বৃহস্পতিবার, ১০ জানুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

পোশাকশ্রমিকদের বিক্ষোভ অব্যাহত

এক মাসের মধ্যে সমাধান : বাণিজ্যমন্ত্রী

নিজস্ব প্রতিবেদক

পোশাকশ্রমিকদের বিক্ষোভ অব্যাহত

রাজধানীর কালশীতে আন্দোলনরত পোশাক শ্রমিকরা

নতুন মজুরি কাঠামোর বাস্তবায়ন পর্যালোচনার জন্য কমিটি গঠনের পরও পোশাক শ্রমিকরা গতকাল চতুর্থ দিনের মতো সড়কে নেমে বিক্ষোভ করেন। ঢাকার সাভার, আশুলিয়া, গাজীপুর, রাজধানীর মিরপুরের কালশী ও দক্ষিণখানে অবস্থান নেয় তারা। তবে সাভার, আশুলিয়া ও গাজীপুরের কয়েক স্থানে পুলিশের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ হয়। এতে আহত হয় প্রায় অর্ধশত। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এসব এলাকায় ৪ প্লাটুন বিজিবিসহ অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়। এদিকে শ্রমিকদের চলমান এ আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে একজন নিহতের ঘটনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ মিছিল করেছে প্রগতিশীল ছাত্র জোট। আন্দোলনরত শ্রমিকদের অভিযোগ, তাদের জন্য সরকার ঘোষিত নতুন বেতন কাঠামো নির্ধারণ করলেও মালিকপক্ষ সে অনুযায়ী দিচ্ছে না। এর আগে মঙ্গলবার এক বৈঠকে মালিক পক্ষের পাঁচজন, শ্রমিক পক্ষের পাঁচজন এবং সরকারের বাণিজ্য সচিব ও শ্রম সচিবকে নিয়ে ১২ সদস্যের একটি কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। এ কমিটি এক মাসের মধ্যে মজুরির অসঙ্গতি খতিয়ে দেখে সমস্যা সমাধানে পদক্ষেপ নেবে বলেও আশ্বাস দেওয়া হয়। জানা যায়, শ্রমিকরা গতকাল সকাল থেকেই কালশী ২২তলা গার্মেন্টের সামনে জড়ো হতে শুরু করে। এরপর মূল সড়কে অবস্থান নেয়। তাদের বিক্ষোভের ফলে সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। পরে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তাদের সঙ্গে কথা বলেন এবং আশ্বস্ত করেন যে- সরকারি মজুরি কাঠামো অনুযায়ী তারা যাতে বেতন পায় বিষয়টি তারা নজরদারি করবেন। এ সময় আশপাশের বিভিন্ন ফ্যাক্টরির মালিকরাও এসে তাদের আশ্বস্ত করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে বেলা ১টার দিকে শ্রমিকরা অবরোধ প্রত্যাহার করে নিলে যান চলাচল স্বাভাবিক হয়। পুলিশের আশ্বাসে শ্রমিকরা অবরোধ তুলে নেয় বলে জানান পল্লবী থানার পরিদর্শক (অপারেশন) ইমরানুল হাসান প্রিন্স।   শ্রমিক নেতারা বলছেন, মজুরির অসঙ্গতিগুলো দূর করতে এক মাস সময় না নিয়ে যদি তিন দিন বা এক সপ্তাহ সময় নেওয়া হতো, তাহলে এই সমস্যার দ্রুত সমাধান হতো। 

সাভার-আশুলিয়ায় সংঘর্ষে আহত ৪৪, ৩০টি কারখানা ছুটি : বেতন বৈষম্যের অভিযোগে গতকাল চতুর্থ দিনেও সাভার-আশুলিয়ার পোশাক কারখানার বিক্ষুব্ধ শ্রমিকদের সঙ্গে পুলিশের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া চলে। এ সময় পুলিশ লাঠিচার্জ ও টিয়ার শেল ছোড়ে। এতে শ্রমিক ও পুলিশসহ আহত হয়েছে অন্তত ৪৪ জন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে বিজিবি মোতায়েন করা হয়। সকালে সাভারের উলাইন ও আশুলিয়ার জামগড়া, নরসিংহপুর, ঘোষবাগ, নিশ্চিন্তপুর, সরকার মার্কেট, কাঠগড়া ও ধামরাই থানা এলাকাসহ বিভিন্ন স্থানে শ্রমিক বিক্ষোভ হয়।

