শুক্রবার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

জিরো টলারেন্সে থাকবে ইসি

মোবাইল ব্যাংকিং বন্ধসহ ইন্টারনেটের গতি কমানোর সুপারিশ । ২৪ ডিসেম্বরের পর সেনা তাণ্ডব যেন না ঘটে : সিইসি

নিজস্ব প্রতিবেদক

জিরো টলারেন্সে থাকবে ইসি

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে জিরো টলারেন্স অবস্থানের নির্দেশনা দিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এইসঙ্গে পুলিশ, র‌্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী অন্যান্য বাহিনীর সমন্বয়ে তিন স্তরের নিরাপত্তাব্যবস্থা রাখার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ইসিসূত্র জানান, ২৪ ডিসেম্বরের পর থেকে স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে মাঠে সেনাবাহিনীর সদস্যরা নামতে পারেন। এ ক্ষেত্রে প্রতি জেলায় ছোট আকারে সেনাবাহিনীর একটি টিম পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা, রিটার্নিং কর্মকর্তা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতিবেদন এবং সার্বিক দিক লক্ষ্য রেখে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এবারে সব মিলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রায় ৬ লাখ সদস্য মোতায়েন করা হতে পারে।

গতকাল আগারগাঁওয়ের নির্বাচন ভবনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে এসব বিষয়ে আলোচনা হয়। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদার সভাপতিত্বে বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন চার নির্বাচন কমিশনার ও ইসি সচিব। এ ছাড়া ছিলেন সশস্ত্র বাহিনী বিভাগীয় প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দুই বিভাগের সচিব, পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, সব রিটার্নিং কর্মকর্তা, পুলিশ সুপারসহ (এসপি) ইসির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, নির্বাচনে সাধারণ এলাকার ভোট কেন্দ্রের পাহারায় একজন পুলিশসহ ১৪ জন সদস্য, মেট্রোপলিটন এলাকার ভোট কেন্দ্রে তিনজন পুলিশসহ ১৫ জন এবং দুর্গম ও উপকূলীয় এলাকার ভোট কেন্দ্রে দুজন পুলিশসহ ১৪ জন সদস্য মোতায়েনের পরিকল্পনা রয়েছে ইসির। র‌্যাব, বিজিবি, কোস্টগার্ড ও আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের সদস্যরা মোবাইল ও স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে টহলে থাকবেন। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ও আচরণবিধি প্রতিপালনে দেড় হাজারের বেশি জুডিশিয়াল ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মাঠে থাকবেন। সব মিলিয়ে ভোটের মাঠের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ৬ লাখের বেশি সদস্য মাঠে নামছেন। ৬৪০ জন জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ভোটের আগে-পরে চার দিন মাঠে থাকবেন। এ সময় তারা নির্বাচনী অপরাধে সংক্ষিপ্ত বিচার করবেন। ভোট কেন্দ্রে নিয়োজিত পুলিশ সদস্যরা ভোট গ্রহণের দুই দিন আগে, ভোটের দিন ও ভোটের পরদিন পর্যন্ত মোট চার দিন মাঠে থাকবেন। আর অঙ্গীভূত আনসার সদস্যরা ভোট গ্রহণের তিন দিন আগে মাঠে নেমে থাকবেন ভোটের পরদিন পর্যন্ত।

তাণ্ডব যেন না ঘটে : প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদা বলেছেন, ২০১৪ সালের নির্বাচনের অবস্থা আমাদের ভুলে গেলে চলবে না। ওই নির্বাচনে ভয়ঙ্কর অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। ওই অবস্থার আলোকে বুঝে এবারের নির্বাচনের প্রস্তুতি ও রূপরেখা তৈরি ও কৌশল অবলম্বন করা প্রয়োজন, যাতে এবার ভয়ঙ্কর অবস্থা, তাণ্ডব না ঘটে।

গতকাল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সমন্বয় সভায় সভাপতির বক্তব্যে এ কথা বলেন তিনি। নির্বাচন নিয়ে তৃতীয় কোনো শক্তির ষড়যন্ত্র আছে কিনা খতিয়ে দেখার তাগিদ দেন সিইসি। ভোটের ভাগ্য যাতে মস্তান-সন্ত্রাসীদের হাতে চলে না যায় সে ব্যাপারেও সবাইকে সতর্ক থাকতে বলেন তিনি। সিইসি বলেন, এবারের নির্বাচনে আপনাদের দায়িত্ব জনগণের জীবন রক্ষা, মালামাল রক্ষা, দেশের পরিবেশ-পরিস্থিতি শান্ত রাখা। আমি প্রত্যাশা করব, পেশাদারী দায়িত্ব পালনে আপনাদের যে অভিজ্ঞতা, দক্ষতা ও মানসিকতা তা কাজে লাগাবেন। গত নির্বাচনের মতো যেন এবার তাণ্ডব না ঘটে, সে রকম যেন সুযোগ সৃষ্টি না হয়, এখন থেকে সতর্কতার সঙ্গে লক্ষ্য রাখতে হবে।

