আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি ভোট থেকে সরে দাঁড়াবে কিনা তা নিয়ে সংশয় কাজ করছে সরকারি দলে। সারা দেশে বিএনপি প্রার্থীরা এখনো আটঘাট বেঁধে নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণায় মাঠে নামেননি। এ কারণে তাদের ভোটের মাঠে শেষ পর্যন্ত থাকা না থাকার আলোচনা করছেন আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা এই ভোটে জোয়ার তুলেই আবারও ক্ষমতায় আসতে চান। ইতিমধ্যে এই গণজোয়ার সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করেন দলের নীতিনির্ধারক ফোরাম। এ কারণে তিনি নির্বাচনকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছেন। নির্বাচনী প্রচারকাজে দলের সর্বস্তরের নেতা-কর্মীকে মাঠে নামাতে সক্ষম হয়েছেন তিনি। দলের নেতা-কর্মীদের ‘ঐক্যবদ্ধতা’য় সর্বস্তরের ভোটার নৌকার প্রার্থীকে সমর্থন দেওয়ায় ফুরফুরে মেজাজে রয়েছে আওয়ামী লীগ। বিএনপি শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে থাকবে কি থাকবে না, এ নিয়ে খুব বেশি চিন্তা করছেন না আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বরং প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচনে জয়ী হয়ে আবারও প্রধানমন্ত্রীর মুকুট পরতে চান বঙ্গবন্ধুকন্যা। তবে ভোটের মাঠে শেষ পর্যন্ত থাকার পক্ষে ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতারা। গতকালও ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা ড. কামাল হোসেন ও বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর পৃথক স্থানে বলেছেন, যত প্রতিকূলতাই আসুক না কেন, ঐক্যফ্রন্ট ভোটের মাঠে শেষ পর্যন্ত থাকবে।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারক সূত্র জানান, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে হ্যাটট্রিক জয়ের লক্ষ্য নিয়েই মাঠে নেমেছেন ক্ষমতাসীন দলটির নেতা-কর্মীরা। নির্বাচনী মাঠ গোছাতে নেমেছেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গত বুধবার টুঙ্গিপাড়ায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদনের মধ্য দিয়ে তিনি আনুষ্ঠানিক নির্বাচনী প্রচার শুরু করেন। ওইদিন নিজ এলাকা কোটালিপাড়ায় নির্বাচনী সমাবেশে নৌকা মার্কায় ভোট চাওয়ার মধ্য দিয়ে নির্বাচনী যাত্রা শুরু করেন শেখ হাসিনা। বৃহস্পতিবার টুঙ্গিপাড়া থেকে ঢাকায় ফেরার পথে সাতটি নির্বাচনী সভায় যোগ দেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী। প্রতিটি নির্বাচনী সভায় তিনি সরকারের উন্নয়ন তুলে ধরার পাশাপাশি স্থানীয় দাবি পূরণের আশ্বাস দিচ্ছেন। টুঙ্গিপাড়া থেকে ঢাকার পথে পথে ছিল মানুষের ঢল। রাস্তার দুই পাশে হাজার হাজার নারী-পুরুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছিল চোখে পড়ার মতো।
