূরা সদস্য ও ভারতের সা’দপন্থি মুরব্বিরা জানান, তারা অন্যান্য বছরের মতো এবারও বিশ্ব ইজতেমা শুরুর নির্ধারিত সময়ের আগে টঙ্গীর বিশ্ব ইজতেমা ময়দানে জোড় ইজতেমা অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেন। সে অনুযায়ী ৩০ নভেম্বর থেকে ৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত পাঁচ দিনব্যাপী জোড় ইজতেমা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। কিন্তু ৩০ নভেম্বর জোড় ইজতেমায় যোগ দিতে আসা কয়েক হাজার মুসল্লি ইজতেমা ময়দানে ঢুকতে গেলে দেওবন্দ কওমিপন্থি মাওলানা জুবায়েরের অনুসারী বিভিন্ন মাদ্রাসার ছাত্ররা তাদের বাধা দেন। কয়েক দিন ধরে কওমি মাদ্রাসা থেকে বিপুলসংখ্যক ছাত্র বিচ্ছিন্নভাবে ইজতেমা ময়দানে অবস্থান নেন। তারা সা’দপন্থিদের কৌশলে মাঠ থেকে সরানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। ঢাকা মোহাম্মদপুরের বসিলা হাফেজি মাদ্রাসার শিক্ষার্থী নূর হোসেন (১৫) জানান, তিনি বুধবার ইজতেমা মাঠে আসেন মাঠ তৈরির কাজ করতে। তার সঙ্গে আরও সহপাঠী ইজতেমা মাঠে জড়ো হন। একই মাদ্রাসার মো. সিয়াম ও ওমর ফারুক জানান, তারা আগে কোনো দিন তাবলিগ জামাতে অংশ নেননি। বুধবার ইজতেমা মাঠে এসে এ রকম পরিস্থিতির মুখোমুখি হন। টঙ্গী-কামারপাড়া সড়কের চা-বিক্রেতা সোহাগ ও রাকিব জানান, ভিতরে থাকা মুসল্লিরা হঠাৎ করেই শুক্রবার সকালে ইজতেমা ময়দানে প্রবেশের সব গেট বন্ধ করে দেন। সকাল সাড়ে ১০টা থেকে ইজতেমা মাঠের ভিতর থেকে তারা বাইরে থাকা মুসল্লিদের উদ্দেশে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করেন। সা’দ অনুসারী ঢাকার শান্তিনগরের মাওলানা রুহুল আমীন বলেন, সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিভিন্ন জেলার প্রশাসকরা দুই পক্ষকে জেলায় জেলায় এবং ইজতেমা মাঠে ভিন্ন ভিন্ন তারিখে দুই ভাগে জামাত আয়োজনের সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। দেশের সব জেলায়, এমনকি কাকরাইল মসজিদেও দুই ভাগে কার্যক্রম চলছে। অথচ তারা সরকারের সিদ্ধান্ত না মেনে বিভিন্ন মাদ্রাসার ছাত্রদের নিয়ে বিশ্ব ইজতেমা মাঠে এনে সরকারি নির্দেশ অমান্য করছে। তারা সা’দ অনুসারীদের ইজতেমা মাঠে প্রবেশ করতে বাধা ও মাঠ থেকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। অন্যদিকে দেওবন্দ (জুবায়ের) কওমিপন্থি তাবলিগ মুরব্বি মাওলানা শরীফুল ইসলাম জানান, ৭ থেকে ১১ ডিসেম্বর তারা জোড় ইজতেমার ঘোষণা দেন। এ ঘোষণা শুনে সা’দপন্থিরা ৩০ নভেম্বর থেকে ৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত পাঁচ দিনব্যাপী জোড় ইজতেমা অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেন। এ নিয়ে উভয় পক্ষ মুখোমুখি অবস্থান নিলে দুই পক্ষের প্রতিনিধিদের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ডেকে নিয়ে নির্বাচনের আগে জোড় ইজতেমা স্থগিত রাখার অনুরোধ জানানো হয়। সেখানে