সোমবার, ১৭ ডিসেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা
শ্রদ্ধা ভালোবাসায় বিজয় দিবস উদযাপন

স্বাধীনতাবিরোধীদের প্রতিহত করে সমৃদ্ধির পথে থাকার ঘোষণা

নাজমুল হুদা, সাভার ও শরিফুল ইসলাম সীমান্ত, জাবি প্রতিনিধি

স্বাধীনতাবিরোধীদের প্রতিহত করে সমৃদ্ধির পথে থাকার ঘোষণা

সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে গতকাল জনতার ঢল —রোহেত রাজীব

লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত মহান বিজয়ের ৪৭তম দিবসে গতকাল স্বাধীনতাবিরোধীদের প্রতিহত করে সমৃদ্ধির পথে থাকার অঙ্গীকার নিয়ে জাতি স্মরণ করেছে তার শ্রেষ্ঠ সন্তানদের। গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সংগঠন উদ্যাপন করেছে মহান বিজয় দিবস। অগ্নিসন্ত্রাস, সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গিবাদ রুখে দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষশক্তির হাত ধরে বাংলাদেশের উন্নয়ন অভিযাত্রা অব্যাহত রাখার প্রত্যয়ে দেশজুড়ে সব স্মৃতিসৌধে ছিল লাখো মানুষের ঢল। বর্ণিল শোভাযাত্রা জুড়ে ছিল ‘জয় বাংলা’ স্লোগান আর বিজয়ের গান। রাস্তাঘাট, বাসাবাড়ি, অফিস-আদালত, দোকানপাট সবখানেই ছিল জাতীয় পতাকার লাল-সবুজের উৎসব। তরুণ-তরুণীদের গালে-কপালেও রংতুলির আঁচড়ে স্থান পেয়েছে জাতীয় পতাকা। পোশাকেও ছিল লাল-সবুজের সরব উপস্থিতি। বাতাসে ছিল মুক্তিযুদ্ধ ও দেশাত্মবোধক গানের কথা। অলিগলিতে ছিল বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের সেই কালজয়ী ভাষণ— ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’

জাতীয় স্মৃতিসৌধে লাখো মানুষের ঢল : গতকাল জাতীয় স্মৃতিসৌধে লাখো মানুষের ঢল নেমেছিল। সকাল    ৬টা ৪২ মিনিটে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী জাতীয় স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়ে একাত্তরের বীর শহীদদের শ্রদ্ধা জানান। ৩১বার তোপধ্বনির মধ্য দিয়ে শুরু হয় মহান দিবসের কর্মসূচি। এ সময় বিউগলে বেজে ওঠে করুণ সুর। তিন বাহিনীর সুসজ্জিত একটি চৌকস দল গার্ড অব অনার প্রদান করে। এ সময় মন্ত্রিপরিষদ সদস্য, বিচারপতি, তিন বাহিনীর প্রধান, কূটনীতিকসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। পরে প্রধানমন্ত্রী দলীয় প্রধান হিসেবে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে শহীদবেদিতে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করে শ্রদ্ধা জানান। এ সময় আওয়ামী লীগ নেতা জাহাঙ্গীর কবির নানক, মুকুল বোস, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, আওয়ামী লীগ নেতা আবদুর রহমান, বি এম মোজাম্মেল, মেসবাহ উদ্দিন সিরাজ, হাবিবুর রহমান সিরাজ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। বরাবরের মতোই দিনটিকে রাষ্ট্রীয়ভাবে উদ্যাপন করা হয় জাতীয় দিবস হিসেবে। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী স্মৃতিসৌধ ত্যাগ করার পর মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, বিদেশি কূটনীতিক, বিভিন্ন রাজনৈতিক-সামাজিক সংগঠনসহ সর্বস্তরের মানুষ শ্রদ্ধা নিবেদন করে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নুরুল হুদা অন্য কমিশনারদের সঙ্গে নিয়ে স্মৃতিসৌধের বেদিতে ফুল দিয়ে একাত্তরের শহীদদের শ্রদ্ধা জানান। সকাল সোয়া ৯টার দিকে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দলীয় নেতাদের নিয়ে স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এ সময় তিনি বলেন, ‘নির্বাচনের জন্য সুষ্ঠু পরিবেশ চেয়েছিলাম, তা এখনো পাইনি।’ তার সঙ্গে স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান, বিএনপি নেতা এ জেড এম জাহিদ হোসেন, অ্যাডভোকেট আজম খান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের আহ্বায়ক ড. কামাল হোসেন স্মৃতিসৌধে শহীদদের ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এ সময় তিনি বলেন, ‘বিজয়ের মাসে জবরদস্তি, লাঠিয়াল বাহিনী, কালো টাকার ব্যবহার মেনে নেওয়া যায় না।’ তার সঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান, ঐক্যফ্রন্ট নেতা আ স ম আবদুর রবসহ কেন্দ্রীয় নেতারা উপস্থিত ছিলেন।

