রবিবার, ৬ জানুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা
পর্যবেক্ষণ

দায় কার?

আশরাফুল আলম খোকন

জাতীয় নির্বাচন নিয়ে অনেকেই ইনিয়ে-বিনিয়ে নেতিবাচক কথা বলার চেষ্টা করছেন। খুবই স্বাভাবিক, কারণ শতভাগ শুদ্ধও কখনো হয় না। আবার শতভাগ শুদ্ধতার পক্ষেও সবাই থাকে না। সুতরাং এসব নিয়ে বিচলিত হওয়ারও কিছু নেই, প্রতিক্রিয়া দেখানোরও কিছু নেই। চরম সত্য হলো- ইতিহাস কখনো পরাজিতের পক্ষে লেখা হয় না। মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ পরাজিত হলে এই দেশে রাজাকাররা হতো বীরের জাতি। আর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মুক্তিযোদ্ধারা হয়তো আখ্যা পেতেন দেশদ্রোহী।

বিএনপি-জামায়াত তো নির্বাচন বাতিলের কথা বলছেই, সুশীলতার দাবিদার কেউ কেউও নির্বাচন নিয়ে এমনসব বলছেন যে, কী জানি কী হয়ে গেল তারা বুঝতেই পারছেন না। হয়তো তারা চাচ্ছিলেন বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় আসুক। কেউ কেউ চাইতেই পারেন, এতে দোষের কিছু নেই। দোষ হচ্ছে যখন স্বপ্নগুলো আকাশকুসুম কল্পনার মতো হয়। তারা কি একবার ভেবে দেখেছেন, মানুষ বিএনপি-জামায়াতকে কেন ভোট দেবে? ২০০৮ সালের নির্বাচনে এই জোট আসন পেয়েছিল ২৯টি। গত ১০ বছরে বিএনপি-জামায়াত এমনকি করেছে যে, তাদের আসন বৃদ্ধি পাবে। কেউ কি বলতে পারবেন, ওরা পেট্রলবোমার আগুনসন্ত্রাস, জ্বালাও-পোড়াও, খুনখারাবি করা ছাড়া জনস্বার্থবিষয়ক কোনো কাজ করেছে কিংবা জনগণের কোনো মৌলিক স্বার্থ নিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে কোনো আন্দোলন করেছে। না, এমন কোনো রেকর্ড নেই। আওয়ামী লীগ মহাজোট ক্ষমতায় এলে দেশের প্রধানমন্ত্রী হবেন শেখ হাসিনা। এটা ছিল দিবালোকের মতো স্পষ্ট। যার যোগ্যতা ও নেতৃত্ব দলমত নির্বিশেষে দেশে-বিদেশে সমাদৃত। এই দেশে তার বিকল্প তিনি নিজেই, আর কেউ নন। বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় এলে প্রধানমন্ত্রী কে হবেন- এটা দেশের জনগণ তো দূরের কথা ঐক্যফ্রন্টের নেতা-কর্মীরাও জানতেন না। তাহলে জনগণ কাকে ভোট দেবে? ভারতের বিগত নির্বাচনের কথা মনে আছে নিশ্চয়ই। এক নরেন্দ্র মোদির ক্যারিশমাটিক ইমেজের ওপর ভর