রবিবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

একাত্তরের বন্ধু ইন্দিরা গান্ধী

নিজস্ব প্রতিবেদক

একাত্তরের বন্ধু ইন্দিরা গান্ধী

বাংলাদেশ তখন পূর্ব পাকিস্তান। স্বাধীনতার স্বপ্নে বিভোর এ দেশের মানুষ। জীবন উৎসর্গ করে হলেও স্বাধীনতার নতুন সূর্য চাই। পশ্চিম পাকিস্তানের নিপীড়ন রুখে স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রস্তুতিকালে ভারতের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। বিশেষত ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের যুদ্ধ নিয়ে বিশ্ব মিডিয়ায় কী বলছেন, তা তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। পাকিস্তান তখন স্বাধীন রাষ্ট্র হওয়ায় এর ভিতরে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের করা যুদ্ধকে সব দেশ গৃহযুদ্ধ হিসেবে দেখতে চেয়েছে। কিন্তু ইন্দিরা গান্ধী ততদিনে পূর্ব পাকিস্তান নয়, পূর্ববাংলা বলে সম্বোধন করছিলেন। ২৫ মার্চ ঢাকায় গণহত্যার পর ২৭ মার্চ ভারতের লোকসভায় ভাষণ দিয়ে করণীয় তুলে ধরেন তিনি। ৩১ মার্চ বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধে সর্বাত্মক সহযোগিতার প্রস্তাব লোকসভায় উত্থাপন করলে সর্বসম্মতিক্রমে পাস হয়। মুজিবনগর সরকার গঠন হওয়ার পরপরই আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেন ইন্দিরা। বিশ্বের সব রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানের কাছে ভারত সরকারের পক্ষে প্রেরিত বার্তায় শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন রক্ষায় ও তার মুক্তির দাবিতে ইয়াহিয়া খানের ওপর চাপ সৃষ্টির আহ্বান জানান। বিশ্বব্যাপী তিনি মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে সোচ্চার ছিলেন। তবুও তার কণ্ঠে বাংলাদেশ শব্দটি শোনার অধীর আগ্রহ ছিল এদেশবাসীর। ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বরে নিজের বক্তব্য থেকে খুব সচেতনভাবে পূর্ববাংলা শব্দটি কেটে ফেলে বাংলাদেশকে প্রবেশ করান তিনি। ডিসেম্বরের ৬ তারিখ লোকসভার ভাষণে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেন। দিল্লির বুদ্ধিজীবী সম্মেলনে ভাষণ দিতে গিয়ে ইন্দিরা গান্ধী বলেন, বাংলাদেশ বিষয়েও ভারত সাহসের সঙ্গে মোকাবিলা করবে এবং সম্মানজনক সমাপ্তি ঘটবে। তিনি বিশ্বের ২০টি রাষ্ট্রপ্রধানের কাছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রাণরক্ষার জন্য প্রভাব খাটানোর আহ্বান জানান। জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল, বিশ্ব শান্তি পরিষদের মহাসচিবের কাছেও বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ নিয়ে ভারতের সমর্থনের কথা বলেন। ২৮ সেপ্টেম্বর ক্রেমলিনে সোভিয়েত নেতা ব্রেজনেভ, পদগর্নি ও কোসিগনের সঙ্গে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে ৬ ঘণ্টা আলোচনা করেন। এরপরই সোভিয়েত-ভারত যুক্ত ইশতেহার প্রকাশ পায়। বাংলাদেশ পরিস্থিতি ও শরণার্থী সমস্যা সম্পর্কে বিশ্ববাসীকে সর্বশেষ অবস্থা জানানোর উদ্দেশে ১৯ দিনের বিশ্ব সফরে বের হন ইন্দিরা গান্ধী। তিনি ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী অ্যাওয়ার্ড হিথের সঙ্গে বাংলাদেশ পরিস্থিতি সম্পর্কে ধারণা দেন। এরপর আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের সঙ্গে ১২৫ মিনিট বৈঠক করেন। এরপর তিনি ফ্রান্সে যান। ফরাসি প্রেসিডেন্টের দেওয়া ভোজসভায় তিনি বাংলাদেশে পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যার চিত্র তুলে ধরেন। নভেম্বরজুড়েই তিনি বাংলাদেশ প্রসঙ্গে বিশ্বনেতাদের কাছে ভারতের সমর্থনের কথা প্রচার করেন। ৬ ডিসেম্বর লোকসভায় ভাষণ দিতে গিয়ে বাংলাদেশকে ভারত কর্তৃক স্বীকৃতি প্রদানের কথা ঘোষণা করেন। দীর্ঘ নয় মাস বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামকে সফল করতে অর্থ, অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দিয়ে যে বিদেশি রাষ্ট্রনেতা সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন, তিনি ইন্দিরা গান্ধী। তখন শক্তিশালী আমেরিকা ও চীন ছিল পাকিস্তানের পক্ষে। মুক্তিযুদ্ধে পশ্চিম পাকিস্তানের বিপুলসংখ্যক অস্ত্রশস্ত্র আর বিশাল সেনাবাহিনী ছিল। বাংলাদেশের যুদ্ধ করতে চাওয়া মানুষগুলোকে ভারতে গেরিলা প্রশিক্ষণ প্রদানে ইন্দিরা গান্ধী সহায়তা করেন। তাদের সরবরাহ করেন অস্ত্র। রাশিয়াও এক্ষেত্রে সাহায্য করে তাকে। ইন্দিরা গান্ধী নিজের সৈন্যদের পাঠিয়ে দেন বাংলাদেশকে সাহায্য করতে। পাঠিয়েছেন বিমানশক্তি।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে রুখে দিতে পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী গণহত্যা শুরু করে। প্রাণভয়ে তখন বাংলাদেশিরা ছুটে যায় প্রতিবেশী দেশ ভারতে। পশ্চিম বাংলা, আসাম, ত্রিপুরায় আশ্রয় নেওয়া এই বাংলাদেশিদের ফিরিয়ে দেননি ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। ইন্দিরা গান্ধী মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন পুরো ৯ মাস প্রায় ১ কোটি বাংলাদেশি শরণার্থীকে সন্তানের মতো বুকে আগলে রাখেন। তখন ভারতের অর্থনীতিও খুব একটা আহামরি পর্যায়ে ছিল না। ইন্দিরা গান্ধীর ওপর বড় সব রাষ্ট্রের চাপ থাকলেও মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশের লাখ লাখ ঘরছাড়া মানুষকে অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থান দিতে রাজি হয়ে যান তিনি। তিনি ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রতিদিন কোনো না কোনোভাবে বাংলাদেশের পক্ষে ভূমিকা রেখেছেন। তার এই ভূমিকার মধ্যে কূটনৈতিক ভূমিকা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ তখন যদি রাশিয়াকে সঙ্গে নিয়ে মার্কিন নৌবাহিনীর সপ্তম রণতরীর আগমন না ঠেকানো হতো তাহলে ইতিহাস অন্যরকমও হয়ে যেতে পারত।

তার এই মহান কাজের স্বীকৃতি দিতেই বাংলাদেশ সরকার ২০১১ সালে মুক্তিযুদ্ধের ৪০তম বছরে ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে রাষ্ট্রীয় সম্মাননায় ভূষিত করে। ইন্দিরা গান্ধীকে ভূষিত করা হয় বাংলাদেশ স্বাধীনতা সম্মাননা পদকে (মরণোত্তর)। ওই বছরের ২৫ জুলাই ইন্দিরা গান্ধীর পুত্রবধূ সোনিয়া গান্ধীর হাতে তুলে দেওয়া হয় এ সম্মাননা। এটি ছিল বাংলাদেশের পক্ষ থেকে প্রথমবারের মতো কোনো বিদেশির অর্জন করা সর্বোচ্চ সম্মাননা।

সর্বশেষ খবর