মঙ্গলবার, ২৫ ডিসেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

সংঘাতের আশঙ্কায় কঠোর নিরাপত্তা

সেনা টহল শুরু, সতর্ক নির্বাচন কমিশন, জিরো টলারেন্সে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা

সাখাওয়াত কাওসার ও গোলাম রাব্বানী

সংঘাতের আশঙ্কায় কঠোর নিরাপত্তা

নারায়ণগঞ্জে গতকাল সেনাবাহিনীর সদস্যদের টহল —বাংলাদেশ প্রতিদিন

সংঘাত-সহিংসতা রুখতে সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ভোটের মাঠে টহল দিচ্ছে সেনাবাহিনী। ইতিপূর্বে মোতায়েন করা হয়েছে এক হাজার ১৬ প্লাটুন বিজিবি (বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ)। সতর্ক অবস্থানে রয়েছে নির্বাচন কমিশন। কমিশনের নির্দেশনা অনুসারে আগে থেকেই মাঠ চষে বেড়াচ্ছে এলিট ফোর্স র‌্যাব, পুলিশ এবং আনসার বাহিনীর সদস্যরা। সব মিলিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রায় ৬ লাখ সদস্য সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্ব পালন করছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যে কোনো মূল্যে সুষ্ঠু নির্বাচন এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে সরকার বদ্ধপরিকর। নির্বাচনকে সামনে রেখে অবৈধ অস্ত্র, গোলাবারুদ, মাদক ও মানব পাচার ঠেকাতে সীমান্ত এলাকাগুলো রয়েছে বিশেষ নজরদারিতে।

নির্বাচনে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা মাঠে নামায় ভোটারদের আস্থা বাড়বে বলে মনে করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদা। তিনি বলেন, সেনাবাহিনী মোতায়েনের উদ্দেশ্যই হলো— ভোটারদের মনে আস্থা তৈরি করা। সেনাবাহিনী মোতায়েনের ফলে ভোটারদের মনে আস্থা বাড়বে। সংঘাত পরিহার করতে দলগুলোর প্রতি অনুরোধ জানান তিনি। সিইসি বলেন, এ সুযোগে আমি সব রাজনৈতিক দলের কাছে বিনীতভাবে অনুরোধ করি— নির্বাচন যেন নির্বাচনের মতো হয়। সহিংসতা, নিজেদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি, তর্ক-বিতর্ক, হাঙ্গামা পরিহার করে কেবল মাত্র নির্বাচনী প্রচারণার মাধ্যমে নির্বাচনে নিবদ্ধ থাকার জন্য অনুরোধ করি।

জানা গেছে, তফসিল ঘোষণার পর গত দেড় মাসে নির্বাচনের নিরাপত্তা আয়োজন নিয়ে বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করেছে নির্বাচন কমিশন। এর বাইরে নিরাপত্তা নিশ্ছিদ্র করতে প্রত্যেকটি সংস্থা তাদের নিজেদের মধ্যে বৈঠক করে কর্মকৌশল ঠিক করে। গত ১৪ ডিসেম্বর ৩০ জেলাকে ঝুঁকিপূর্ণ চিহ্নিত করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশ প্রধানের নেতৃত্বে শীর্ষ পুলিশ কর্মকর্তাদের নিয়ে ১৪ সদস্যের একটি কমিটি করেছে পুলিশ সদর দফতর। আইজিপি জাবেদ পাটোয়ারীকে সভাপতি করে গঠিত এই কমিটিতে অতিরিক্ত আইজিপি (প্রশাসন) মোখলেসুর রহমানকে সহসভাপতি ও ডিআইজি (অপারেশন) আনোয়ার হোসেনকে সদস্য সচিব করা হয়েছে। অতিরিক্ত আইজিপি (অর্থ) মইনুর রহমান চৌধুরী, অতিরিক্ত আইজিপি (টিঅ্যান্ডআইএম) ইকবাল বাহার ও এআইজি (অপারেশন) সাইদ তারিক হাসান সদস্য হিসেবে রয়েছেন। এর আগের দিন সব কটি রেঞ্জের ডিআইজি, সব পুলিশ কমিশনার ও ৬৪ জেলার পুলিশ সুপারদের নিয়ে পুলিশ সদর দফতরে একটি বিশেষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।

এর আগে গত ১১ নভেম্বর সারা দেশকে চারটি বৃহত্তর অঞ্চলে ভাগ করে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে মনিটরিং সেল ও কো-অর্ডিনেশন কমিটি করে দায়িত্ব দেওয়া হয় পুলিশের আট কর্মকর্তাকে। র‌্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ এবং হাইওয়ে রেঞ্জের ডিআইজি আতিকুল ইসলাম রাজশাহী ও রংপুর মহানগর এবং রেঞ্জের দায়িত্ব পালন করবেন। ঢাকা ও গাজীপুর মহানগর এবং ঢাকা এবং ময়মনসিংহ রেঞ্জ দেখবেন ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া ও স্পেশাল অ্যাকশন গ্রুপের উপকমিশনার প্রলয় কুমার জোয়ারদার। খুলনা ও বরিশাল মহানগর এবং রেঞ্জ পর্যবেক্ষণের দায়িত্ব পেয়েছেন এসবির অতিরিক্ত আইজিপি মীর শহীদুল ইসলাম ও ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার ও কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম। চট্টগ্রাম ও সিলেট মহানগর এবং রেঞ্জের তদারক করবেন অতিরিক্ত আইজিপি মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম ও পুলিশ সদর দফতরের ডিআইজি (প্রশাসন) হাবিবুর রহমান।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, যে কোনো ধরনের সহিংসতা প্রতিরোধ করতে তারা জোরদার অভিযান চালাবে। প্রয়োজনে র‌্যাব ও বিজিবি সদস্যদেরও অভিযানে ডাকবেন তারা। সহিংসতা প্রতিরোধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পন্ন করতে আমরা সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালাচ্ছি। সব দলের প্রার্থীদের নিরাপত্তা দেওয়া হচ্ছে। অপরাধীদের ধরতে আরও অভিযান জোরালো করা হচ্ছে।

গোয়েন্দা সূত্র বলছে, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার স্বার্থে যৌথ অভিযান চালাবে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা। বিশেষ নজরে থাকবে ঝুঁকিপূর্ণ ৩০ জেলা। তবে পোলিং এজেন্টদের তালিকা সংগ্রহ করে তাদের বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করছে পুলিশ।

পুলিশ সদর দফতরের সহকারী পুলিশ মহাপরিদর্শক সোহেল রানা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নির্বিঘ্ন রাখতে প্রয়োজনীয় সব ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছে বাংলাদেশ পুলিশ। গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে দেশের বিভিন্ন এলাকার কেন্দ্রের প্রকৃতি অনুসারে সাজানো হয়েছে নিরাপত্তা আয়োজন। যে কোনো ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলায় রাখা হয়েছে মোবাইল টিম, স্ট্রাইকিং ফোর্স এবং কুইক রেসপন্স টিম। নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনা অনুযায়ী অন্যান্য বাহিনীগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করেই নিরাপত্তা নিশ্চিতে কাজ করবে পুলিশ।

এদিকে গত রবিবার রাত ১২টা থেকেই টহলে নেমেছে সেনাবাহিনী। এদের মধ্যে জলপাই রঙের ইউনিফর্ম পরিহিত এই বাহিনীর সদস্যদের দেখা গেছে দেশের বিভিন্ন এলাকায়। আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদফতর (আইএসপিআর) জানিয়েছে, স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে ৪০৭ উপজেলায় স্বশস্ত্র বাহিনী দায়িত্ব পালন করবে। এর মধ্যে ৩৮৯ উপজেলায় সেনাবাহিনী এবং ১৮ উপজেলায় নৌবাহিনী টহল দেবে। প্রতি জেলায় এক ব্যাটালিয়ন করে ৩০ হাজারেরও বেশি সশস্ত্র বাহিনী দায়িত্বে থাকবে। তারা ২৪ ডিসেম্বর থেকে ২ জানুয়ারি পর্যন্ত মাঠে থাকবে। জানা গেছে, রবিবার বিকাল থেকেই সেনা সদস্যরা অস্থায়ী ক্যাম্পে পৌঁছাতে শুরু করেছেন। নির্বাচনে ‘ইন এইড টু দ্য সিভিল পাওয়ার’ অনুযায়ী কাজ করবেন সশস্ত্র বাহিনীর এই সদস্যরা। তারা জেলা/উপজেলা/মহানগর এলাকার সংযোগস্থলে ও অন্যান্য সুবিধাজনক স্থানে অবস্থান করবেন। তারা নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তার সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে প্রয়োজন অনুযায়ী টহল ও অন্যান্য আভিযানিক কার্যক্রমে অংশ নিতে পারবেন।