করে বিজেপির ভূমিধস বিজয় হয়। অন্যদিকে কংগ্রেসের প্রধানমন্ত্রী কে হবেন এটা নিয়ে কারও পরিষ্কার ধারণাই ছিল না। যদি ধরে নিই খালেদা জিয়া কিংবা তারেক রহমানই তাদের প্রধানমন্ত্রীর তালিকায় আছেন। তারা তো ২০০১-২০০৬ সালেও ছিলেন। ওই সময়ের জঙ্গিবাদ ও ব্যাপক দুর্নীতির অভিজ্ঞতা থেকে নিশ্চয়ই দেশের জনগণ তাদের আবার চাইবেন না। একজন এতিমদের টাকা আত্মসাতের দায়ে জেলে আছেন, আরেকজন দ প্রাপ্ত পলাতক আসামি। যার দুর্নীতির ব্যাপ্তি আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলেও বিস্তৃত। যুক্তরাষ্ট্র থেকে এফবিআই এসেও তার দুর্নীতির বিরুদ্ধে সাক্ষী দিয়েছে। জনগণ কেন তাদের আবার ভোট দেবে? কেউ যদি তর্কের খাতিরে বলতেও চান আওয়ামী লীগ ১০ বছরে কাজকর্মে অনেক ভুল করেছে, তাই জনগণ বিকল্প খুঁজবে। হুম, সেটা হতে পারে। কিন্তু নিশ্চয়ই শেখ হাসিনার বিকল্প এখনো দেশের মানুষ খালেদা-তারেককে ভাবে না। যে কাজ করে ভুল তার হয়, আর যে কাজ করে না তার সারা জীবন একটাই বদনাম অকর্মা, অলস। শেখ হাসিনার নেতৃত্ব, সততা, দেশপ্রেম, দেশ উন্নয়নের কর্মপরিকল্পনা নিয়ে তার চরম শত্রæরাও প্রকাশ্যে না পারলেও নীরবে একমত পোষণ করেন। তার ব্যক্তি ইমেজ দলের সমষ্টি থেকেও এখন বেশি- এটা সবাই স্বীকার করে। তাছাড়া বর্তমান সরকারের ইমেজ ভালো। আর দল হিসেবে আওয়ামী লীগের ইমেজ অন্য যে কোনো সময়ের তুলনায় এখন অনেক ভালো। অনেকে বলেন, বিএনপি-জামায়াত জোট ঠিকমতো প্রচারণা চালাতে পারেনি, পোলিং এজেন্ট দিতে পারেনি। এর দায়ভার কি আওয়ামী লীগের? আপনাদের তো ভুলে যাওয়ার কথা নয়, ডিসেম্বরের ১০ তারিখ যখন সব দল আনুষ্ঠানিকভাবে প্রচারণায় নামে সেদিনই বিএনপি-জামায়াতের সন্ত্রাসীরা দুজন আওয়ামী লীগ কর্মীকে হত্যা করেছে, প্রার্থীদের ওপর হামলা করেছে, নির্বাচনী অফিস ভাঙচুর করেছে। এমনকি নির্বাচনের দিনও তারা আওয়ামী লীগের ১৪ জন নেতা-কর্মীকে হত্যা করছে। একজন প্রিসাইডিং অফিসার এখনো মৃত্যু শয্যায়, সিলেটে এক নির্বাচনী কর্মকর্তাকে নির্বাচনের প্রচারণার সময় বিএনপির প্রার্থী মারধর করেছে। সীতাকু , ময়মনসিংহ, নোয়াখালীতে আবার পেট্রলবোমার আক্রমণ করেছে। তাহলে নির্বাচনে সহিংসতা করেছে কারা তা স্পষ্ট।

