প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। চমক মন্ত্রিসভায় অভিজ্ঞ প্রবীণ নেতাদের অনেকের ক্লিন ইমেজ দক্ষতা এবং সুনাম থাকলেও ঠাঁই দেননি। মহাজোটের প্রধান শরিক জাতীয় পার্টি এবার কার্যকর বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করবে। তাই তাদের কেউ মন্ত্রিসভায় নেই। এমনকি মহাজোটের অন্য শরিক ১৪ দলের কাউকেও মন্ত্রিসভায় রাখা হয়নি। রাখা হয়নি ’৭৯ সাল থেকে টানা ৮ বার বিজয়ী পার্লামেন্টারিয়ান শেখ ফজলুল করিম সেলিমসহ নিকটাত্মীয় কাউকেই। এক নির্মল মন্ত্রিসভায় শেখ হাসিনা অবহেলিত এলাকার নতুনদের সুযোগ করে দিয়েছেন।
বাদপড়া মন্ত্রীদের অনেকেই সফল, দক্ষ ও সৎ ছিলেন। কেউ কেউ দুর্নীতিসহ নানা কর্মকাে ছিলেন বিতর্কিত। তাদের সবাই বাদ পড়ায় কারও কারও জন্য কেউ কেউ আফসোস করলেও ব্যথিত হননি। নতুন মন্ত্রিসভায় যাদের ঠাঁই দিয়েছেন তাদের দু-চারজন অভিজ্ঞ রয়েছেন। সবাই সৎ, ক্লিন ইমেজ নিয়ে মন্ত্রিত্বের শপথ নিয়েছেন। সততা ও দক্ষতার সঙ্গে শপথ রক্ষা করে দায়িত্ব পালন করলে নিশ্চয় তাদের আমলনামা সাফল্যের পাল্লাকেই ভারী করবে। সততা, দক্ষতা প্রমাণে যারা ব্যর্থ হবেন অতীতের অনেকের মতো তারা বিতর্কের বোঝা নিয়ে নিন্দিত হবেন। প্রধানমন্ত্রী যে সুযোগ দিয়েছেন সততার সঙ্গে পবিত্র ইবাদতের মতো দায়িত্ব পালন করলে জনগণের হৃদয় জয় করবেন। ব্যক্তিগত লোভ ও লাভের আশায় কেউ এ সুযোগ ব্যবহার না করে শেখ হাসিনার নির্বাচনী অঙ্গীকার পূরণে পুলসিরাতের রাস্তা পার হবেন বলে আমাদের বিশ্বাস। এই দায়িত্ব অনেক বড় ইমানি দায়িত্ব। এর জন্য ইহকাল ও পরকালে জবাবদিহিতার ব্যবস্থা রয়েছে। সরকারপ্রধান হিসেবে নির্বাচনে ভূমিধস বিজয় নিয়ে শেখ হাসিনা টানা তৃতীয়বার ও মোট চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করে বিশ্ব রাজনীতিতে ইতিহাস গড়লেন। নির্বাচনী ফলাফল বিস¥য়কর। নির্বাচনে শেখ হাসিনার ইমেজের ওপর মহাজোট দৃই-তৃতীয়াংশ আসন নিয়ে বিজয়ী হচ্ছেন, এমন ধারণা ভোটের আগেই সবার মধ্যে ছিল। কিন্তুু ভোটের ফলাফলে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট বা বিএনপির শক্তিশালী অনেক প্রার্থীর প্রাপ্ত ভোট অবিশ্বাস্য ও নজিরবিহিন যেমন সত্য তেমনি এককালের বিএনপির দুর্গ তছনছ হয়ে যাওয়ার দৃশ্য ছিল বিস্ময়কর। জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে নতুন নির্বাচনের দাবি জানিয়েছে। এমনকি তাদের যে ৭ জন বিজয়ী হয়েছেন তারা শপথ নেবেন না বলে ঘোষণা দিয়েছেন। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া কারাগারে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান একুশের গ্রেনেড হামলাসহ নানা মামলায় দি ত হয়ে আইনের চোখে পলাতক আসামি হিসেবে লন্ডনে নির্বাসিত। এই নির্বাচনে মনোনয়ন দানের ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন থেকে নিবন্ধন বাতিল হওয়া যুদ্ধাপরাধী জামায়াতে ইসলামীকে ২২টি আসনে ঐক্যফ্রন্টের মনোনয়ন দিয়ে তাদের প্রতীক ধানের শীষকে পাপের বিষে পরিণত করেছিল। নতুন ভোটারদের জন্য এটি ছিল চরম আঘাত।
জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতা ড. কামাল হোসেনের আবেগ অনুভূতি ও আদর্শিক জায়গা যেমন উপেক্ষিত হয়েছে তেমনি মনোনয়ন বাণিজ্যের আগ্রাসনে বিএনপির পরিশীলিত ক্লিন ইমেজের নেতা মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বকে অবজ্ঞা করা হয়েছে। তার পরেও এই ফলাফল বিএনপির কাছে যেমন অপ্রত্যাশিত তেমনি মানুষের কাছে কিছুটা হলেও প্রশ্নবিদ্ধ। অতীতে বিএনপি অনেক হঠকারী পথ নিয়ে সুফল ঘরে তুলতে পারেনি। বিরোধী দলের আসন নাই পাক, বিএনপি থেকে অন্তত দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও ঐক্যফ্রন্টের নেতা সাবেক ডাকসু ভিপি সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমেদ ঝড়ের কবল থেকে উঠে এসেছেন। বিজয়ী হয়েছেন। সংসদের বাইরে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট যদি নতুন নির্বাচনের দাবিতে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন করে জনমত পক্ষে টানতে চায় তাহলে প্রথমেই তাদের জামায়াতের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক ছিন্ন করতে হবে। তারপর একটি জনপ্রিয় দল হিসেবে বিএনপিকে সংগঠন তৃণমূল থেকে সুসংগঠিত করে আনতে হবে। সংগঠন ছাড়া ও কার্যকর সংগঠক ছাড়া কোনো আন্দোলন আলোর মুখ দেখে না। সরকার নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যে শক্তি অর্জন করেছে তাতে আন্দোলনের স্পেস খুব বেশি দেবে বলে মনে হয় না। তবুও রয়ে সয়ে সংগঠন গুছিয়ে নরমে-গরমে আন্দোলনের পাশাপাশি সংসদেও ঐক্যফ্রন্ট বা বিএনপিকে ভূমিকা রাখতে হবে। এবারের সংসদে জাতীয় পার্টি কার্যকর বিরোধী দলের ভূমিকায় থাকছে। মহাজোটের শরিক ১৪ দলের নেতারাও মন্ত্রীত্বের বাইরে থাকছেন। রাশেদ খান মেনন, হাসানুল হক ইনু, মঈনউদ্দিন খান বাদল আছেন। এমনকি অভিজ্ঞ পার্লামেন্টারিয়ান তোফায়েল আহমেদ, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, মতিয়া চৌধুরীরা ক্ষমতার বাইরে সংসদে বসছেন। জাতীয় ইস্যুতে বা কোনো মন্ত্রীর ব্যর্থতায় অতীতে যেমন তারা চুপ করে থাকেননি তেমনি এবারও থাকবেন না। এ ক্ষেত্রে এই সংসদ আলোচিত ও আলোকিত এবং সব বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। সেখানে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ৭ জন যোগ দিলে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও সুলতান মনসুরের জন্য কথা বলার সুবর্ণ সুযোগ রয়েছে। সংসদে কথা বললে বিতর্ক যেমন মানুষের দৃষ্টি কাড়বে তেমনি জনমনে প্রভাব ফেলবে। আর গণমাধ্যম উদার নীতি নিয়ে কাভারেজ দেবে।ড. কামাল হোসেন আর যাই হোক একজন অভিজ্ঞ, প্রাজ্ঞ ও বিচক্ষণ আইনজ্ঞ এবং রাজনীতিবিদ। হঠকারী উগ্র নেতিবাচক সিদ্ধান্ত তার কাছ থেকে মানুষ আশা করে না। ড. কামাল হোসেন সংসদের ভিতরে বাইরে বিরোধী দলের জন্য সব পথ কার্যকরভাবে খোলা রাখতে চাইলে তাদের শপথ নিয়ে সংসদে নিয়মিত ভূমিকা রাখতে বলুন। যে কোনো ইস্যুতে কথা বলতে বলুন। যে অভিযোগ বাইরে করছেন সেটি সংসদে করতে বলুন। এমনকি নতুন নির্বাচন চাইলে সেই দাবিটিও যুক্তি, বিচার-বিশ্লেষণ করে সংসদে উত্থাপন করার সুযোগ নিতে বলুন। শেখ হাসিনা ইতিহাস গড়েছেন। ড. কামাল এখন কী করবেন? যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিন। সুলতানদের সংসদে দিন।