বুধবার, ৯ জানুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

পুলিশ-শ্রমিক সংঘর্ষে একজন নিহত

আহত ৩২, জরুরি বৈঠক

নিজস্ব প্রতিবেদক ও সাভার প্রতিনিধি

পুলিশ-শ্রমিক সংঘর্ষে একজন নিহত

সরকার-ঘোষিত মজুরি বাস্তবায়ন ও বেতনবৈষম্য নিরসনের দাবিতে ঢাকার সাভারে বিক্ষোভের সময় পোশাক কারখানার শ্রমিকদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে এক শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। এ ছাড়া গতকাল সকাল থেকে  রাজধানীর মিরপুর ও উত্তরা এবং গাজীপুরসহ বেশ কয়েকটি স্থানে পুলিশ ও পোশাকশ্রমিকদের পৃথক ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনায় পুলিশ ও ৩২ জন শ্রমিক আহত হয়েছেন। পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। আহতদের মধ্যে গুলিবিদ্ধ তিন ব্যক্তি সাভারের এনাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন বলেও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ নিশ্চিত করেছে। শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গতকাল সাভারের কয়েকটি স্পটে বিক্ষোভ ও সড়ক অবরোধ করেন শ্রমিকরা। সকালে হেমায়েতপুরে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনায় কয়েকজন আহত হন। পরে বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে উলাইল এলাকার আন-লিমা গার্মেন্টসের সামনে বিক্ষোভের সময় পুলিশের গুলিতে আহত হন সুমন মিয়া (২২)। তিনি ওই গার্মেন্টেরই একজন শ্রমিক। গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর সহকর্মীরা তাকে সাভার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। এ ঘটনায় একই কারখানার শমেস নামের এক শ্রমিক এবং সকালে হেমায়েতপুরের ঘটনায় আরও দুই নারী গুলিবিদ্ধ হয়ে এনাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন বলেও জানান তারা। সাভার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে উপস্থিত পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা আমজাদুল হক বলেন, ‘সুমন মিয়াকে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আনার পরই চিকিৎসকরা মৃত ঘোষণা করেছেন। তার বুকে গুলি লেগেছে বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে।’ এদিকে ঘটনার পরপরই সাভার থানা পুলিশের পক্ষ থেকে নিহত সুমন মিয়ার মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বলে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।এদিকে এনাম মেডিক্যাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ‘শমেস, আঁখি বেগম ও রুবিনা বেগম নামে তিন ব্যক্তি গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে এসেছেন।’ আঁখি বেগম জানান, তিনি গার্মেন্টস কর্মী নন। হেমায়েতপুরে নিজের দোতলা বাসা থেকে সংঘর্ষের ঘটনা দেখছিলেন। সে সময় বাইরে থেকে একটি গুলি তার পেটে গিয়ে লাগে। রুবিনা বেগম বলেন, ‘আমি স্ট্যান্ডার্ড গ্রুপের যমুনা গার্মেন্টসে কাজ করি। হেমায়েতপুরে সকালে বিক্ষোভের পর ঘটনাস্থলের পাশের কলোনিতে আমার বাড়িতে যাই। সে সময় পুলিশ ওই এলাকায় যায় এবং আমার বাড়িতে গুলি চালালে আমার ডান পায়ে বিদ্ধ হয়।’ সাভার এনাম মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতালের অপারেশন ইনচার্জ নাসির উদ্দিন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, তার হাসপাতালে তিনজন গুলিবিদ্ধসহ ১৩ জন ভর্তি হয়েছেন। সাভার মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবদুল আওয়াল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘গুলিবিদ্ধ হয়ে এক শ্রমিক মারা গেছেন। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে থেকে আমাকে লাশ বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। এরপর লাশ ময়নাতদন্তের জন্য সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। অপ্রীতিকর পরিস্থিতি এড়াতে ওই এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন রাখা হয়েছে।’ এদিকে সরকার ঘোষিত ন্যূনতম মজুরি বাস্তবায়ন ও বকেয়া বেতনের দাবিতে তৃতীয় দিনের মতো রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় বিক্ষোভ ও সড়ক অবরোধ করেছেন পোশাকশ্রমিকরা। গতকাল সকাল থেকে মিরপুর ও উত্তরার রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ শুরু করেন তারা। দুপুরের পর থেকে কয়েক দফায় আজমপুর ও দক্ষিণখান এলাকায় পুলিশের সঙ্গে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এ সময় তারা বাসে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। পুলিশও কাঁদানে গ্যাস ছোড়ে। বিকাল পৌনে ৫টার দিকে এলাকা ছাড়তে শুরু করেন পোশাকশ্রমিকরা। যান চলাচলও স্বাভাবিক হয়। এর আগ পর্যন্ত রাজধানীর উত্তরা ও মিরপুরমুখী সড়কে যান চলাচল বন্ধ থাকায় যানজট ছড়িয়ে পড়ে পুরো রাজধানীতে। দুর্ভোগ চরমে ওঠে নগরবাসীর। সকাল ৯টার দিকে মিরপুরের কালশী এলাকায় ২২ তলা গার্মেন্টসের সামনে শ্রমিকরা অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ঘটনাস্থলে পুলিশ গেলে শ্রমিকদের সঙ্গে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। তবে পরে তাদের সড়কে অবস্থান করতে দেয় পুলিশ। এ খবর ছড়িয়ে পড়লে পল্লবীমুখী যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। খাদিজা আক্তার নামে একজন নারীশ্রমিক বলেন, ‘আমাদের ন্যূনতম বেতনকাঠামোর প্রজ্ঞাপন ডিসেম্বরে জারি হয়েছে। কিন্তু সেখানে আমাদের সব দাবি উত্থাপিত হয়নি। অপারেটর ও হেলপারের বেতনের মধ্যে অনেক বৈষম্য ও ব্যবধান রয়েছে। আমরা এগুলো দূর করার কথা বলছি।’ তার অভিযোগ, সরকার নতুন বেতনকাঠামো নির্ধারণ করলেও মালিকপক্ষ তা দিচ্ছে না। তাদের সংসার পরিচালনা করতে কষ্ট হচ্ছে। পল্লবী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নজরুল ইসলাম বলেন, কালশীতে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছিল। বেলা ২টার দিকে যান চলাচল স্বাভাবিক হয়। বিষয়টি নিয়ে পোশাক কারখানার মালিক ও শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। এদিকে সকাল সাড়ে ৮টার দিকে উত্তরখান ও দক্ষিণখান এলাকার গার্মেন্টসের শ্রমিকরা আজমপুরে জড়ো হতে থাকেন। পুলিশের বাধা ও টিয়ার শেল নিক্ষেপের কারণে শ্রমিকরা উত্তরা চার নম্বর সেক্টরে ঢুকে যান। লাঠিসোঁটা হাতে নিয়ে বেশ কিছু প্রাইভেটকার ভাঙচুর করেন তারা। এ সময় আবাসিক এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। পরে সেক্টরকে নিরাপদ রাখার জন্য কল্যাণ সমিতি সড়কগুলোর মুখের নিরাপত্তা গেট বন্ধ করে দেয়। লাঠিসোঁটা নিয়ে পোশাকশ্রমিকরা আবাসিক এলাকায় ঢুকে পড়ায় চার-পাঁচটি স্কুলের শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন। শ্রমিকরা রাস্তায় নেমেছেন এমন খবরে খিলক্ষেত ও উত্তরামুখী যান চলাচল বন্ধ হয়ে পড়ে। বিমানবন্দরগামী অনেক যাত্রীকে ফ্লাইট ধরার জন্য পায়ে হেঁটে যেতে দেখা গেছে। বেলা সোয়া ৩টার দিকে আজমপুর এলাকায় পুলিশের সঙ্গে শ্রমিকদের ব্যাপক ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। শ্রমিকদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশকে লাঠিচার্জ, টিয়ার শেল নিক্ষেপ ও জলকামান ব্যবহার করতে দেখা যায়। শ্রমিকদেরও পাল্টা ইটপাটকেল নিক্ষেপ করতে দেখা যায়। বিকাল পৌনে ৫টার দিকে পুলিশের ধাওয়ায় আজমপুর ও দক্ষিণখান এলাকার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসতে শুরু করে। শ্রমিকরা সরে যেতে থাকেন। তবে বিপুলসংখ্যক পুলিশ সদস্যকে ঘটনাস্থলের আশপাশ এলাকায় অবস্থান করতে দেখা যায়। গত দুই দিনের তুলনায় গতকাল পুলিশের সংখ্যা ছিল অনেক বেশি। ঘটনাস্থলে অতিরিক্ত পুলিশ ও সাঁজোয়া যান আনা হয়েছে। দক্ষিণখান থানার পরিদর্শক (তদন্ত) শফিকুল গনি সাবু বলেন, বেতন-ভাতা পরিশোধের দাবিতে রাস্তা অবরোধ করায় পোশাকশ্রমিকদের সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন যান চলাচল স্বাভাবিক রয়েছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) উত্তরা বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) নাবিদ কামাল শৈবাল জানান, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করা হয়। এ কারণে পুলিশ শান্ত ছিল। মন্ত্রণালয়েও বৈঠক চলছিল। শ্রমিকদের শান্ত থাকার কথা বলা হলেও তারা জনশৃঙ্খলার বিঘ্ন ঘটিয়ে রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভ করে আসছিল। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে শ্রমিকদের ধাওয়া দিয়ে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এদিকে গাজীপুর মহানগরীর কয়েকটি স্থানে গতকালও বিভিন্ন পোশাক কারখানায় শ্রমিকরা কর্মবিরতি, বিক্ষোভ ও মহাসড়ক অবরোধ করেছেন। বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা ভোগড়া বাইপাস মোড়ে পুলিশের একটি মোটরসাইকেলে আগুন ধরিয়ে দেন।

 পুলিশ কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে শ্রমিকদের মহাসড়ক থেকে সরিয়ে দেয়। এ ঘটনায় ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে প্রায় দুই ঘণ্টা যান চলাচল বন্ধ ছিল। শ্রমিকদের বিক্ষোভের মুখে দুপুরের পর গাজীপুর মহানগরীর ভোগড়া ও আশপাশ এলাকার টিএন ফ্যাশন, অ্যাপারেলস পোশাক কারখানা, পশমী সোয়েটার, ক্যাপিটাল ফ্যাশনসহ কয়েকটি কারখানা ছুটি ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ।

 

সর্বশেষ খবর