জানা গেছে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলকে টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আনতে আটঘাট বেঁধেই মাঠে নেমেছে আওয়ামী লীগ। এজন্য এবার দলের মনোনয়ন দেওয়ার ক্ষেত্রে নির্বাচনে অভিজ্ঞদের বেছে নেওয়া হয়েছে। দলের ভিতরে যেসব ছোটখাটো সমস্যা ছিল তা ইতিমধ্যে মিটিয়ে ফেলা হয়েছে। এখন নৌকার প্রার্থীর পক্ষে ঐক্যবদ্ধ হয়ে মাঠে নেমেছেন সর্বস্তরের নেতা-কর্মী। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের টানা ১০ বছরের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড নির্বাচনী প্রচারে তুলে ধরা হচ্ছে। এ ছাড়া বিএনপি-জামায়াতের আগুনসন্ত্রাস-সহিংসতার চিত্রও দেশবাসীর সামনে তুলে ধরছেন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা। আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের নির্বাচনী প্রচারণায় ব্যাপক সাড়া মিলছে। অন্যদিকে বিএনপি প্রার্থী ও নেতা-কর্মীরা মাঠেই নেই। এখনো ঐক্যবদ্ধভাবে নেতা-কর্মীদের মাঠে নামাতে না পারায় ভোটের মাঠে সুবিধায় রয়েছেন সরকারি দলের প্রার্থীরা।রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার টানা ১০ বছরে রেকর্ড পরিমাণ উন্নয়ন করেছে, তা ধরে রাখতে হলে সরকারের ধারাবাহিকতা প্রয়োজন। অন্য কোনো সরকার গঠিত হলে দেশের চলমান উন্নয়নকাজ বন্ধ হয়ে যাবে। বর্তমান সরকারের সবচেয়ে বড় প্রকল্প পদ্মা সেতু। নিজস্ব অর্থায়নে এ সেতুর কাজ অর্ধেকের বেশি সম্পন্ন হয়েছে। মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ বেশকিছু মেগা প্রকল্পের কাজ প্রায় শেষের দিকে। এ ছাড়া হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের অত্যাধুনিক তৃতীয় টার্মিনাল প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে। এসব উন্নয়নকাজের গতি শ্লথ হয়ে যাবে যদি সরকারের ধারাবাহিকতা না থাকে। কারণ অতীতে এমন ঘটনার বহু নজির রয়েছে। সে কারণে সরকারের ধারাবাহিকতা প্রয়োজন।
এদিকে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের উন্নয়নকাজের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে সরকারের ধারাবাহিকতার ওপর জোর দিচ্ছেন। সে কারণে তিনি আবারও নৌকার প্রার্থীকে বিজয়ী করতে দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। জানা গেছে, নির্বাচনে জয় পেতে হলে ‘ঐক্যে’র ওপর জোর দিয়েছেন দলীয় সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেজন্য তিনি ছয় কেন্দ্রীয় নেতাকে বিশেষ দায়িত্ব দিয়েছেন। দলীয় প্রধান ও দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের তৎপরতার কারণে অন্য যে কোনো নির্বাচনের চেয়ে এবার দলের বিদ্রোহী প্রার্থীর সংখ্যা কম। ২৬০টি আসনের মধ্যে ১১ জন বিদ্রোহী প্রার্থী দলের প্রতিপক্ষ হয়েছেন। তবে শেষ পর্যন্ত তারা মাঠে থাকবেন না বলে আশা দলের নীতিনির্ধারকদের।
এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকার গত ১০ বছরে যে পরিমাণ উন্নয়ন করেছে, অতীতের কোনো সরকার তা করেনি। দেশের মানুষ উন্নয়নে, শান্তিতে বিশ্বাসী। সে কারণে সারা দেশে নৌকার পক্ষে গণজোয়ার সৃষ্টি হয়েছে। মানুষ আর জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসের মদদদানকারীদের ক্ষমতায় দেখতে চায় না। তারা উন্নয়নের রূপকার জননেত্রী শেখ হাসিনার মনোনীত প্রার্থীদের ভোট দিয়ে টানা তৃতীয়বারের মতো আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসাবে। আর চতুর্থবারের মতো বিজয়ের মুকুট পরবেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা।’