বিএনপি যদি হত্যাকারী, পেট্রলবোমা সন্ত্রাসীদের নির্বাচনী এজেন্ট নিয়োগ দেয় পুলিশ তো তাদের খুঁজবেই।

শুধু মিছিল-মিটিং নয়, নির্বাচনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে ব্যানার, পোস্টার লাগানো, ভোটারদের বাড়ি বাড়ি যাওয়া, ভোটার স্লিপ পৌঁছে দেওয়া। শতকরা ৮০ ভাগ জায়গায় বিএনপি-জামায়াতের প্রার্থীরা এ কাজটি করেননি। এমন কোনো সংবাদও মিডিয়াতে আসেনি যে, বিএনপি-জামায়াতের ব্যানার-পোস্টার কেউ ছিঁড়ে ফেলেছে। অধিকন্তু মিডিয়াতে উল্টো সংবাদ এসেছে যে, বিভিন্ন জায়গায় আগুন দিয়ে নৌকা পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে জোট বেঁধে ড. কামালরা ঐক্যফ্রন্ট করেছেন। নির্বাচনে জিতলে একসঙ্গে সরকার গঠন করবেন তারা। কিন্তু নির্বাচনী ইশতেহার দিয়েছেন আলাদাভাবে। অথচ ইশতেহারের আদর্শিক জায়গাতেই গলদ। ঐক্যফ্রন্ট বলেছে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার অব্যাহত রাখবে আর বিএনপি বরাবরের মতো এ বিষয়ে নিশ্চুপ। বেগম জিয়া বলেছিলেন, তারা ক্ষমতায় এলে দ্বিতীয় পদ্মা সেতু করবেন কিন্তু বিএনপির ইশতেহারে এর ছিটেফোঁটাও নেই।  যদি বলেন প্রার্থী নির্বাচন, সেক্ষেত্রেও বিএনপি-জামায়াত সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। প্রথম অবস্থায় তারা প্রায় ৯০০ প্রার্থীকে মনোনয়ন দিয়েছিলেন, যারা মাঠে প্রার্থী হিসেবে ছিলেন প্রায় ১০ দিন। হঠাৎ করে একজনকে রেখে বাকিদের মাঠ থেকে উঠিয়ে নেওয়া হলো। বিএনপির নেতা-কর্মীদেরও মুখে মুখে আছে- যারা বেশি বেশি টাকা লন্ডনে দিতে পেরেছেন তারাই শেষ পর্যন্ত মনোনয়ন দৌড়ে টিকেছিলেন। টাকা-পয়সা দিয়ে আর যা-ই হোক রাজনীতি হয় না, সংগঠন হয় না। এক্ষেত্রে বিএনপি-জামায়াত চরম অপরাধ ও অব্যবস্থাপনার পরিচয় দিয়েছে। বিএনপি-জামায়াতের নেতাদের প্রচারণার বিষয়ে যখনই সাংবাদিকরা জিজ্ঞেস করেছেন তারা শুধু বলেছেন, ৩০ ডিসেম্বর দেশে ভোট বিপ্লব হবে। জনগণ বাক্স ভরে তাদের ভোট দিয়ে আসবে। তারা আয়নায় একবারও নিজের চেহারা দেখেননি যে, জনগণ তাদের কেন ভোট দেবে।  এই রকম দৃষ্টান্ত আরও অনেক তুলে ধরা যাবে। মোদ্দা কথা হচ্ছে, বিএনপি-জামায়াতের ঐক্যফ্রন্টকে দেশের মানুষ কেন ভোট দেবে, কী আশায় স্বপ্নে ভোট দেবে তা তারা নিজেরাই জনগণের সামনে তুলে ধরতে পারেননি। নিজেদের ব্যর্থতার দায় এখন অন্যদের ওপর চাপিয়ে লাভ নেই। তারা হয়তো চেয়েছিলেন নিজেরা ভোট দিতে না গেলে কিংবা প্রচার-প্রচারণা না করলে নির্বাচনের আমেজ তৈরি হবে না। জনগণ ভোট দিতে যাবে না। তখন তারা প্রমাণ করতে পারবেন, শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচন জনগণ গ্রহণযোগ্য মনে করে না। তারা বুঝতে পারেননি যে, এই শেখ হাসিনাতেই জনগণের আস্থা। পুরো ঢাকা শহর ফাঁকা করে মানুষ গ্রামে গিয়েছিল পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে। জনগণ পরিবারসহ উৎসব করে ভোট দিতে গেছে। অনেকে কোলের বাচ্চাদের নিয়ে ভোট দিতে গেছেন, সেলফি তুলে সেই ছবি সোশ্যাল মিডিয়াতেও দিয়েছেন। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমেও এসেছে। মানুষ বাচ্চাদের নিয়ে ভোট দিতে কখন যায়? যখন সে নিজেকে নিরাপদ মনে করে।  বিএনপি-জামায়াত জনগণের মনের সুপ্ত ভাষা বুঝতে পারেনি- এই দায় অন্য কারও নয়।  

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর