সোমবার, ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

নির্বাচনী সহিংসতায় নিহত ১৮ অধিকাংশই আওয়ামী লীগের

নিজস্ব প্রতিবেদক

গতকাল সারা দেশে ভোটের সহিংসতায় প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ১৮ জন। এ ছাড়া আহত হয়েছে দুই শতাধিক নেতা-কর্মী। ভোটের আগে ও ভোট চলাকালে কেন্দ্র দখল, আধিপত্য বিস্তার, ব্যালট পেপার ছিনতাই ঘটনাকে কেন্দ্র করে সৃষ্টি সংঘর্ষে এই হতাহতের ঘটনাগুলো ঘটে। সংঘর্ষে ব্যাপক ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, বোমা বিস্ফোরণসহ গোলাগুলি হয়। এতে চট্টগ্রামে একজন শিক্ষার্থীসহ তিনজন, কুমিল্লায় দুজন এবং লক্ষ্মীপুর, নাটোর, রাঙামাটি, রাজশাহী, কক্সবাজার, নরসিংদী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিলেট, নোয়াখালী, বগুড়া, গাজীপুর ও লালমনিরহাটে একজন করে নিহত হয়েছেন। এই ১৪ জেলা ছাড়াও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে চাঁদপুর, নোয়াখালী, দিনাজপুর, ঝিনাইদহ ও গাইবান্ধায়। এতে দুজন জুুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট হামলার শিকার হন। পুলিশের গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয় হামলাকারীরা। যশোর-৩ এবং ঢাকা-৪ আসনের বিএনপি প্রার্থীর ওপর হামলার ঘটনা ঘটে।

নিহতদের মধ্যে সাধারণ ভোটার যেমন আছেন, তেমনি আছেন আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয়পার্টি ও ইসলামী ছাত্রসেনার কর্মীও। এদের মধ্যে আটজন আওয়ামী লীগ, দুজন বিএনপি, একজন জাতীয়পার্টির নেতা-কর্মী রয়েছেন। একজন সাধারণ ভোটার ও আনসার বাহিনীর এক সদস্যও রয়েছেন নিহতদের এই তালিকায়। আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর-

চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার কাথারিয়া ইউনিয়নের বরইতলির প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে দুই পক্ষের সংঘর্ষে আহমেদ কবীর (৪৫) নামে একজন ব্যক্তি গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন। ভোটের দিন ভোরে স্থানীয় দুই গ্রুপের মধ্যে এই সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। নিহত আহমেদ কবীর কাথারিয়া ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা। এদিকে পটিয়ার জিরি ইউনিয়নের দক্ষিণ মালিয়ারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্র দখল নিয়ে বেলা ১১টায় দুই পক্ষের সংঘর্ষে আবু সাদেক (১৮) নামের একজন নিহত ও দুজন গুলিবিদ্ধ হন। আহতরা হলেন মো. মুন্না (২৮) ও মো. ইলিয়াস (৪০)। এর আগে চট্টগ্রাম-১২ আসনের পটিয়া এলাকায় দ্বীন মোহাম্মদ (৩৫) নামে এক যুবলীগ কর্মীকে কুপিয়ে খুন করা হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। ভোটের আগের রাতে পটিয়া উপজেলার কুসুমপুর ইউনিয়নে এই ঘটনা ঘটে।

কুমিল্লার নাঙ্গলকোট ও চান্দিনায় নির্বাচনী সহিংসতায় দুজন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, নাঙলকোটে মুরগাও ভোটকেন্দ্রে প্রবেশের পথে বাচ্চু মিয়া (৪৫) নামে এক ভোটারকে মারধর করে কিছু দুর্বৃত্ত। পরে হাসপাতালে নেওয়ার পথে তিনি মারা যান। স্থানীয়রা জানান, তিনি বিএনপি সমর্থক। চান্দিনায় পশ্চিম বেলাসার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কেন্দ্রে পুলিশের গুলিতে একজন নিহত হন। পশ্চিম বেলাসারের প্রিসাইডিং অফিসার হুমায়ুন কবির দাবি করেন, ‘কেন্দ্র থেকে ভোটের বাক্স ছিনতাই করে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে পুলিশের গুলিতে একজন নিহত হয়।’ নিহত ব্যক্তির নাম মুজিব (৩৫)। তার বাবার নাম সুজাদ আলী। রাজশাহী-৩ আসনের মনপুর উপজেলায় বাকুড়িয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। এ ঘটনায় মেরাজ আলী (৩২) নামে এক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। ভোটের সকালেই এ ঘটনা ঘটে। রাজশাহী জেলা পুলিশের মুখপাত্র এবং সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার আবদুর রাজ্জাক ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে বলেছেন, নিহত মেরাজ আওয়ামী লীগের কর্মী ছিলেন। তবে বিএনপির দাবি, মেরাজ তাদের দলীয় কর্মী ছিল।

টাঙ্গাইলে বিএনপি নেতা আজিজের লাশ উদ্ধার করা হয়। স্থানীয়রা জানান, সকালে স্থানীয় লোকজন নগদা শিমলা বাইশখাইল এলাকায় আবদুল আজিজের লাশ পড়ে থাকতে দেখে পুলিশে খবর দেয়। পরে পুলিশ গিয়ে তার লাশটি উদ্ধার করে। জেলা বিএনপির সভাপতি ও এই আসনের প্রার্থী সুলতাল সালাউদ্দিন টুকুর বড় ভাই কৃষিবিদ শামছুল আলম তোফা অভিযোগ করেন, ‘সকালে ওয়ার্ড বিএনপির সহ-সভাপতি আবদুল আজিজ ভোটার লিস্ট নিয়ে কেন্দ্রে যাওয়ার সময় নৌকার সমর্থকরা তাকে হত্যা করে লাশ ধানখেতে ফেলে রাখে। কক্সবাজারের পেকুয়া উপজেলায় আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সমর্থকদের সংঘর্ষে এক যুবলীগকর্মী নিহত হয়েছেন। নিহতের নাম আবদুল্লাহ আল ফারুক। তিনি রাজাক আলী গ্রামের আবুল কালামের ছেলে। রাঙামাটির কাউখালী উপজেলায় ঘাগড়া ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে সংঘর্ষে ইউনিয়ন যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক বাছির উদ্দিন (৩৫) নিহত হন। এই ঘটনায় আহত হয়েছেন ১০ জন। ভোটগ্রহণ শুরুর আগে এই সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।