এদিকে ঢাকাসহ সারা দেশে বিএনপি এখনো ভোটের মাঠে নামতেই পারছে না। প্রচারণার শুরুর দিকে ঢাকার বাইরে কয়েকটি বড় শোডাউন দেখা গেলেও এখন চুপসে গেছেন প্রার্থীরা। নতুন করে ধরপাকড় শুরু হয়েছে। তবে কোনো কোনো প্রার্থী বলছেন, কৌশলী অবস্থান নিয়ে ভিন্নভাবে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন তারা। শোডাউন বাদ দিয়ে ঘরে ঘরে ধানের শীষের বার্তা নিয়ে যাচ্ছেন প্রার্থীরা। তবে গতকাল পর্যন্ত ঢাকায় বড় ধরনের কোনো শোডাউনে যায়নি বিএনপি। রাজধানীতে অপেক্ষাকৃত প্রার্থীও দুর্বল। একটি অংশ প্রচারণার চেষ্টা করলেও বড় একটি অংশ এখনো নীরব ভূমিকায় আছে। রাজধানীতে ধানের শীষের কোনো প্রার্থীর পোস্টারও চোখে পড়ে না।
সূত্রে জানা যায়, বিএনপি প্রার্থীদের মধ্যেও এখন সন্দেহ-অবিশ্বাস ঢুকে গেছে। ধানের শীষের একাধিক প্রার্থী বাংলাদেশ প্রতিদিনের কাছে জানতে চেয়েছেন, শেষ পর্যন্ত কি নির্বাচন হবে? বিএনপি কি শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে থাকবে, না বর্জন করবে? যেভাবে নেতা-কর্মীদের ওপর হামলা-জুলুম-নির্যাতন করা হচ্ছে তাতে এ নির্বাচনে থাকার কোনো যুক্তি নেই। অনেক প্রার্থীই এখনো বুঝে উঠতে পারছেন না কী করবেন তারা। তৃণমূল নেতা-কর্মীদের হামলা-মামলা কিংবা নির্বাচনী খরচ চালাতে আর্থিক সংকটেও পড়েছেন অধিকাংশ নতুন প্রার্থী। অবশ্য বিএনপির হাইকমান্ড বলছেন, শত প্রতিকূল পরিবেশেও বিএনপি নির্বাচনে থাকবে। ক্ষমতায় যাওয়াই বিএনপির উদ্দেশ্য নয়। গণতন্ত্র ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, খালেদা জিয়ার মুক্তিকেই তারা প্রাধান্য দিচ্ছেন। এজন্য হাইকমান্ড থেকে শেষ পর্যন্ত ভোটের মাঠে থাকতে নেতা-কর্মীদের দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ভোট কেন্দ্র পাহারা দিতেও বার্তা দেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে তৃণমূল নেতাদের কমিটি গঠনেরও নির্দেশনা দেওয়া হয়। এত কিছুর পরও নির্বাচনে থাকা-না থাকা নিয়ে সংশয় কাটেনি তৃণমূলে।
বিএনপির দায়িত্বশীল নেতারা জানান, তফসিল ঘোষণার পর পরিকল্পিতভাবে ধানের শীষের প্রার্থী ও কর্মী-সমর্থকদের ওপর হামলা-নির্যাতন চালানো হচ্ছে। এর উদ্দেশ্যও পরিষ্কার। সরকারি দল চায় না জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নির্বাচনে থাকুক। কিন্তু আমরা এবার সরকারকে খালি মাঠে গোল দিতে দেব না। পরিস্থিতি যাই হোক, ভোটের শেষ পর্যন্ত মাঠে থাকবে বিএনপি, ঐক্যফ্রন্ট ও ২০ দলের নেতা-কর্মীরা।
এ প্রসঙ্গে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘সারা দেশেই ধানের শীষ প্রতীকের প্রার্থীদের ওপর জুলুম-নির্যাতন চলছে। সরকার চায় বিএনপি শেষ পর্যন্ত নির্বাচনের মাঠে না থাকুক। কিন্তু সরকারকে বলতে চাই, জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট এবার ভোটের মাঠ ছাড়বে না। যত প্রতিকূল পরিবেশই আসুক না কেন, ভোটের মাঠে শেষ পর্যন্ত থাকব। আমাদের সামনে যে কঠিন চ্যালেঞ্জ রয়েছে তা মোকাবিলায় সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে।’