বিজিবি সূত্র বলছে, ইতিমধ্যে দেশব্যাপী এক হাজার ১৬ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। তারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় কাজ করছে। এর মধ্যে ঢাকায় থাকছে ৫০ প্লাটুন। আগামী ২ জানুয়ারি পর্যন্ত মাঠে থাকার কথা রয়েছে বিজিবি সদস্যদের।

এদিকে প্রায় ১০ হাজার সদস্যের বাহিনী এলিট ফোর্স র‌্যাবের প্রস্তুতি সম্পর্কে র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহ্মুদ খান বলেন, নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনা অনুসারে সার্বিক প্রস্তুতি নিয়েছে র‌্যাব। এরই মধ্যে র‌্যাব ট্রেনিং স্কুলে বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ এবং মহড়া করেছে র‌্যাব সদস্যরা। অন্যসব বাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় করেই দায়িত্ব পালন করবেন র‌্যাব সদস্যরা। সার্বক্ষণিকভাবে প্রস্তুত রাখা হয়েছে হেলিকপ্টার। র‌্যাব সদর দফতরের বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিটকে কয়েকটি ভাগ করে বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় রাখা হয়েছে।

আমাদের ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিনিধি জানিয়েছেন, জেলার ৪৪ কিলোমিটার সীমান্তে সিল করে দিয়েছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। ব্রাহ্মণবাড়িয়া সীমান্ত এলাকার বিপরীতে ওপারের ভারতের ত্রিপুরা সীমান্তে টহল জোরদার করেছে বিএসএফ। সীমান্তে বাড়তি নজরদারির পাশাপশি গোয়েন্দা তৎপরতাও বাড়ানো হয়েছে। তবে এই বিশেষ নজরদারির কারণে আখাউড়া চেকপোস্ট দিয়ে বৈধপথে যাতায়াতকারী যাত্রীদের কোনো সমস্যা হবে না বলে জানান কাস্টমস ও ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ।

বিজিবি ২৫ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল মুহাম্মদ গোলাম কবীর বলেন, অবৈধ অস্ত্র, গোলাবারুদ, মাদক ও মানব পাচার ঠেকাতেই নির্বাচনী সময়ে এই বিশেষ নজরদারি। অন্যান্য সময়ে সীমান্তে নজরদারি থাকলেও নির্বাচনী সময়ে বিশৃঙ্খলা রোধে সীমান্তে কড়া নজরদারির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, এ বিষয়ে বিএসএফের সহায়তাও চাওয়া হয়েছে। বিএসএফ-বিজিবি যৌথভাবেই টহল জোরদার করেছে নিজ নিজ সীমান্তে।

সর্তক নির্বাচন কমিশন : একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে জিরো টলারেন্স চায় নির্বাচন কমিশন (ইসি)। নির্বাচন কমিশন সতর্ক অবস্থায় রয়েছে। নির্বাচনী পরিবেশ নিয়ন্ত্রণে পুলিশ, র‌্যাব ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সমন্বয়ে তিন স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা রাখার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া টহলে রয়েছেন বিজিবির সদস্যরা। গতকাল থেকে স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে মাঠে রয়েছেন সেনাবাহিনীর সদস্যরা। তারা থাকবেন ২ জানুয়ারি পর্যন্ত। বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা, রিটার্নিং কর্মকর্তা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতিবেদন এবং সার্বিক দিক লক্ষ্য রেখে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইসি।

এদিকে সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে প্রশাসন ক্যাডারের ৬৩৭ জন কর্মকর্তাকে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার ক্ষমতা দিয়ে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে সরকার। তারা নির্বাচনী এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষার পাশাপাশি বিভিন্ন অপরাধ প্রতিরোধ এবং নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন সংক্রান্ত অপরাধ প্রতিরোধে দায়িত্ব পালন করবেন। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় গতকাল এক আদেশে জানিয়েছে, এই নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা দেশের বিভিন্ন নির্বাচনী এলাকায় ২৮ থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করবেন। নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা জানিয়েছে, নির্বাচনে সাধারণ এলাকার ভোটকেন্দ্রের পাহারায় একজন পুলিশসহ ১৪ জন সদস্য, মেট্রোপলিটন এলাকার ভোটকেন্দ্রে তিনজন পুলিশসহ ১৫ জন এবং দুর্গম ও উপকূলীয় এলাকার ভোটকেন্দ্রে দুজন পুলিশসহ ১৪ জন সদস্য মোতায়েনের পরিকল্পনা রয়েছে ইসির। র‌্যাব, বিজিবি, কোস্টগার্ড ও আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের সদস্যরা মোবাইল ও স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে টহলে থাকবেন।

সর্বশেষ খবর