এর আগে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দলের সদস্যসহ নানা বয়সের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ মহান বিজয় দিবসের বিভিন্ন ব্যানার-ফেস্টুন ও ফুল নিয়ে সৌধপ্রাঙ্গণের বাইরে অপেক্ষমাণ থাকেন। সাধারণের প্রবেশ উন্মুক্ত করার পর থেকেই মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান জাতীয় স্মৃতিসৌধে মহান বীর শহীদদের প্রতি গভীর বিনম্র শ্রদ্ধা নিবেদন করে। যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা থেকে শুরু করে এ প্রজন্মের তরুণ, যুবক, ছাত্র-শিক্ষকসহ হাজারো মানুষ জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা জানায়। দিনের শুরু থেকেই জাতীয় স্মৃতিসৌধে পদচারণ ছিল লাখো দেশপ্রেমিক নারী-পুরুষের। মহান বীরদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছেন আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, ন্যাপ, জাসদ, বাসদ, প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক পার্টি, কমিউনিস্ট পার্টি, সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, সোশ্যাল ইনভেস্টমেন্ট ইসলামী ব্যাংক, নজরুল ইনস্টিটিউট, সাভার গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র, বঙ্গবন্ধু পরিষদ, যুব মৈত্রী, গণতান্ত্রিক মজদুর পার্টি, চাঁপাইনবাবগঞ্জ সমিতি, পল্লী উন্নয়ন বোর্ড, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টি, রূপালী ব্যাংক, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি, সাভার প্রেস ক্লাব, ন্যাপ ভাসানী, আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান, উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী, গ্রামীণফোন, বাংলাদেশ ছাত্র আন্দোলন, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি, বাংলাদেশ কৃষক লীগ, প্রজন্ম-৭১, মুক্তিযোদ্ধা সন্তান কমান্ড, বিকল্পধারা বাংলাদেশ, মহিলা দল, বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রী, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট, ঢাকা সাব-এডিটরস ফোরাম, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যান্ড শ্রমিক শিল্প ফেডারেশন, বাংলাদেশ আইন ছাত্র পরিষদ, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, ছাত্র ইউনিয়ন, সড়ক ও জনপথ অধিদফতর, ঊষা সংঘ সাভার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও এর বিভিন্ন হল, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও বিভিন্ন হল, মুক্তিযোদ্ধা যুব কমান্ড, আওয়ামী যুবলীগ, বিআইডব্লিউটিসি, জাতীয় জাদুঘর, প্রশিকা, জাতীয় ঐক্যবদ্ধ নাগরিক আন্দোলন, ঢাকা অফিসার্স ক্লাব, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, সাভার ল্যাবরেটরি কলেজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি, গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন, নাগরিক সংহতি, কেন্দ্রীয় খেলাঘর আসর, ফেডারেশন অব এনজিও অ্যাসোসিয়েশেন, বাংলাদেশ খ্রিস্টান অ্যাসোসিয়েশন, নজরুল ইনস্টিটিউট, গারো আদিবাসী, অনার্স অ্যাসোসিয়েশন, সোনার বাংলা পার্টি, বন্ধন সামাজিক উন্নয়ন সংস্থা, জাকের পার্টি সাভার, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, বঙ্গবন্ধু কৃষিবিদ পরিষদ, ইনস্টিটিউট অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স, স্বাধীন বাংলা গার্মেন্টস কর্মচারী ফেডারেশন, কর্মজীবী নারী, ছাত্র ঐক্য ফোরাম, বাংলা একাডেমি, ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন, আশুলিয়া প্রেস ক্লাবসহ অসংখ্য সংগঠন।

রাষ্ট্রপতির সংবর্ধনায় প্রধানমন্ত্রী : রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও তাঁর স্ত্রী রাশিদা খানম গতকাল বিকালে বিজয় দিবস উপলক্ষে বঙ্গভবনে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাষ্ট্রপতির সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যোগ দেন। বেলা ৩টা থেকে বিকাল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত বঙ্গভবনের সবুজ লনে এ সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার কয়েক হাজার অতিথি উপস্থিত ছিলেন। জাতীয় সংগীত পরিবেশনের পর রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ও তাঁর সহধর্মিণী রাশিদা খানম এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অতিথিদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন। বাসস জানায়, প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, সাবেক রাষ্ট্রপতি বিকল্পধারা বাংলাদেশের চেয়ারম্যান এ কিউ এম বদরুদ্দোজ্জা চৌধুরী, মন্ত্রিপরিষদ সদস্য, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা, সুপ্রিম কোর্টের বিচারক, সংসদ সদস্য, বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত ও হাইকমিশনাররা এ সময় উপস্থিত ছিলেন। এ ছাড়া গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা জাফরুল্লাহ চৌধুরী, জ্যেষ্ঠ আইনজীবী, তিন বাহিনীর প্রধান, সিনিয়র রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, সম্পাদক, সাংবাদিক নেতৃবৃন্দ, বীরশ্রেষ্ঠদের পরিবার, শিল্পী, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, বেসামরিক ও সামরিক কর্মকর্তা, শিক্ষাবিদ, ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দ ও বিশিষ্ট নাগরিকরা সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যোগদান করেন। এ সময় রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী বিজয় দিবসের কেক কাটেন।

সেনা ও নৌবাহিনীতে অনারারি কমিশন প্রদান : আন্তবাহিনী জনসংযোগ পরিদফতর (আইএসপিআর) জানায়, সরকার মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে ৩৩ জনকে অনারারি ক্যাপ্টেন, ৫৭ জনকে অনারারি লেফটেন্যান্ট ও নৌবাহিনীতে ২০ জনকে মাস্টার চিফ পেটি অফিসার (এমসিপিও) পদে পদোন্নতি প্রদানপূর্বক অনারারি কমিশন প্রদান করেছে। এ পদোন্নতি ১৬ ডিসেম্বর, ২০১৮ থেকে কার্যকর হবে।

বিজয় দিবস উপলক্ষে রাজধানীর সরকারি-বেসরকারি ভবন ও গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা কয়েকদিন আগে থেকেই আলোকসজ্জায় সজ্জিত করা হয়। ডাক বিভাগ স্মারক ডাকটিকিট অবমুক্ত করে। ঢাকা ও দেশের বিভিন্ন শহরের প্রধান সড়ক ও সড়কদ্বীপ জাতীয় পতাকা ও অন্যান্য পতাকায় সাজানো হয়েছে। দিবসের তাৎপর্য তুলে ধরে সংবাদপত্রগুলো প্রকাশ করেছে বিশেষ ক্রোড়পত্র। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, বাংলা একাডেমি, জাতীয় জাদুঘর, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, বাংলাদেশ শিশু একাডেমিসহ বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, শিশুদের চিত্রাঙ্কন, রচনা ও ক্রীড়া প্রতিযোগিতা এবং মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শনের আয়োজন করেছে। এতিমখানা, বৃদ্ধাশ্রম, হাসপাতাল, জেলখানা, সরকারি শিশুসদনসহ ওই ধরনের প্রতিষ্ঠানে এদিন উন্নতমানের খাবার পরিবেশন করা হয়।

সর্বশেষ খবর