সূত্র জানায়, সকাল ৮টার দিকে কারখানায় ঢুকে শ্রমিকরা বেতন বৈষম্যের অভিযোগ তোলে। তারা সাভারের উলাইন ও আশুলিয়ার কাঠগড়া, জামগড়া, ঘোষবাগ, নিশ্চিন্তপুর ও নরসিংহপুর এলাকায় বেশ কয়েকটি কারখানার অভ্যন্তরে কাজ বন্ধ করে দেয়। সুমন মিয়া (২২) নামে এক শ্রমিক নিহতের খবরে সাভারের অন্তত ৩০টি কারখানা থেকে বেরিয়ে এসে রাস্তায় অবস্থান নেয় শ্রমিকরা। এ সময় বস্তা ও বড় বড় ইটের চাকা ফেলে সড়ক অবরোধ করে রাখা হয়। সেখানে পুলিশ ও বিজিবির গাড়ি পৌঁছলে শ্রমিকরা তাদের লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছুড়তে থাকে। পুলিশও পাল্টা রাবার বুলেট, টিয়ার শেল ছোড়ে। দুই পক্ষের মধ্যে দফায় দফায় ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া শুরু হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ লাঠিচার্জ ও কয়েক রাউন্ড টিয়ার শেল নিক্ষেপ করে। এ ঘটনায় উভয় পক্ষের অন্তত ৩০ জন আহত হয়। গাজীপুরে শ্রমিক বিক্ষোভ, ভাঙচুর, বিজিবি মোতায়েন : গাজীপুরা, টঙ্গী, নাওজোড়, ভোগড়া বাইপাসসহ বেশ কয়েকটি স্থানে শ্রমিকরা বিক্ষোভ, কারখানা ভাঙচুর ও মহাসড়ক অবরোধ করে। উ™ভূত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এসব এলাকায় বিজিবি মোতায়েন করে গাজীপুর জেলা প্রশাসন। সকালে সিটি করপোরেশনের নাওজোড়, কড্ডা, ভোগড়া বাইপাস এলাকার বিভিন্ন কারখানার শ্রমিকরা সড়কে নেমে আসে। এ সময় তারা আশপাশে থাকা বিভিন্ন কারখানার শ্রমিকদেরও বাইরে বের করে আনার চেষ্টা করে। ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে কয়েকটি কারখানার ভবনের কাচ ভাঙচুর করে। এতে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। পরে পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। সড়ক থেকে শ্রমিকদের সরিয়ে দেওয়া হলে প্রায় আধা ঘণ্টা পর যানবাহন চলাচল শুরু হয়। এদিকে টঙ্গী বিসিক শিল্প এলাকায় ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে প্রায় ১৫টি কারখানা ভবনের কাচ ভাঙচুর করে। এ সময় কারখানার অন্তত ৩টি গাড়িতে আগুন দেওয়া হয়। নাওজোড়, ভোগড়া বাইপাস এলাকায় সড়কে পরিত্যক্ত বস্তা ও টায়ারে আগুন জ্বালিয়ে ঢাকা-ময়মনসিংহ ও ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক অবরোধের চেষ্টা করে শ্রমিকরা। ফলে ওই সড়কগুলোর সব ধরনের যানবাহন চলাচল বন্ধ হলে শিল্প পুলিশ, থানা পুলিশ ও হাইওয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। এমন পরিস্থিতিতে ওই সব এলাকার অধিকাংশ কারখানা গতকালের জন্য ছুটি ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ।  গাজীপুরের জেলা প্রশাসক ড. দেওয়ান মুহাম্মদ হুমায়ূন কবীর জানান, পোশাক কারখানার শ্রমিকদের বিশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে গাজীপুরের টঙ্গী, গাজীপুরা, হোতাপাড়া, কোনাবাড়ী ও মৌচাক এলাকায় ৪ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে গতকাল সকাল থেকে বিজিবি সদস্যরা দায়িত্ব পালন শুরু করে।

