রবিবার, ৬ জানুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

আজ চিরনিদ্রায় শায়িত হবেন সৈয়দ আশরাফ

নিজস্ব প্রতিবেদক ও কিশোরগঞ্জ প্রতিনিধি

আজ চিরনিদ্রায় শায়িত হবেন সৈয়দ আশরাফ

সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের মরদেহ গতকাল দেশে পৌঁছেছে -বাংলাদেশ প্রতিদিন

আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক, প্রেসিডিয়াম সদস্য ও জনপ্রশাসনমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম চিরনিদ্রায় শায়িত হবেন আজ। তিন দফা জানাজা শেষে রাজধানীর বনানী কবরস্থানে  তার মরদেহ দাফন করা হবে। গতকাল তার মরদেহ দেশে আনা হয়েছে। সন্ধ্যা ৬টা ৩ মিনিটে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের ‘মেঘদূত’ নামের একটি উড়োজাহাজ (ফ্লাইট-বিজি ০৮৯) দেশবরেণ্য এই রাজনীতিকের মরদেহ নিয়ে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এসে পৌঁছায়। মরদেহের সঙ্গে সৈয়দ আশরাফের একমাত্র সন্তান সৈয়দা রিমা ইসলাম, ভাই মেজর জেনারেল (অব.) সাফায়েত ইসলাম, দুই বোন ও এক শ্যালিকা এসেছেন।

সন্ধ্যা ৬টা ১৬ মিনিটে ভিআইপি টার্মিনাল লাগোয়া রানওয়েতে অবতরণের পর বিমানের কার্গোভল্ট থেকে মরদেহ নামানো হয়। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের নেতৃত্বে আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, শেখ হেলাল উদ্দিনসহ দলের জ্যেষ্ঠ নেতারা সৈয়দ আশরাফের কফিন গ্রহণ করেন। সৈয়দ আশরাফের ভাই সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম ও সৈয়দ শরিফুল ইসলাম তাদের সঙ্গে ছিলেন। বিমান থেকে সৈয়দ আশরাফের কফিন নামিয়ে সেখানে কিছু সময়ের জন্য শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য রাখা হয়। এ সময় জাতীয় ও দলীয় পতাকায় মোড়ানো হয় অস্থায়ী মুজিবনগর সরকারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের ছেলে সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের কফিন। এরপর ফুল দিয়ে একে একে শ্রদ্ধা জানানো হয় আওয়ামী লীগ, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে। পরে মরহুমের আত্মার শান্তি কামনা করে দোয়া করা হয়। এ সময় অনেকেই কান্নায় ভেঙে পড়েন। সন্ধ্যা ৬টা ২০ মিনিটে মরদেহ বাংলাদেশ পুলিশের একটি লাশবাহী গাড়িতে তোলা হয়। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে গাড়িটি সৈয়দ আশরাফের রাজধানীর ২১ বেইলি রোডের সরকারি বাসভবনের উদ্দেশে রওনা হয়।

সন্ধ্যা ৭টায় বেইলি রোডের বাসায় মরদেহ পৌঁছালে সেখানে এক আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়। আগে থেকেই সেখানে উপস্থিত ছিলেন তার দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সহযোদ্ধা, পরিবারের সদস্য, আত্মীয়স্বজন, গুণগ্রাহী, শুভানুধ্যায়ী, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ সর্বস্তরের মানুষ। প্রধান গেট থেকে শুরু করে বাসার ভিতরে সৈয়দ আশরাফের ছবি দিয়ে টানানো হয়েছে শোক ব্যানার। সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত মরদেহ রাখা হয় তার বাসার সামনে। বিপুল জনসমাগমের কারণে লাশবাহী গাড়ি থেকে মরদেহ নামানো সম্ভব হয়নি- এ কারণে দুঃখ প্রকাশ করেছেন সৈয়দ আশরাফের স্বজনরা। বাড়ির ভিতরের খোলা জায়গায় শামিয়ানা টানিয়ে অস্থায়ী মঞ্চ করে সেখানে আশরাফের কফিন রাখা হয়। এরপর সারি সারি করে দাঁড়িয়ে মরদেহে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান সর্বস্তরের মানুষ, যাদের মধ্যে দলীয় নেতা-কর্মী ছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতা-কর্মী, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ ছিলেন।

রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে আশরাফের কফিনে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান তারা। এ সময় বাসাজুড়ে সৃষ্টি হয় এক আবেগঘন পরিবেশের। বাসার নিচতলায় সৈয়দ আশরাফের জন্য খোলা হয়েছে শোকবই। সেখানে অনেকেই সৈয়দ আশরাফ সম্পর্কে বিভিন্ন মন্তব্য ও স্বাক্ষর করেন। সাড়ে ৮টা পর্যন্ত লোকারণ্য ছিল বেইলি রোডের বাসা। সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধার পর স্বজনরা তার মরদেহে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এ সময় আশরাফের মরদেহে ফুলেল শ্রদ্ধা জানান অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান, সমাজকল্যাণমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন, তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ইসমত আরা সাদেকসহ অনেকেই। রাত পৌনে ৯টার দিকে তার মরদেহ সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।

ক্যান্সারের কাছে হার মেনে থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককের একটি হাসপাতালে বৃহস্পতিবার শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন আওয়ামী লীগের দুঃসময়ের কা ারি সৈয়দ আশরাফ। কয়েক মাস ধরে ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন তিনি। সন্ধ্যা ৬টায় কফিনে মোড়ানো সৈয়দ আশরাফের নিথর দেহ যখন ঢাকায় পৌঁছায় তখন হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছে শেষ দেখা ও শ্রদ্ধা জানাতে উপস্থিত ছিলেন দীর্ঘদিনের সহযোদ্ধা, আওয়ামী লীগের বিভিন্ন স্তরের নেতা-কর্মী, পরিবারের সদস্য, আত্মীয়স্বজন, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাসহ সর্বস্তরের মানুষ। এ সময় সবাই মরদেহবাহী গাড়ির ওপর ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। বিমানবন্দরে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর অর্থবিষয়ক উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমান, আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, সাহারা খাতুন, স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম, গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, আবদুর রাজ্জাক, কর্নেল (অব.) মুহম্মদ ফারুক খান, আবদুল মতিন খসরু, শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ, রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম, বিমানমন্ত্রী শাহজাহান কামাল, চিফ হুইপ আ স ম ফিরোজ, সাবেক প্রতিমন্ত্রী ক্যাপ্টেন (অব.) এ বি তাজুল ইসলাম, দলের যুগ্মসাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ, ডা. দীপু মনি, জাহাঙ্গীর কবির নানক, আবদুর রহমান, সাংগঠনিক সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, বি এম মোজাম্মেল হক, এনামুল হক শামীম, খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন, ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, দলের বন ও পরিবেশবিষয়ক সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন, শ্রম সম্পাদক হাবিবুর রহমান সিরাজ, ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক সুজিত রায় নন্দী, কৃষি সম্পাদক ফরিদুন্নাহার লাইলী, শিক্ষা সম্পাদক শামসুন্নাহার চাঁপা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পাদক আবদুস সবুর, সংস্কৃতি সম্পাদক অসীম কুমার উকিল, প্রচার সম্পাদক হাছান মাহমুদ, উপ-প্রচার সম্পাদক আমিনুল ইসলাম আমিন, উপ-দফতর সম্পাদক বিপ্লব বড়–য়া, কেন্দ্রীয় সদস্য আখতারুজ্জামান, আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিম, এস এম কামাল হোসেন, রিয়াজুল কবির কাওছার, মারুফা আকতার পপি প্রমুখ। এ ছাড়া উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন, গণফোরাম নেতা মোস্তফা মহসীন মন্টু, যুব মহিলা লীগের সভাপতি নাজমা আক্তার, অপু উকিল, ঢাকা মহানগরী উত্তরের সভাপতি এ কে এম রহমতুল­াহ, স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক পঙ্কজ দেবনাথ, কিশোরগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম আফজল প্রমুখ। আজ সকাল সাড়ে ১০টায় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় মরহুমের প্রথম নামাজে জানাজা হবে। প্রথম জানাজায় অংশ নেবেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ। সেখানে উপস্থিত থাকবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। তবে জানাজায় সর্বস্তরের মানুষ অংশ নিতে পারবেন। এরপর হেলিকপ্টারে মরদেহ কিশোরগঞ্জে নিয়ে যাওয়া হবে। বেলা ১২টায় কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়া ঈদগাহ মাঠে দ্বিতীয় জানাজা ও ২টায় ময়মনসিংহের আঞ্জুমান ঈদগাহ মাঠে তৃতীয় জানাজা হবে। বাদ আসর রাজধানীর বনানী কবরস্থানে তার মরদেহ দাফন করা হবে।