নরসিংদী-৩ আসনের শিবপুরে মিলন মিয়া (৪৫) নামে আওয়ামী লীগের এক নির্বাচনী এজেন্টকে গলা কেটে হত্যা করা হয়েছে। দুপুর ১২টার দিকে নরসিংদী-৩ শিবপুর কুন্দারপাড়া কেন্দ্রের অদূরে এ হত্যার ঘটনা ঘটে। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন শিবপুর থানার ওসি আবুল কালাম আজাদ। তিনি জানান, ‘রবিবার দুপুর ১২টার দিকে নরসিংদী-৩ শিবপুর কুন্দারপাড়ার ভোট কেন্দ্রের অদূরে গ-গোল দেখা দিলে পুলিশ সেখানে গিয়ে মো. মিলন মিয়ার (৪৫) গলাকাটা লাশ পড়ে থাকতে দেখে। নাটোরে ধানের শীষে ভোট দেওয়াকে কেন্দ্র করে ভাতিজার হাতে চাচা খুন হওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। নিহতের নাম হোসেন আলি (৫০) এবং তার ভাতিজার নাম রতন (৩০)। নিহত হোসেন আলি বিপ্রবেলঘরিয়া ইউনিয়নের দুই নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সদস্য বলে নিশ্চিত করেছেন ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মোসাদ্দেকুল ইসলাম বাদশা। বগুড়া-৪ (কাহালু-নন্দীগ্রাম) আসনের কাহালু উপজেলার পাইকড় ইউনিয়নের বাগইল গ্রামে আজিজুল ইসলাম (৩০) নামে এক আওয়ামী লীগ কর্মী নিহত এবং নাজমুল হুদা ডুয়েল নামে এক ইউপি সদস্য আহত হয়েছেন। বগুড়ার কাহালু থানার ওসি শওকত কবির ও পাইকড় ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মিঠু চৌধুরী এই খবর নিশ্চিত করেছেন। ধানের শীষের কর্মীদের হামলায় হতাহতের এই ঘটনা ঘটেছে বলে দাবি করেছেন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা। নোয়াখালী-৩ (বেগমগঞ্জ) আসনের বেগমগঞ্জ উপজেলার গোপালপুর ইউনিয়নের তুলারাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সংঘর্ষে কর্তব্যরত আনসার সদস্য নুরন্নবী গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। গাজীপুর মহানগরের কাজী আজিমউদ্দিন ডিগ্রি কলেজ ছাত্রলীগের সাবেক ভিপি লিয়াকত হোসেনকে (৪০) কুপিয়ে হত্যার অভিযোগ উঠেছে। ভোটের দিন দুপুর পৌনে ৩টার দিকে মহানগরীর হাড়িনাল এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। লালমনিরহাট-৩ আসনের (সদর) রাজপুর ইউনিয়নের পাগলারহাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়কেন্দ্রে ভোট দিতে যাওয়ার পথে তোজাম্মেল হোসেন (৬০) নামে এক ব্যক্তি দুর্বৃত্তদের ছুরিকাঘাতে নিহত হয়েছেন। ভোটের আগের রাতে লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলায় বিএনপি-জামায়াতের সমর্থকদের গুলিতে আওয়ামী লীগের এক কর্মী (৩৫) নিহত হয়েছেন। এ সময় গুলিবিদ্ধ হয়েছে দুই ছাত্রলীগ নেতা। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার রাজগড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোট কেন্দ্রে আওয়ামী লীগ-বিএনপি সংঘর্ষে ইসরায়েল নামের এক যুবক নিহত হন। পরিবারের অভিযোগ, সংঘর্ষের সময় পুলিশের গুলিতে মৃত্যু হয় তার।

আহত ২১ জন ঢামেকে

নির্বাচনকে ঘিরে বিভিন্ন স্থানে সহিংসতায় আহতদের মধ্যে ২১ জন ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। গতকাল ভোর থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত বিভিন্ন জেলা থেকে আহতরা চিকিৎসা নিতে আসেন। তাদের শরীরে গুলিবিদ্ধ, ছুরিকাঘাত, লাঠির আঘাত ও পিটিয়ে জখমের চিহ্ন রয়েছে। আহতরা বিভিন্ন দল ও সাধারণ ভোটার ছিল।

আহতরা হলেন- ঢাকায় রয়েল ও আলমগীর হোসেন; কুমিল্লায় মিজান, সাইফুল ইসলাম, নুরুজ্জামান, দিদার আলম, সাখাওয়াত, মমতাজ খান, ইসমাইল, মাসুম খন্দকার, ফয়জুল্লাহ, কামরুজ্জামান, শাহবুদ্দিন শেখ ও আলম ফরাজী; নারায়ণগঞ্জে খোকন, তার শাশুড়ি বাছিরুন, উকিল রানা ও মেম্বার শাহ আলম; ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় রাসেল, জাবেদ এবং কিশোরগঞ্জে ওবায়দুল্লাহ।

সর্বশেষ খবর