সুমনের বাড়িতে শোকের ছায়া : সাভারে সংঘর্ষে নিহত গার্মেন্ট শ্রমিক সুমন মিয়ার (২২) বাড়ি শেরপুরের শ্রীবরদী উপজেলায়। উপজেলার কলাকান্দা গ্রামের আমির আলীর ছেলে সুমন। সুমনের বাড়িতে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। মঙ্গলবার ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে সাভারের উলাইন এলাকায় দাবি আদায়ে আন্দোলনরত শ্রমিকদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে সুমন মিয়া মারা যান বলে অভিযোগ। পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, তার বাবা ঢাকায় একটি বিস্কুট ফ্যাক্টরির শ্রমিক। মা গৃহিণী। তারা দুই ভাই তিন বোন। সুমন সবার ছোট। তিনি প্রায় দুই বছর ধরে সাভারের আনলীমা অ্যাপারেলসে ফিনিশিং সেকশনে কাজ করতেন।

ঢাবিতে বিক্ষোভ : পুলিশের গুলিতে সুমন নামে এক শ্রমিক নিহতের প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল করেছে প্রগতিশীল ছাত্র জোট। গতকাল দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে তারা এই বিক্ষোভ মিছিল করে। মিছিল শেষে সংক্ষিপ্ত সমাবেশে বক্তারা শ্রমিক হত্যার ঘটনায় নিন্দা ও দোষীদের শাস্তির দাবি জানান। এ ছাড়াও শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি মেনে নিতে কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানানো হয়।

গত এক সপ্তাহ ধরে ন্যূনতম মজুরির দাবিতে রাজধানীর উত্তরা, সাভার ও আশুলিয়া এবং গাজীপুরের বিভিন্ন এলাকায় শ্রমিকদের বিক্ষোভ চলছে।

এক মাসের মধ্যে সমাধান- বাণিজ্যমন্ত্রী : ন্যূনতম মজুরি বাস্তবায়নের দাবিতে আন্দোলনরত গার্মেন্ট শ্রমিকদের কাজে ফিরে যাওয়ার আহ্বান জানিয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেছেন, তাদের মজুরিজনিত সমস্যা আগামী এক মাসের মধ্যে সমাধান করা হবে। গতকাল বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে জরুরি সংবাদ সম্মেলনে তিনি শ্রমিকদের এ আশ্বাস দেন। মন্ত্রী বলেন, নতুন বেতন কাঠামোর কারণে কোনো শ্রমিকের যদি বেতন কমে যায় তাহলে তা আগামী মাসের বেতনের সঙ্গে সমন্বয় করে পরিশোধ করা হবে। উল্লেখ্য, বেতন কাঠামোতে বৈষম্য দূর করাসহ বিভিন্ন দাবিতে গত ৬ জানুয়ারি থেকে থেকে আন্দোলন করছেন  পোশাক শ্রমিকরা। বিক্ষোভ নিরসনে মঙ্গলবার শ্রম ভবনে  পোশাক শ্রমিক-মালিক ও সরকারের ত্রিপক্ষীয় বৈঠক হয়।  সেখানে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, শ্রমিকদের বেতন কাঠামোতে  কোনো বৈষম্য বা অসঙ্গতি থেকে থাকলে চলতি জানুয়ারি মাসের মধ্যেই তা সংশোধন করা হবে।

ফেব্রুয়ারিতে সংশোধিত গ্রেডিংয়েই বেতন পাবেন শ্রমিকরা। বৈঠকে এ সমস্যা সমাধানে একটি ত্রিপক্ষীয় কমিটি গঠনেরও সিদ্ধান্ত  নেওয়া হয়। এ বিষয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, নতুন বেতন কাঠামোর অসঙ্গতি দূর করতে শ্রমিক পক্ষের ৫ জন, মালিক পক্ষের ৫ জনসহ শ্রম এবং বাণিজ্য সচিবের সমন্বয়ে গঠিত কমিটি কাজ করবে। এই কমিটির প্রতিবেদন পাওয়ার পর গার্মেন্ট শ্রমিকদের বেতনের বিষয়ে আর কোনো সমস্যা থাকবে না। এক প্রশ্নের জবাবে টিপু মুনশি বলেন, এই ধরনের আন্দোলনে অনেক সময় বাইরের লোক ঢুকে যায়। সে বিষয়টি সরকার কঠোরভাবে মনিটর করছে।

সর্বশেষ খবর