শনিবার, ১৯ জানুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

বন্ধু লিটুকে বিদায় জানানোর শক্তি ও ভাষা আমার নেই

পীর হাবিবুর রহমান

সেই ১৯৯১ সাল। সেনাশাসন-উত্তর গণতন্ত্রের নবযাত্রা। সাংবাদিকতার পেশার তারে জীবন জড়িয়েছি। ছাত্রত্বের ধুলোবালি গা থেকে তখনো মুছে যায়নি। আড্ডা তখনো তুমুল নেশা। কাজ শেষ করে নিয়মিত টিএসসি থেকে শাহবাগে আড্ডায় ডুবি। সিলভানা মৌরির আড্ডা কখনো-সখনো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলা পর্যন্ত গড়ায়। কখনো শাকুরার গলিপথ ধরে হাঁটে। সেসব আড্ডায় অনেক বন্ধুর সঙ্গে সিলেট মেডিকেল থেকে এমবিবিএস পাস করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষায় অধ্যয়নরত ডা. সাঈদ যুক্ত হয়। প্রথাবিরোধী আরেক বোহেমিয়ান ডা. সাঈদকে নিয়ে রীতিমতো উপন্যাস লেখা যায়। সেই সাঈদ এক সন্ধ্যায় আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলে এই হলো ডা. লিটু। পাগল হলেও মনটা খুব ভালো। আলুথালু বেশ, উশকোখুশকো চেহারা মিলিয়ে এক খেপাটে ছিপছিপে সুন্দর চেহারার লিটু সেই যে মন কেড়েছিল তারপর দীর্ঘ পথ আমরা একসঙ্গে হেঁটেছি। একাডেমিকলি ও বয়সে আমার অনুজ হলেও দিনে দিনে লিটু আমার আত্মার বাঁধনে বাঁধা এক হৃদয়বান বন্ধুতে পরিণত হলো। যে বন্ধুকে আমি সহজে পাঠ করতে পারা অকৃত্রিম বন্ধুর চেয়েও বড় বেশি আপন কেউ বলে জেনেছি। জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট থেকে এমডি করা ডা. রাকিবুল ইসলাম লিটু রীতিমতো প্রথাবিরোধী একজন গণমুখী বিখ্যাত কার্ডিওলজিস্ট হয়েই ওঠেনি, গরিবের ডাক্তার হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছিল। বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো বৃহস্পতিবার রাতে ফেসবুক সুবাদে ইন্দোনেশিয়ায় বিয়ে করে বসতি গড়া যৌন ও চর্ম রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. এম এ করিম রেজার কাছ থেকে খবর পাই আমাদের বুকের ধন গভীর ভালোবাসা ও মমতার বন্ধনে বাঁধা ডা. লিটু মেসিভ হার্ট অ্যাটাক করে ল্যাবএইড হাসপাতালে ভর্তি। সঙ্গে সঙ্গে ল্যাডএইড হাসপাতালের কার্ডিওলজি বিভাগের সিনিয়র কনসালট্যান্ট ডা. মাহবুবুর রহমানকে ফোন করি। আমাদের বন্ধু ডা. মাহবুব হৃদয় ভেঙে দিয়ে জানালেন লিটুর অবস্থা সংকটাপন্ন। আগের রাতে হার্ট অ্যাটাক হলেও বিলম্বে বৃহস্পতিবার এসে ভর্তি হয়েছে। রক্তে সুগার অনেক বেশি। কিডনির অবস্থা জটিল ও হার্ট ফেইলর লিটুকে সিসিওতে রাখা হয়েছে। বুকটা ভারী হয়ে উঠল। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা হলো। কান্না আসছিল না। লিটুর এই পরিণতি মেনে নেওয়ার মতো ছিল না। শুক্রবার সকালে ঘুম থেকে উঠে বন্ধুবর নঈম নিজামের টেলিফোনে জানতে পারি লিটুকে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়েছে। লিটু পাগলামি আবদার নঈমও অনেক আনন্দে নিয়েছে। ডা. মাহবুবকে টেলিফোন করলে তিনি বলেন, বাঁচার সম্ভাবনা একদম ক্ষীণ। গোসল করে কাপড় পরে ছুটে যাই ল্যাবএইড হাসপাতালে। তিন তলার সিসিইউ কক্ষের বাইরে তিল ধারণের ঠাঁই নেই। প্রিয়জনের মৃত্যুতে আমি কখনো লাশ দেখি না। তার জীবন্ত ও প্রাণবন্ত চেহারাই স্মৃতির পর্দায় ধরে রাখি। সিসিইউ কক্ষে প্রবেশ করেই আমি বাকরুদ্ধ হয়ে যাই। ক্লিনিক্যালি ডেড লিটুর এই মুখ দেখে আমার শরীর অবশ হয়ে আসে। ডা. বরেণ চক্রবর্তী জানালেন, হাসপাতালে আসার পর তার হাই সুগার, কিডনির খারাপ অবস্থা ও ফুসফুসে জমে যাওয়া পানির জন্য এনজিওগ্রাম করা যায়নি। শুক্রবার সকালে তার এনজিওগ্রাম করা হলে হার্টের বাম ধমনির ব্লক ছুটিয়ে দেওয়া হলেও ড্যামেজ হার্ট আর ফাংশন করেনি। এভাবেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে চিরনিদ্রায় চলে যায় আমাদের অতি চেনা প্রাণবন্ত আমুদে হৈচৈ করা ডা. রাকিবুল ইসলাম লিটু। তার অকালমৃত্যুতে বাইরে সবার চোখে অশ্র“বিন্দু গড়িয়ে পড়ছে। কেউ কেউ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন। এই অকালমৃত্যুর শোক সহ্য করতে না পারা সমবেত শোকার্ত মানুষরা কেউ তার আত্মীয়পরিজন ছিলেন না। তাদের সঙ্গে রক্তের সম্পর্ক ছিল না। কিন্তু একজন চিকিৎসক হিসেবে একজন ভালো মানুষ হিসেবে ডা. লিটু দিনে দিনে তাদের চিকিৎসাসেবা ও ব্যবহার দিয়ে পরম আত্মীয়তে পরিণত করেছিলেন। আমার সঙ্গে বন্ধুত্ব হওয়ার পর ডা. লিটু কিছুদিন বারডেম হাসপাতালে স্বল্প বেতনে চাকরি করতেন। বড় ডাক্তার হয়ে মানুষের সেবা করার বড় স্বপ্ন দেখতেন বলে জব সেটিসফেকশন যেমন তার ছিল না তেমনি অফিস রাজনীতির যন্ত্রণা তাকে সইতে হয়েছিল। প্রেম করে বিয়ে করা বউ স্বামীর উপার্জনস্বল্পতার কারণে তাকে ছেড়ে দিয়ে লন্ডনে নতুন জীবন শুরু করেছিলেন। অশান্ত অস্থির সমাজের অসংগতি আর ব্যক্তিজীবনের বেদনা বুকে পুষে ডা. লিটু যুদ্ধ করে নিজেকে দিনে দিনে একজন বড় হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ হিসেবে তৈরিই করেননি, প্রথাবিরোধী চিকিৎসক হিসেবে গরিব রোগীদের জন্য বিনামূল্যে চিকিৎসা ও পকেটের টাকায় ওষুধ কিনে দেওয়ার কর্মকা  শুরু করেছিলেন। ব্রাইটন হাসপাতালে একদিন তার চেম্বারে বসা। এক গরিব মহিলা রোগীকে দেখে প্রেসক্রিপশন লিখে দিয়ে ফি নেওয়া দূরে থাক, পকেট থেকে ৫০০ টাকার নোট সঙ্গে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, মা, ওষুধের দাম বেশি, এটা দিয়ে ওষুধ কিনবেন। না হয় ভালো না হলে বলবেন ডাক্তার খারাপ। রসিকতার ছলে রোগীদের মন ভালো করে দিতেন। যে রোগী একবার লিটুর কাছে যেতেন তিনি আর পরে লিটু ছাড়া কাউকে বুঝতেন না। ফুর্তিতে কাজ করা লিটু কথায় কথায় রোগীকে হাসাতেন, আনন্দে রাখতেন এবং সুস্থ করে তুলতেন। মানসিক শক্তি জোগাতেন। ডা. লিটু শিকদার মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ল্যাবএইড হাসপাতাল, শেষে উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কার্ডিওলজি বিভাগের প্রধান হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে দায়িত্ব পালন করছিলেন। উত্তরার লুবানা হাসপাতালের পরিচালক হিসেবেও রোগীদের চিকিৎসা দিতেন। আমার গণমাধ্যম বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার সুবাদে অধ্যাপক ডা. রাকিবুল ইসলাম লিটু প্রায় সব গণমাধ্যমকর্মীর আপনজন হয়ে উঠেছিলেন। শুধু গরিবের ডাক্তারই নন, গণমাধ্যমকর্মী থেকে তার পরিচিতরা যে কোনো গরিব রোগী পাঠালে লিটুর কাছ থেকে বিনা চিকিৎসায় ফিরে আসতেন না। নিয়মিত লিখতেন ও টকশোয় যেতেন। গরিব রোগীদের জন্য পেশেন্ট ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তার প্রিয়জনদের তাতে যুক্ত করেছিলেন। গরিবের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে গাগলের মতো কাজ করে গেছেন। বিভিন্ন হাসপাতালের চিকিৎসাসেবার নিম্নমান, গলা কাটা ফি, বিভিন্ন প্যাথলজি টেস্টের উচ্চ ফি ও মুনাফালোভীদের বিরুদ্ধে অমিত সাহস নিয়ে একা লড়েছেন। তার কোনো আত্ম-অহংকার ছিল না। লোভ ছিল না। যখন তখন দিনরাত রোগীর পাশে ছুটে গেছেন। পছন্দ করে সুন্দরী বউ ঘরে তুলেছিলেন। প্রথমে যমজ সন্তান হয়েছিল। লিটু নাম দিয়েছিলেন রাজা-বাদশাহ। তৃতীয় সন্তান হলে তার নাম দেওয়া হলো সম্রাট। সারাক্ষণ হাসিখুশি প্রাণবন্ত লিটুকে কখনো ক্লান্তি স্পর্শ করত না। যত রাতই হোক মানুষের ডাক উপেক্ষা করতেন না। যেখানেই রোগী সেখানেই ডাক পড়লে ডা. লিটু হাজির। দেশ ও মানুষের প্রতি নিঃস্বার্থ ভালোবাসা ছিল তার। ক্লাস এইটের পরীক্ষার সময় তার বাবা ব্রেইন স্ট্রোক করে শয্যাশায়ী হন। এইচএসসি পরীক্ষাকালে হলে খবর যায় তার বাবা ইন্তেকাল করেছেন। পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়ে বুয়েট ও সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজে সুযোগ পান। মানবসেবার জন্য চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে এখানেই ভর্তি হন। নিজে বিত্তবৈভব, অর্থ-প্রতিপত্তি ও বিলাসী জীবনের মোহে আকৃষ্ট হয়নি। জীবনের যুদ্ধে কষ্টের দিনগুলোতে যারা পাশে ছিলেন তাদের নাম গর্বের সঙ্গে নিতেন। গরিবের জন্য নিয়মিত ভাবতেন। তার ব্যক্তিগত আনন্দ-বেদনা ও পেশাগত স্বপ্নের কথা বলতেন। লিটু চেয়েছিল একটি পিপলস হসপিটাল করতে, যেখানে বিত্তবানদের চিকিৎসা ফি থেকে বিনিয়োগকারীদের পুঁজি তুলে আনবেন। আর মুনাফা থেকে দুস্থ গরিব রোগীদের বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা দেবেন। আমার মেয়ে চন্দ্রস্মিতার দ্বিতীয় জম্ম  দিন ২০০৬ সালে জলজোছনার শহর সুনামগঞ্জের বাড়িতে উৎসবমুখর পরিবেশে করেছিলাম। বন্ধু লিটু দলবল নিয়ে উৎসবে হাজির হয়েছিল। লালনের গান গেয়েছিলেন। আর আমার মেয়ের জম্ম  দিনের উপহার হিসেবে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে ফি না নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। লিটু কথা রেখেছিলেন। অনেক হাসপাতাল থেকে ভুয়া চিকিৎসক ও ভুয়া অধ্যাপক ধরিয়ে দিয়েছেন তিনি। সত্য ও মানুষের কল্যাণের জন্য চিকিৎসাসেবা খাতকে একটি সেবামূলক বা মানবতার পরিচ্ছন্ন ইমেজের জায়গায় দাঁড় করাতে একা যুদ্ধ করে গেছেন। এই যুদ্ধ বিফলে যাবে না। তার দেখানো পথ নতুন প্রজম্ম  প্রসারিত করবে। এ দেশের চিকিৎসাসেবার জন্য ডা. রাকিবুল ইসলাম লিটুর দীর্ঘদিন বেঁচে থাকা ও ভূমিকা রাখার বড় বেশি প্রয়োজন ছিল। বিনা নোটিসে এভাবে হুট করে লিটুর প্রস্থান গভীর বেদনা ও শোকেরই নয়, দেশের জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি। একজন প্রিয় মানুষ ও পরম আত্মার আত্মীয় বা আবেগমথিত হৃদয়ের গভীরে বাস করা হৃদয়বান বন্ধু ডা. লিটুর এই অকালমৃত্যু মেনে নেওয়ার নয়। লিটু নিজের প্রতিই অবহেলা করেনি, নিজেকেই ফাঁকি দেননি, আমাদের ফাঁকি দিয়েছেন। তার গরিব রোগীদের ফাঁকি দিয়েছেন। এই অকাল বিদায় মেনে নেওয়ার নয়। সমাজের জন্য বিভিন্ন পেশায় বিভিন্ন সময় যেসব আলোকিত সোনার সন্তানরা অকালে বিদায় নিয়েছেন তারা প্রিয়জনদের কাঁদিয়েই চলে গেছেন। এত এত প্রিয়জন, এত এত মানুষকে কাঁদিয়ে ডা. লিটুর বিদায়ও তাদের মতোই। এই মৃত্যু মেনে নেওয়ার নয়। এই শোক সইবার নয়। আমার চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। আমার বুক ভারী হয়ে আসছে। বন্ধু লিটু, তোমাকে বিদায় জানানোর শক্তি ও ভাষা আমার নেই। যেখানেই থাকো, ভালো থেকো। হাশরের ময়দানে তোমার সেবা পাওয়া, তোমার সান্নিধ্য পাওয়া ও তোমার মৃত্যু সংবাদে অশ্র“জলে ছুটে যাওয়া মানুষেরা সাক্ষ্য দেবে তুমি মানবতার চিকিৎসক ছিলে। তুমি একজন ভালো মানুষ ছিলে।

সর্বশেষ খবর