নূরুল হুদা বলেন, অত্যন্ত প্রত্যাশিত একটি দিন, জাতীয় নির্বাচনের দিন। ওই নির্বাচনে নতুন সরকার সংসদ গঠন করবে। নির্বাচনের সামগ্রিক প্রস্তুতি, যেমন ক্রয়যোগ্য মালামাল সংগ্রহ শতকরা ৯৫ ভাগ সম্পন্ন হয়েছে। ব্যালট পেপার, ভোট কেন্দ্র, ভোটার তালিকা চূড়ান্ত করা হয়েছে। নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার প্রসঙ্গে সিইসি বলেন, এবার আমরা ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহার করতে চাই। জনগণের ভোট মস্তানদের হাতে ছেড়ে দেওয়া যায় না। বাক্স ছিনতাইকারীদের হাত থেকে ভোটারদের মুক্তি দিতে হবে। আমরা ৬টি এলাকায় ইভিএম ব্যবহার করতে যাচ্ছি। সে ৬টি এলাকায় যার যার দায়িত্ব, তাদের অনুরোধ করব আলাদাভাবে দৃষ্টি দিতে, সতর্কতামূলক ও নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নিতে। ইভিএম সঠিকভাবে প্রয়োগ করা হলে নির্বাচন প্রক্রিয়ায় এ দেশের শতকরা ৮০ ভাগ অনিয়ম দূর হবে বলে তিনি মন্তব্য করেন। সিইসি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তাদের উদ্দেশে বলেন, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিশ্চিতে নজরদারি রাখবেন। নারী ভোটারদের নিরাপত্তার বিষয়টিও আলাদাভাবে খেয়াল রাখবেন, যাতে ভোট দিয়ে নিরাপদে বাড়ি ফিরে যেতে পারেন। প্রত্যেক এলাকার মস্তান ও গোলযোগ সৃষ্টিকারীদের তালিকা তৈরি করতে হবে, যা আপনারা সব সময় করে থাকেন। সেটা এখন থেকেই তৈরি করতে হবে।

মোবাইল নিয়ে কেন্দ্রে প্রবেশ নিষিদ্ধ : নির্বাচনে ভোট কেন্দ্রের ৪০০ গজের মধ্যে মোবাইল ফোন নিয়ে প্রবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা আসছে। রিটার্নিং কর্মমকর্তা ছাড়া কেউ যাতে মোবাইল নিয়ে ঢুকতে না পারেন এজন্য নির্দেশনা দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। গতকাল আইনশৃঙ্খলাবিষয়ক সমন্বয় সভায় এ নির্দেশনা দেওয়া হয়। এ ছাড়া সভায় মোবাইল ব্যাংকিং বন্ধসহ ইন্টারনেটের গতি কমিয়ে আনার সুপারিশ করা হয়। সভায় নির্বাচনের দিন সাংবাদিকদের ভোট কেন্দ্রে প্রবেশের বিষয়েও কড়াকড়ি আরোপের ওপর পুলিশের পক্ষ থেকে প্রস্তাব আসে। নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘ভোট কেন্দ্রে প্রিসাইডিং কর্মকর্তা ছাড়া কেউ মোবাইল নিয়ে ঢুকতে পারবেন না। অ্যান্ড্রয়েড তো দূরের কথা ৪০০ গজের মধ্যে কেউ বাটন মোবাইল নিয়েও ঢুকতে পারবেন না। তবে ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ব্যাপারে আমাদের করার কিছু নেই।’

সভায় কয়েকজন পুলিশ সুপার (এসপি) ভোটের দিন থ্রি-জি নেটওয়ার্কের বদলে টু-জি রাখার প্রস্তাব করেন। তবে এ ব্যাপারে কমিশন থেকে কোনো সিদ্ধান্ত জানানো হয়নি। সভায় একজন নির্বাচন কমিশনার বলেন, ২০ ডিসেম্বরের পর পরিস্থিতি আরও বেশি খারাপ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ওই সময়টাতে আপনাদের অধিক ধৈর্য ধারণ করতে হবে। মনে রাখতে হবে, ফৌজদারি অপরাধ আর আচরণবিধি এক নয়। আপনাদের ছোট্ট একটা ভুলের কারণে অনেক কিছু ঘটে যেতে পারে।

পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বৈঠক : নির্বাচন কমিশনের দেওয়া দিকনির্দেশনা অনুযায়ী জেলা প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় রেখে কাজ করার জন্য পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছেন পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজি) ড. জাবেদ পাটোয়ারী।

গতকাল বিকালে ঢাকায় পুলিশ সদর দফতরে অনুষ্ঠিত বৈঠকে পুলিশের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) পদ থেকে তদূর্ধ্ব কর্মকর্তাদের মধ্যে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে পুলিশের আইজি ড. জাবেদ পাটোয়ারী এ নির্দেশনা দেন। পূর্বনির্ধারিত এ বৈঠকে আইজিপি ছাড়াও র‌্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ ও ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া বক্তব্য দেন। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন এমন বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নির্বাচন সামনে রেখে কোথাও কোথাও হামলা-পাল্টা হামলার ঘটনা ঘটছে। অনেক প্রার্থী নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন করছেন। এমনটা যাতে না হয় সেজন্য ভ্রাম্যমাণ আদালতকে আরও শক্ত হাতে তা দমন করতে হবে। এ ছাড়া নির্বাচনী পোস্টার ও ব্যানার টাঙানোকে কেন্দ্র করে কোথাও যেন কোনো প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকরা বিবাদে না জড়িয়ে পড়েন সেজন্য এলাকায় এলাকায় পুলিশের টহল জোরদার করতে হবে। একই সঙ্গে সব প্রার্থী ও ভোটারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। এ ছাড়া ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস, ২৫ ডিসেম্বর বড়দিন ও ইংরেজি নববর্ষ বরণকে কেন্দ্র করে দেশের কোথাও যেন অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে সেজন্য পর্যাপ্ত নিরাপত্তাব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।

বিএনপির অভিযোগ : ‘প্রচারণা শুরুর পর থেকে বিএনপি নেতা-কর্মীদের যেভাবে গ্রেফতার করা হচ্ছে তাতে মনে হচ্ছে সরকারি দল নয়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীই বিএনপির প্রতিপক্ষ।’ গতকাল নির্বাচন কমিশনে লিখিত অভিযোগ দিতে এসে সাংবাদিকদের এ কথা বলেন দলটির যুগ্মমহাসচিব মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল। এ ছাড়া ২৫টি নির্বাচনী এলাকায় প্রার্থী, সমর্থকদের গ্রেফতার-হয়রানির অভিযোগ করেছে দলটি। নির্বাচন কমিশনে এ বিষয়ে আলাদা ৫টি চিঠি দিয়েছে বিএনপি। বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সেলিমা রহমানের নেতৃত্বে তিন সদস্যের প্রতিনিধি দল বিকালে ইসির সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য এলে ২৫ মিনিট অপেক্ষা করে চিঠিগুলো ডেসপাসে জমা দেন। বিএনপির নির্বাচন পরিচালনা কমিটির চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম খান স্বাক্ষরিত ‘নেতা-কর্মীদের হয়রানি বন্ধ, ঐক্যফ্রন্ট প্রার্থীদের নিরাপত্তা, জোটপ্রধানের ছবি ব্যবহার ও বিএনপির ওয়েবসাইট উন্মুক্ত’ এসব চিঠি প্রধান নির্বাচন কমিশনার বরাবর লেখা হয়েছে। চিঠি জমা দেওয়ার পর মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, আমাদের কেন যেন মনে হচ্ছে নির্বাচনটা ধানের শীষের সঙ্গে সরকারি দল আওয়ামী লীগের নয়; নির্বাচনটা মনে হচ্ছে আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী পুলিশ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নামে যারা রয়েছেন তারা। পুলিশের নির্বিকার অবস্থানের সমালোচনা করে এর প্রতিকার চান তিনি। তিনি জানান, গাজীপুরের প্রার্থী ফজলুল হক মিলনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। উত্তরায় ঐক্যফ্রন্টের সভামঞ্চ ভাচুর ও মারধর, সভা পণ্ড করা হয়েছে। এ ছাড়া ফরিদপুর-২, ৩, ঢাকা-১, ২; নরসিংদী-২, ময়মনসিংহ-২, ৩, ১১; মাগুরা-১, ২; কুষ্টিয়া-৩, সিরাজগঞ্জ-২, ৩; পটুয়াখালী-১, মৌলভীবাজার-৩, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২, ৩, নেত্রকোনা-৩, মানিকগঞ্জ-১, ৩; চাঁদপুর-৪, নওগাঁ-২, রাজশাহী-৪, ৬ আসনে নেতা-কর্মীদের গ্রেফতার-হয়রানি করা হচ্ছে। বিএনপির ওয়েবসাইট বন্ধ করার তীব্র নিন্দা জানিয়ে দলটির পক্ষ থেকে দ্রুত তা খুলে দেওয়ার জন্য সিইসির কাছে অনুরোধ করেছেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান।

সর্বশেষ খবর