শুক্রবার, ৭ ডিসেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা
পিছনে ফেলে আসি

মাহমুদুল হকের প্রিয়মুখ

ইমদাদুল হক মিলন

মাহমুদুল হকের প্রিয়মুখ

মাহমুদুল হকের ডাকনাম বটু। আমরা ডাকতাম বটুভাই। ফর্সা সুন্দর মানুষ। একফোঁটা মেদ নেই শরীরে। মাথায় ঝাঁকড়া চুল। অপূর্ব প্রাণবন্ত হাসি। সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি পরতেন। একবার সেই প্রিয়মুখ যে দেখেছে বটুভাইকে সে কখনো ভুলতে পারবে না। বিস্ময়কর পড়াশোনা ছিল। ইংরেজিতে অত্যন্ত দক্ষ কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক তেমন কোনো ডিগ্রি ছিল না। দুর্দান্ত স্মার্ট লোক। কথা বলতেন প্রাণখুলে, কথার কথায় হাসি। আড্ডায় মাহমুদুল হকের কোনো তুলনা ছিল না। ভাইয়ের সোনার দোকান ছিল বায়তুল মোকাররমে। সেখানে মাঝে মাঝে বসতেন। পাথর চেনায় তাঁর কোনো জুরি ছিল না। যে কোনো মূল্যবান পাথরের দিকে তাকিয়েই বলে দিতে পারতেন সেটি আসল না নকল। চমৎকার একটি গদ্য ভাষা ছিল তাঁর। লেখক হিসেবে অন্তর্দৃষ্টি ছিল প্রখর। লিখতেন যেটুকু পড়তেন তারচেয়ে শতগুণ বেশি। পৃথিবীবিখ্যাত কয়েকটি বই অনুবাদও করেছিলেন। চমৎকার প্রাঞ্জল ভাষায় তাঁর অনুবাদকর্মের একটির কথা এই মুহূর্তে আমার মনে পড়ছে। বইটির বাংলা নাম তিনি দিয়েছিলেন ‘যুদ্ধ যখন শেষ হলো’। ইংরেজি নাম ‘হোয়েন দ্যা ওয়ার ইজ ওভার’। লেখকের নাম স্টিফেন বেকার। ১৯৬৯ সালে নিউইয়র্কের র‌্যান্ডম হাউস ইনস্টিটিউশন থেকে প্রকাশিত হয়েছিল। মাহমুদুল হক অনুবাদ করলেন ’৭২ সালে। ওসমানিয়া লাইব্রেরি থেকে সেই বই প্রকাশিত হলো। ৩০০ পৃষ্ঠার বইটির দাম পাঁচ টাকা। ‘যুদ্ধ যখন শেষ হলো’ খুবই চমৎকার একটি উপন্যাস। উপন্যাসের কাহিনি গড়ে উঠেছিল বিস্মৃত হওয়া ছোট্ট একটি ঘটনা কেন্দ্র করে। সেই ঘটনার সঙ্গে জড়িয়েছিল একটি লজ্জাকর পরিণতি। সম্ভবত আমেরিকার গৃহযুদ্ধের সর্বশেষ হত্যা। এক কিশোর গেরিলাকে গুলি করে হত্যার ঘটনা নিয়ে লেখা হয়েছিল এই উপন্যাস। অতিযত্নে সেই উপন্যাসের অনুবাদ করেছিলেন মাহমুদুল হক। এই লেখা লিখতে গিয়ে বটুভাইকে নিয়ে কতদিনকার কত কথা যে মনে পড়ছে। কী যে ভালোবাসতেন তিনি আমাকে। ছিয়াত্তর-সাতাত্তর সালের দিকে শহীদ কাদরীর বাসায় নিয়মিত আড্ডা হতো। বটুভাই রফিক আজাদ বেলাল চৌধুরী কখনো কখনো আবদুল মান্নান সৈয়দ আর তরুণ লেখক কবিদের আড্ডা। শহীদ কাদরীর সঙ্গে গভীর বন্ধুত্ব বটুভাইয়ের। রফিক আজাদ বেলাল চৌধুরীর সঙ্গেও বন্ধুত্ব একই রকম। কত বই নিয়ে কথা হতো সেই আড্ডায়। কত লেখক কবি নিয়ে কথা হতো। সাহিত্যের কত খুঁটিনাটি তাঁদের জানা ছিল। আমি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তাঁদের কথা শুনতাম। লেখক কবিদের নিয়ে হাসি-ঠাট্টা গসিপও কম হতো না। শহীদ কাদরীর মতো নাক উঁচু কবিও মাহমুদুল হকের লেখার একনিষ্ঠ ভক্ত। আমরা তো ছিলামই। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ঢাকায় এলে সচিত্র সন্ধানীর অফিসে কিংবা ওই পত্রিকার স্বত্বাধিকারী এবং সম্পাদক গাজী শাহাবুদ্দিন আহমেদের অফিসে কিংবা বাড়িতে তুমুল আড্ডা আর খাওয়া-দাওয়া হতো। সেই আড্ডার প্রাণ ছিলেন বটুভাই। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ও খুবই পছন্দ করতেন তাঁকে। তাঁর লেখার মুগ্ধ পাঠক ছিলেন। ‘রোববার’ পত্রিকা বের করার তোড়জোড় চলছে। আটাত্তর সালের কথা। আমি সেই পত্রিকায় জুনিয়র রিপোর্টার হিসেবে জয়েন করেছি। মাথার উপরে আছেন রফিক আজাদ আর রাহাত খান। সেই সময়টায় প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও আমাদের আড্ডা হচ্ছে। সন্ধ্যা থেকে অনেকটা রাত অবধি কাটছে বটুভাইয়ের এলিফ্যান্ট রোডের বাসায়। এসব প্রিয় মানুষ এবং আড্ডা ছেড়ে আমি চলে গেলাম জার্মানিতে। দুই বছর পর ফিরে এলাম। ফিরে আসার পরেরকার দুটো ঘটনা খুব মনে পড়ে। পরদিন দেখা হয়েছিল রফিক আজাদের সঙ্গে। তখন তিনি দুটো চাকরি করেন। বাংলা একাডেমি এবং রোববার পত্রিকায়। দুই জায়গার এক জায়গা থেকে বেতন পেয়েছেন। বেতনের পুরো টাকাটা আমার জন্য খরচ করে ফেললেন। সেদিনই সন্ধ্যার পর দেখা হলো বটুভাইয়ের সঙ্গে। আমাকে দেখে মুখটা এত উজ্জ্বল হলো তাঁর দু’হাতে অনেকক্ষণ আমাকে বুকে জড়িয়ে রাখলেন। যেন আপন সন্তান ঘরে ফিরেছে বহুকাল পর। সেই ঘটনার কথা ভাবলে চোখে পানি আসে। কত বড় বড় লেখক কবির অকুণ্ঠ ভালোবাসা পেয়েছি আমি। বটুভাইয়ের খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন শেখ আবদুর রহমান বুড়োভাই বিপ্লব দাস শেখ আবদুল হাকিম। তাঁদের সঙ্গে আড্ডা হতো অন্যত্র। বুড়োভাইদের ওয়ারীর বাড়িতে। বটুভাই সেখানেও আমাকে কয়েকবার নিয়ে গেছেন। আক্তারুজ্জামান ইলিয়াসও কখনো কখনো আসতেন সেই বাড়িতে। বিপ্লব দাসও চমৎকার সব গল্প লিখেছিলেন। হিজড়াদের নিয়ে অসাধারণ উপন্যাস ছিল তাঁর। ‘কিম্পুরুষ’। উপন্যাসটির নামকরণ করে দিয়েছিলেন বেলাল চৌধুরী। ‘গঙ্গাজলীর বেজী’ গল্পটির কথাও মনে পড়ে। বিপ্লবের গল্পের বইয়ের নাম ছিল ‘পঞ্চুহরির শেষ বিবাহ’। আহা, কত মানুষ ছিলেন আমাদের, কত লেখক কবি ছিলেন। মৃত্যু তাদের কোথায় নিয়ে গেছে। মাহমুদুল লেখালেখি শুরু করেছিলেন ষাট দশকের গোড়ার দিকে। প্রথম উপন্যাস ‘অনুর পাঠশালা’। কোনো একটি সিনেমা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। বই করার সময় নামটা বদলে দিয়েছিলেন বটুভাই। ‘যেখানে খঞ্জনা পাখী’। একটি বাচ্চা ছেলের দৃষ্টি থেকে তার চারপাশ এবং জীবন দেখাই ছিল উপন্যাসটির মূল। কবিতার মতো অসামান্য এক গদ্য লেখা। খুব বেশি লেখেননি তিনি। চল্লিশ-পঞ্চাশটা গল্প হতে পারে। সাত আটটি উপন্যাস হতে পারে। মুক্তধারা থেকে বেরিয়েছিল গল্পের বই ‘প্রতিদিন একটি রুমাল’। কী অসামান্য সব গল্প। উপন্যাস লিখলেন ‘জীবন আমার বোন’। বটুভাই ছিলেন বরিস পাস্তারনাকের খুবই ভক্ত। ‘ডক্টর জিভাগো’ উপন্যাসটির কথা প্রায়ই বলতেন, সেই উপন্যাস থেকে উদ্ধৃতি দিতেন অনেক। পাস্তারনাকের কবিতার নাম থেকে ‘জীবন আমার বোন’ নামটা নিয়েছিলেন। বাংলাদেশের বিদগ্ধ পাঠক মুগ্ধ হয়ে গেল এই উপন্যাস পড়ে। তারপর লিখলেন ‘নিরাপদ তন্দ্রা’। আরেক মেধাবী উপন্যাস। পাঠক মন্ত্রমুগ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের সময় সপরিবারে তিনি আশ্রয় নিয়েছিলেন বিক্রমপুরের ইছাপুরা গ্রামে। সেখানে তাঁর বন্ধুর বাড়ি। সেই বাড়িতে থেকে নিবিড়ভাবে দেখলেন ওই অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধ। স্বাধীনতার পর লিখলেন তার মাইলস্টোন উপন্যাস ‘খেলাঘর’। মোর্শেদুল ইসলাম ছবি করলেন এই উপন্যাস নিয়ে। যতবার ‘খেলাঘর’ পড়েছি ততবারই চোখের জলে ভেসেছি আমি। বটুভাইয়ের আরও দুটি লেখার কথা মনে পড়ছে। ‘মাটির জাহাজ’ ‘পাতালপুরী’। প্রতিটি লেখাতেই ভিন্ন ভিন্ন মাত্রা। এক লেখার সঙ্গে আরেক লেখা মেলে না। প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু অনুযায়ী গদ্যভাষা তৈরি করতেন। আশ্চর্য ব্যাপার, এতবড় মাপের এই লেখক হঠাৎ করেই সাহিত্য জগৎ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিলেন। গ্রহণ করলেন স্বেচ্ছা নির্বাসন। কোন অভিমান তাঁকে আক্রান্ত করেছিল আমরা কেউ জানতে পারিনি। কেন বাংলা সাহিত্যকে তিনি তার বিপুল ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত করলেন তা বড় রকমের রহস্য হয়ে থাকল আমাদের কাছে। এই লেখার মধ্য দিয়ে মাহমুদুল হকের স্মৃতির উদ্দেশে আমি আমার শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা নিবেদন করলাম।

 

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর