মঙ্গলবার, ১৫ জানুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা
সমাধানে বাধা কোথায়

সমাধানের পক্ষে মালিকরা না হলে ক্ষতি সবারই

জিন্নাতুন নূর ও রুহুল আমিন রাসেল

এ মুহূর্তে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে শ্রমিকদের আস্থা অর্জন। আগে মজুরি ইস্যুতে শ্রমিকদের অসন্তোষ ছিল, যা পরে ভীতিতে পরিণত হয়েছে। কারখানায় কর্মবান্ধব পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে প্রশাসন ও মালিকদের তৎপর হয়ে শ্রমিকদের আস্থা অর্জন করতে হবে। গতকাল শ্রমিকনেতারা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে এসব কথা বলেন। তারা এও বলেন, শ্রমিকরা যদি এখন কাজে ফিরে না যায়, তাহলে পুরো অর্থনীতির পাশপাশি শ্রমিক ও মালিক উভয় পক্ষই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এমনকি কাজে না ফিরলে শ্রমিকদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থাও নেওয়া হতে পারে। এ জন্য সবার ভালোর জন্য এ মুহূর্তে শ্রমিকদের কাজে ফিরে যাওয়া ছাড়া বিকল্প নেই। অন্যদিকে পোশাকশিল্পে শ্রমিকদের চলমান সমস্যা সমাধানের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন মালিকরাও। তারা শ্রমিকদের  রাজপথ ছেড়ে কাজে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তাদের মতে, এই শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হলে শ্রমিকরাও ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। আর সংশোধনের পরও নতুন মজুরিকাঠামো নিয়ে আন্দোলন করার কোনো যৌক্তিকতা নেই। এরই মধ্যে অধিকাংশ শ্রমিক কাজে ফিরেছেন। মালিকরা বলছেন, এখন যারা আন্দোলন করছেন, তারা পোশাকশিল্পকে বিশ্বে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছেন। গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি আমিরুল হক আমিন বলেন, ‘গতকাল শুধু আশুলিয়ার কয়েকটি পোশাক কারখানায় শ্রমিকরা বিক্ষোভ করেন। কিন্তু এর আগের দিন, অর্থাৎ রবিবার রাজধানী ঢাকা ছাড়াও গাজীপুর, সাভারসহ বিভিন্ন এলাকায় শ্রমিক অসন্তোষ দেখা যায়। অর্থাৎ আগের তুলনায় শ্রমিক অসন্তোষ অনেকটাই কমে এসেছে। আমরা আশা করছি শিগগিরই এই অসন্তোষ আরও কমে আসবে এবং পরিস্থিতি দ্রুত স্বাভাবিক হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেহেতু নিজে হস্তক্ষেপ করে কয়েকটি গ্রেডে শ্রমিকদের বেতন বৃদ্ধি করেছেন, এ জন্য শ্রমিকদের কাছে আমার অনুরোধ, তারা যেন দ্রুত কাজে যোগ দেন। এর পরও যদি শ্রমিকরা মনে করেন যে তাদের মজুরি বৃদ্ধি প্রয়োজন, সে ক্ষেত্রে পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ, শ্রমিক ফেডারেশনের এবং শ্রম মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বসে তাদের কারখানাভিত্তিক আলোচনায় যেতে হবে। আর এমনটি যদি করা না যায় তাহলে শ্রমিক ও মালিক উভয়েরই ক্ষতি হবে।

বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ) সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, পোশাকশিল্পে শ্রমিকদের চলমান সমস্যা সমাধানের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন মালিকরা। কারণ এ সমস্যা সমাধান না হলে ক্ষতি হবে সবারই। এ ক্ষেত্রে যেসব অসংগতি হয়েছে, তা সর্বশেষ ত্রিপক্ষীয় সভার সিদ্ধান্তে সমাধান হয়েছে। আমরা এ সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছি। শ্রমিকরাও মেনে নিয়ে কারখানায় কাজ করছেন। তবে আজ (গতকাল) ২০ থেকে ২৫টি কারখানার শ্রমিকরা কাজ করেননি। তারা মাঠে নেমেছেন। শ্রমিকরা মাঠে নামলে সবারই ক্ষতি হয়। আর সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হবে দেশের।’ তিনি বলেন, ‘পোশাকশিল্প এখন জাতীয় সম্পদ। এ খাতে আরও মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে। কিন্তু কিছু উসকানিদাতা ও দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারী পোশাকশিল্প ধ্বংস করতে ষড়যন্ত্র করছে। আমি শ্রমিকদের কাজে যোগদানের অনুরোধ জানিয়ে বলব, আপনারা রাজপথ ছেড়ে কাজে যোগ দিন। এই শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হলে আপনারাও ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। আর সংশোধনের পরও নতুন মজুরিকাঠামো নিয়ে আন্দোলন করার যৌক্তিকতা নেই।’ সম্মিলিত গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি নাজমা আক্তার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমরা শ্রমিকদের শুরু থেকেই কাজে ফিরে যাওয়ার জন্য বলেছি। শ্রমিকদের এটিও বুঝতে হবে, মজুরি বৃদ্ধিই মূল বিষয় নয়। এ ইস্যুতে প্রয়োজনে মালিকদের সঙ্গে শ্রমিকদের সমঝোতামূলক আলোচনায় যেতে হবে। আর তা না হলে শুধু শ্রমিকদের একার নয়, মালিকদের পাশাপাশি পুরো পোশাকশিল্পেরই ক্ষতি হবে। উৎপাদন প্রক্রিয়া ব্যাহত হবে। আবার শ্রমিকদের আরেকটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে, সেটি হচ্ছে, তারা যদি কাজে ফিরে না গিয়ে এ ধরনের বিক্ষোভ অব্যাহত রাখেন, তাহলে তারা শুধু আর্থিকভাবেই যে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন তা নয়, তাদের বিরুদ্ধে আইনানুনাগ ব্যবস্থাও গ্রহণ করা হবে। আর এমনটি হলে তাদেরই বেশি ক্ষতি হবে। আমি শ্রমিকদের কাজে ফিরে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করব। আর মজুরি বৃদ্ধির ক্ষেত্রে মালিকদের যেসব ত্রুটি-বিচ্যুতি আছে, সেগুলো বের করে শ্রমিকদের আলোচনায় বসতে হবে। আবার পোশাক উৎপাদন না হলে মালিকপক্ষ শ্রমিকদের বিপরীতে চলে যাবে। এতে সার্বিকভাবে শ্রমিকস্বার্থ ব্যাহত হবে।’ বাংলাদেশ নিটওয়্যার প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) প্রথম সহ-সভাপতি এস এম আসলাম সানী গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, মজুরি নিয়ে শ্রমিকদের অভিযোগ, অসন্তোষ ও আন্দোলনের মুখে তা সংশোধন করে বাড়ানো হয়েছে। কিছু মালিক ইতিমধ্যে মজুরি সমন্বয় করেছেন। দু-একটা কারখানা মজুরি সমন্বয় না করায় যে সমস্যা দেখা দিয়েছিল, তাও সমাধান হয়েছে। অধিকাংশ শ্রমিক কাজে ফিরেছেন। এখন যারা আন্দোলন করছেন, তারা পোশাকশিল্পকে বিশ্বে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলছেন। সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্টের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক রাজ্জেকুজ্জামান রতন বলেন, ‘এ মুহূর্তে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে শ্রমিকদের আস্থা অর্জন। আগে মজুরি ইস্যুতে শ্রমিকদের অসন্তোষ ছিল, যা পরে ভীতিতে পরিণত হয়েছে। শ্রমিকদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ বন্ধ করতে হবে। তাদের মধ্যে থাকা অসন্তোষ দূর করতে হবে। তাদের প্রতি করা হয়রানিমূলক আচরণ বন্ধ করতে হবে। আমরা শুনেছি, কারখানা এলাকায় কিছু লোক লাঠি হাতে শ্রমিকদের তাড়া করছে। আবার এও জানতে পেরেছি, ভীত অনেক শ্রমিক বাড়ি চলে যাচ্ছেন। এখন শ্রমিকদের যে লোকগুলো তাড়া করছে, তারা আসলে কারা সেটি চিহ্নিত করতে হবে। এই লোকগুলোর আচরণ বেশ রহস্যজনক। একই সঙ্গে শ্রমিকদের বিরুদ্ধে করা মিথ্যা মামলাগুলো প্রত্যাহার করতে হবে। শ্রমিকরা যেহেতু কারখানায় কাজ করতে এসেছেন, এ জন্য তাদের কাজে ফিরে যেতেই হবে। আর কারখানায় কর্মবান্ধব পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে প্রশাসন ও মালিকদের তৎপর হয়ে শ্রমিকদের আস্থা অর্জন করতে হবে। এটি করা না গেলে শ্রমিকরা কাজে ফিরে যাবেন না।’ এদিকে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) বাংলাদেশ অফিস রবিবার পোশাক খাতের শ্রমিকদের নতুন মজুরিকাঠামো গঠনের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে। তারা শ্রমিকবিক্ষোভ প্রতিরোধে শ্রম মন্ত্রণালয়ের গৃহীত এ পদক্ষেপের প্রশংসা করে।

সর্বশেষ খবর