উভয় পক্ষই ওই সিদ্ধান্ত মেনে নেয়। এর পরও সা’দ অনুসারী কয়েক হাজার তাবলিগ মুসল্লি শনিবার ভোরে জোড় ইজতেমা করার জন্য ময়দানে ঢোকার চেষ্টা করেন। টঙ্গী পশ্চিম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এমদাদুল হক জানান, ঘটনা নিয়ন্ত্রণের জন্য পুলিশ ও র‌্যাব সদস্যরা ইজতেমা মাঠে অবস্থান করছেন। ইজতেমা ময়দানে পুলিশ-র‌্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পর্যাপ্ত সদস্য মোতায়েন রয়েছে। বেলা ৩টার দিকে মাঠ থেকে সব মুসল্লিকে বের করে দেওয়া হয়েছে। র‌্যাবের হেলিকপ্টার টহল অব্যাহত রয়েছে। গাজীপুর মেট্রোপলিটন ট্রাফিক পুলিশের দক্ষিণ জোনের সিনিয়র সহকারী কমিশনার থোয়াই অংপ্রু মারমা বলেন, ইজতেমা ময়দানের বাইরে কয়েক হাজার মুসল্লি ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে অবস্থান নিয়ে দুপুর ১২টা থেকে দেড়টা পর্যন্ত মহাসড়ক অবরোধ করে রাখেন। ফলে যানবাহন চলাচল বিঘ্নিত হয়। অন্যদিকে কামারপাড়া সড়কে সকাল থেকেই সা’দ অনুসারীরা অবস্থান নেন। এতে ওই সড়কের যান চলাচলও বন্ধ হয়ে যায়।  সচিবালয়ে বৈঠক : তাবলিগ জামাতের দুই পক্ষের দ্বন্দ্ব নিরসনে গতকাল সচিবালয়ে বৈঠক করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। গতকাল বিকালে অনুষ্ঠিত বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন দিল্লি মারকাজের মাওলানা মোহাম্মদ সা’দ কান্ধলভিপন্থি বাংলাদেশে তাবলিগের শূরা সদস্য সৈয়দ ওয়াসিফুল ইসলাম এবং কওমিপন্থি মাওলানা জুবায়ের অনুসারী তাবলিগের উপদেষ্টা মাওলানা আশরাফ আলী ও আবদুল কুদ্দুসসহ নেতারা। এ ছাড়া বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীর সামরিক সচিব মেজর জেনারেল মিয়া মোহাম্মদ জয়নুল আবেদীন, পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী, র‌্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ, ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়াসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। বানচালের পাঁয়তারা : বিশ্ব ইজতেমা বানচালের পাঁয়তারা চলছে বলে অভিযোগ করেছেন হেফাজতে ইসলামের আমির আল্লামা শাহ আহমদ শফী। গতকাল গণমাধ্যমে এক বিবৃতিতে তিনি এ অভিযোগ করেন। তিনি বলেন, ‘মাওলানা মোহাম্মদ সাদ কান্ধলভির অনুসারীরা টঙ্গীর মাঠ দখল করার জন্য যথেষ্ট ষড়যন্ত্র এবং পাঁয়তারা চালাচ্ছে। এ ছাড়া টঙ্গী মাঠে হামলা করে বেশ কয়েকজন সাথীকে আহত করেছে। এ ধরনের ন্যক্কারজনক ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছে হেফাজতে ইসলাম।’ কলঙ্কজনক অধ্যায় : সংঘর্ষের ঘটনা কলঙ্কজনক অধ্যায় হয়ে থাকবে বলে মন্তব্য করেছেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির মুফতি সৈয়দ মোহাম্মদ রেজাউল করীম পীর চরমোনাই। গতকাল এক বিবৃতিতে তাবলিগের উভয়পক্ষকে সংযত হওয়ার আহ্বান জানান।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর