শনিবার, ৮ ডিসেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

অল্পের জন্য বেঁচে গিয়েছিলাম

নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু

অল্পের জন্য বেঁচে গিয়েছিলাম

অপারেশন শেষে কেরানীগঞ্জের এক গরিব কৃষকের কাচারি ঘরের মেঝের মাটি খুঁড়ে গর্ত করে সেখানে অস্ত্র রাখতাম। এক দিন এক বড় দুর্ঘটনায় প্রায় মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে যাই। সেদিন শুক্রবার ছিল। বিকালে ভাত খেতে বসেছি। ভাত খাওয়া শেষে আমাকে পায়েস খেতে দেওয়া হলো। পায়েস খেতে দেওয়ার বিষয়ে বাড়ির গৃহকর্তাকে জিজ্ঞেস করতে তিনি আমাকে বললেন, অল্পের জন্য আপনি দুর্ঘটনার হাত থেকে বেঁচে গেলেন। আল্লাহ আপনাকে রক্ষা করেছেন বলে মসজিদে মিলাদ পড়িয়েছি। নিজেদের গরুর দুধ ও মোটা চাল দিয়ে পায়েস রান্না করা হয়েছে। তারা আমার জন্য আল্লাহর কাছে অনেক দোয়া করেছেন। রক্তের সম্পর্ক না থাকার পরেও একজন মুক্তিযোদ্ধার জন্য এক দরিদ্র কৃষক পরিবারের এমন ভালোবাসা আমাকে মুগ্ধ করে। ওই কৃষক পরিবারের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। মুক্তিযুদ্ধের এই স্মৃতিটি এখনো আমাকে উদ্বেলিত করে। একাত্তরের মার্চ মাসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা দেন। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে আমরা পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে কাজ শুরু করি। ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। আমরা মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে থাকি। আমাদের নানা দায়িত্বের মধ্যে ছিল বিক্ষোভ মিছিল। সমাবেশের পাশাপাশি জনগণের জানমালের নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করা। ৬ মার্চ রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশ ছিল উত্তাল। সেদিন রাতে ছিল কারফিউ। পাকিস্তানি বাহিনীর নিষ্ঠুরতা ও নির্মমতায় ঢাকা তখন লাশের মিছিলে পরিণত হয়। এর আগে ১ মার্চ পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে খুন হন ছাত্রনেতা তসলিম। তসলিমের মৃত্যুর পর আমাদের আন্দোলন অনেক বেশি বেগবান হয়। পরবর্তী সময়ে ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের আরেক নেতা ফারুক ইকবালকেও মৌচাকের সামনে গুলি করে হত্যা করা হয়। তসলিম ও ফারুক মালিবাগ, গুলবাগ, মৌচাক এলাকার দায়িত্বে ছিল। ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’ এবং ‘জয় বাংলা’— এ স্লোগান নিয়েই আমরা এগিয়ে যাচ্ছিলাম। বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ভাষণ দেবেন এবং তার ঘোষণায় আন্দোলনের পরবর্তী কর্মসূচি ঠিক করা হবে। ৭ মার্চের সমাবেশ সফল করার লক্ষ্যে আমরা তৎপর হয়ে পড়লাম। বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দানে আসার আগেই সারা দেশের কৃষক-শ্রমিক-ছাত্র-জনতা মিলে ১০ লক্ষাধিক মানুষ রেসকোর্স ময়দানে এসে হাজির হয়। কৃষকরা হাজির হয় লাঙ্গল ও কাস্তে নিয়ে। শ্রমিকরা আসে কোদাল ও শাবল নিয়ে। বিকাল ৩টার একটু পর বঙ্গবন্ধু এলেন। তিনি ভাষণ দিলেন। তোফায়েল আহমেদসহ অন্য নেতারা তখন মঞ্চে ছিলেন। আমরা ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের সবাই মঞ্চের খুব কাছেই ছিলাম। বঙ্গবন্ধুর সেই ঐতিহাসিক ভাষণ ‘ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো; এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম; এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম’ আমাদের এগিয়ে যাওয়ায় উজ্জীবিত করল। রেডিও পাকিস্তান ঐতিহাসিক সে ভাষণটি প্রচার করেনি। আমরা তখন শাহবাগের রেডিও পাকিস্তান ও আজিমপুরের সেনা রিক্রুটমেন্ট অফিসে আক্রমণ করলাম। রেডিওর বাঙালি কর্মকর্তারা তখন আমাদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে রাস্তায় বেরিয়ে এলেন। পাকিস্তান সরকার বাধ্য হয়ে ৮ মার্চ বঙ্গবন্ধুর সেই ঐতিহাসিক ভাষণটি ঢাকা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচার করে। হুকুম দিতে না পারলেও আমাদের কী করণীয় এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু তার বক্তব্যে আমাদের গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা দিয়েছিলেন। সেই নির্দেশনা অনুসরণ করে সমগ্র বাঙালি সম্ভাব্য পাকিস্তানি আক্রমণের বিরুদ্ধে নিজেদের প্রস্তুত করে। ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। স্বাধীনতার দাবিতে নিরবচ্ছিন্ন মিছিল, সমাবেশে উত্তাল হয়ে ওঠে সমগ্র বাঙালি জাতি। ২৩ মার্চ ছিল পাকিস্তানের প্রজাতন্ত্র দিবস। ওই দিন এ দেশের কোনো অফিস-আদালতে আমরা পাকিস্তানি পতাকা উড়তে দিইনি। তারা আমাদের আক্রমণ করতে পারে এ জন্য আমরা প্রস্তুত ছিলাম। কিন্তু তাদের সে আক্রমণ এতটা ভয়ঙ্কর হবে, তা ছিল কল্পনাতীত। তারা ট্যাংক, কামান ও ভারী অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে নিরীহ বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। আমরা রাস্তায় গাছের গুঁড়ি ফেলে তাদের প্রতিহত করার চেষ্টা করলাম। স্বল্প অস্ত্র দিয়ে ও প্রশিক্ষণের অভাবে আমরা পাকিস্তানি বাহিনীর ত্রিমুখী আক্রমণ প্রতিরোধ গড়তে ব্যর্থ হই। ২৫ ও ২৬ মার্চ গণহত্যা চলল। ছাত্র, পুলিশ ও বিডিআর সদস্যরা অসীম সাহসিকতার সঙ্গে লড়াই করে। এতে কয়েক হাজার যোদ্ধা শাহাদাৎ বরণ করেন। ২৫ মার্চে অর্থাৎ ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা করেন। বঙ্গবন্ধুর সেই ঘোষণায় ২৫ মার্চের প্রতিরোধ যুদ্ধ ২৬ মার্চে মুক্তিযুদ্ধের মর্যাদা পেল। ২ এপ্রিল পাকিস্তানের হানাদার বাহিনী ঢাকার কেরানীগঞ্জে যে নারকীয় গণহত্যা চালায় তাতে কয়েক হাজার নিরীহ মানুষের মৃত্যু হয়। আমি, আমার বন্ধু রাইসুল ইসলাম আসাদ, কাজী শাহজাহান ববী, তুহিন পুলিশের কাছ থেকে রাইফেল নিয়ে কেরানীগঞ্জে চলে গেলাম। বেশ কিছু দিন ট্রেনিং শেষে ঢাকা আক্রমণ করার পরিকল্পনা করলাম। কুমিল্লা হয়ে চলে যাই ত্রিপুরা রাজ্যের হরিনায়। বিএসএফের একজন মেজর আমাকে ২ নম্বর সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফের কাছে নিয়ে যান। সেখানে তারা আমাকে বলেন, বাংলাদেশ থেকে মুক্তিকামী যুবকদের নিয়ে আসার জন্য। মে মাসের প্রথম সপ্তাহে আমি ঢাকায় আসি। ঢাকা থেকে অর্ধশত যুবককে নিয়ে ১৫ মে আবার ভারতে যাই। সেখানে ঢাকা, কুমিল্লা, ফরিদপুরের হাজার হাজার যুবক ট্রেনিংয়ে অংশ নেয়। ট্রেনিং শেষে আমি ও আমার বন্ধু শহীদ মানিক ঢাকা উত্তর মুক্তিবাহিনীর দায়িত্ব নিই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা কলেজ, কল্যাণপুরসহ বিভিন্ন জায়গায় অপারেশন চালাই। এরপর ঢাকার বাইরে সাভার ও ধামরাইয়ে অপারেশন চালাই। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ধর্ম নিরপেক্ষ, অসাম্প্রদায়িক ও মানুষের সমঅধিকার প্রতিষ্ঠায় আগামীর উন্নত রাষ্ট্র বিনির্মাণে এগিয়ে আসার জন্য তরুণদের আমি আহ্বান জানাই। অনুলিখন : মোস্তফা মতিহার

সর্বশেষ খবর