বেইলি রোডের বাসায় মাইকে সৈয়দ আশরাফের চাচাতো ভাই আশফাকুল ইসলাম টিটো জানান, আগামী মঙ্গলবার বাদ আসর বেইলি রোডের বাসায় কুলখানি হবে। কুলখানিতে দলের নেতা-কর্মী, সমর্থক ও শুভাকাক্সক্ষীদের উপস্থিত হওয়ার অনুরোধ জানান তিনি। সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম দীর্ঘদিন ধরে ফুসফুস ক্যান্সারে ভুগছিলেন। অসুস্থতার কারণে তিনি গত বছর ১৮ সেপ্টেম্বর সংসদ থেকে ছুটি নেন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কিশোরগঞ্জ-১ আসনে নৌকা প্রতীকে জয়ী হন সৈয়দ আশরাফ। বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ৯টায় থাইল্যান্ডের ব্যাংককের বামরুনগ্রাদ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

শোলাকিয়ায় আজ জানাজা : কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়া ঈদগাহে আজ সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের নামাজে জানাজা। ঢাকা থেকে হেলিকপ্টারে করে আজ বেলা ১২টায় তার মরদেহ কিশোরগঞ্জে আনা হবে। দেশের সুপ্রাচীন ও বৃহত্তম শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দানে সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের জানাজার সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। জানাজা শেষে হেলিকপ্টারযোগে তার লাশ নেওয়া হবে ময়মনসিংহে। সেখান থেকে ঢাকায় নিয়ে বনানী কবরস্থানে তাকে দাফন করা হবে। প্রথমে কিশোরগঞ্জ পুরাতন স্টেডিয়ামে সৈয়দ আশরাফের মরদেহ নেওয়ার কথা থাকলেও বেশি লোক সমাগমের কথা চিন্তা করে শোলাকিয়া ঈদগাহে নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে জানা গেছে। জেলা প্রশাসক মো. সারওয়ার মুর্শেদ চৌধুরী জানান, আমরা শোলাকিয়ায় সব ধরনের প্রস্তুতি ইতিমধ্যে সম্পন্ন করেছি। পুলিশ সুপার মো. মাশরুকুর রহমান খালেদ জানান, সৈয়দ আশরাফ সাহেবের কফিন বহনকারী হেলিকপ্টারসহ মোট দুটি হেলিকপ্টার আসবে। এ বিষয়ে সব ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মাহদী হাসান জানান, শোলাকিয়া ঈদগাহে সৈয়দ আশরাফ সাহেবের মরদেহ নেওয়ার পর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তাকে প্রথমে গার্ড অব অনার প্রদান করা হবে।

পরে তার কফিনে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হবে এবং এ ঈদগাহেই তার নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হবে। স্থানীয় প্রশাসন এবং আওয়ামী লীগ, মুক্তিযোদ্ধা সংসদসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের পক্ষ থেকে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হবে। জানাজা শেষে হেলিকপ্টারযোগে তার লাশ নেওয়া হবে ময়মনসিংহে। সেখান থেকে ঢাকায় নিয়ে বনানী কবরস্থানে তাকে দাফন করা হবে।

কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট আতাউর রহমান বলেন, সৈয়দ আশরাফ শুধু একজন রাজনৈতিক নেতাই ছিলেন না, তিনি রাজনীতির শিক্ষকও। তিনি যখন যে বিষয়ে বক্তব্য দিতেন, মনে হতো সে বিষয়ে তিনি পিএইচডি ডিগ্রিধারী। তার বক্তব্য আমরা অবাক হয়ে শুনতাম। সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অধ্যক্ষ শরীফ সাদী বলেন, সৈয়দ আশরাফের মৃত্যুতে আমরা একজন রাজনৈতিক অভিভাবককে হারিয়েছি। তিনি স্বল্পভাষী হলেও স্পষ্টবাদী ছিলেন। সৎ, সাহসী, নির্লোভ চরিত্রের অধিকারী এমন নেতা এখন বিরল। ওয়ান-ইলেভেনের সময় সৈয়দ আশরাফের সাহসী ভ‚মিকার কথা তিনি শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন। তার মৃত্যু শুধু কিশোরগঞ্জকেই নয়, গোটা জাতিকেই নাড়া দিয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা।

 

সর্বশেষ খবর