বৃহস্পতিবার, ২৪ জানুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

গলার কাঁটা লিজের বিমান

বৈমানিক নিয়োগে বারবার বিজ্ঞপ্তি পরিবর্তন

নিজস্ব প্রতিবেদক

বিকল হয়ে পড়ে থাকা মিসরের ইজিপ্ট এয়ার থেকে লিজে আনা দুটি উড়োজাহাজের জন্য প্রতি মাসে ১০ কোটি টাকা লোকসান গুনতে হচ্ছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসকে। ২০১৪ সালে পাঁচ বছরের জন্য দুটি উড়োজাহাজ ‘বোয়িং ৭৭৭-২০০ ইআর’ লিজে এনেছিল রাষ্ট্রীয় এয়ারলাইনস। কোনো আয় না হলেও বিপুল পরিমাণ লোকসানে বিমান বাংলাদেশের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে লিজের এ বিমান দুটি।

লোকসানে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বেসামরিক বিমান পরিবহন প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী ও সচিব মহিবুল হক। গত রবিবার প্রথমবারের মতো বিমানের প্রধান কার্যালয় বলাকায় গিয়ে তিনি এ বিষয়ে কথা বলেন। এদিকে রাষ্ট্রীয় উড়োজাহাজ পরিবহন সংস্থা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসে চলছে বৈমানিক সংকটও। সংকট উত্তরণে বৈমানিক নিয়োগের প্রক্রিয়াও প্রায় শেষ পথে। তবে অভিযোগ উঠেছে, বিশেষ প্রার্থীকে নিয়োগ দিতে একাধিকবার নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি পরিবর্তন করেছে বিমানের মানবসম্পদ বিভাগ।

বিমানসূত্রে জানা গেছে, মিসরের ইজিপ্ট এয়ার থেকে পাঁচ বছরের চুক্তিতে ড্রাই লিজে দুটি বোয়িং ৭৭৭-২০০ ইআর উড়োজাহাজ নিয়ে আসে বিমান। ২০১৪ সালের মার্চে একটি উড়োজাহাজ (রেজিস্ট্রেশন নম্বর এস২-এএইসএল, কনস্ট্রাকশন নম্বর ৩২৬৩০) বিমানের বহরে যুক্ত হয়। অন্য উড়োজাহাজটি (রেজিস্ট্রেশন নম্বর এস২-এএইসকে, কনস্ট্রাকশন নম্বর ৩২৬২৯) যুক্ত হয় একই বছরের মে মাসে। চুক্তি অনুসারে উড়োজাহাজ দুটি যাত্রী পরিবহন করুক আর না করুক, মাসে উড়োজাহাজপ্রতি ৫ লাখ ৮৫ হাজার ডলার (৪ কোটি ৭০ লাখ ১৬ হাজার টাকা) ভাড়া দিতে হবে। সব ধরনের রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় বহন করতে হবে। পাঁচ বছর আগে চুক্তি বাতিল করতে পারবে না বিমান। লিজের মেয়াদ শেষে উড়োজাহাজ দুটি আগের অবস্থায় (ভাড়া নেওয়ার সময় যে অবস্থায় ছিল) ফেরত দিতে হবে। বিমানবহরে যুক্ত হওয়ার এক বছর পরই লিজে আনা বোয়িং ৭৭৭-২০০ উড়োজাহাজের একটির ইঞ্জিন বিকল হয়ে যায়। পরে ইজিপ্ট এয়ার থেকে প্রতি মাসে প্রায় ৮ লাখ টাকায় ভাড়ার ইঞ্জিন দিয়ে সচল করা হয় উড়োজাহাজটি। নষ্ট ইঞ্জিনটি মেরামতের জন্য পাঠানো হয় লন্ডনভিত্তিক ইউনাইটেড এয়ারলাইনসে। সেই ইঞ্জিন মেরামত করে ফেরত আনার আগেই তিন বছরের মাথায় আবারও নষ্ট হয় ইঞ্জিন। তখনো ইজিপ্ট এয়ার থেকে প্রতি মাসে প্রায় ৮ লাখ টাকায় ভাড়া আনা হয় আরেকটি ইঞ্জিন। বিকল ইঞ্জিনটি মেরামতের জন্য পাঠানো হয় ইউনাইটেড এয়ারলাইনসে। বিমান দুটি ফেরত দিতে গত বছর ২৯ আগস্ট পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগের জন্য বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস আন্তর্জাতিক পরিসরে দরপত্র আহ্বান করে। সর্বনিম্ন খরচে লিজের চুক্তি পর্যবেক্ষণ করে উড়োজাহাজ দুটি ফেরত দেবে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান।

এসব বিষয়ে বৈঠকে বিমান মন্ত্রণালয়ের সচিব মহিবুল হক বিমানের ব্যবস্থাপক (পরিচালনা) ও সিইও মোসাদ্দিক আহমেদের কাছে জানতে চান লিজে আনা উড়োজাহাজের জন্য কত দিন বিমানকে লোকসান গুনতে হবে? এ সময় মোসাদ্দিক আহমেদ বলেন, ‘এ উড়োজাহাজ দুটি নেওয়ার পর থেকেই ইঞ্জিন মেরামতের জন্য আমাদের যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছিল। ইঞ্জিন যখন শপে (ওয়ার্কশপে) গেল, সেখানে স্পেয়ার্স পার্টস পাওয়া যাচ্ছিল না। এ কারণে ইঞ্জিনগুলো ফেরত আসছিল না।’ তখন মন্ত্রণালয়ের সচিব প্রশ্ন তোলেন, ‘বাংলাদেশ থেকে যে টেকনিশিয়ান যাচ্ছেন, তারা মিসরে ইজিপ্ট এয়ারের সঙ্গে মিলে গেলেন কিনা, কিংবা ইজিপ্ট নিজেরাই কোনো অনৈতিক কাজ করছে কিনা? এসব বিষয় দেখার কথা তো বলেছিলাম। কিন্তু আমরা এ ব্যাপারে আর কিছু জানতে পারিনি। এ দুই উড়োজাহাজ অনাদিকাল ধরে যদি এভাবে থাকে, তবে বিমানের ভিটায় ঘুঘু চড়তে সময় লাগবে না। ১২ মাসে ১০ কোটি টাকা করে ১২০ কোটি টাকা কোনো কারণ ছাড়া লস গুনছে বিমান এবং আরও কত দিন লস গুনবে তারও কোনো ইয়াত্তা নেই।’ এসব বিষয়ে বিমান কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক শেষে প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা বৈঠকে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। এ মাসের মধ্যেই যাদের কাছ থেকে লিজ নেওয়া হয়েছে, তাদের সঙ্গে বসবেন বিমান মন্ত্রণালয়ের সচিব ও বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক।’ তিনি আরও বলেন, ‘তারা দায়দায়িত্ব মুক্তির ব্যাপারে আলোচনা করবেন। বিমানগুলো ভিয়েতনামে পাঠানো হয়েছে। কিছু ক্ষতিপূরণ দিয়ে হলেও এ দায় থেকে আমাদের অব্যাহতি পেতে হবে।’

এদিকে অভিযোগ উঠেছে, বিশেষ প্রার্থীকে নিয়োগ দিতে একাধিকবার নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি পরিবর্তন করেছে বিমানের মানবসম্পদ বিভাগ। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস সূত্রে জানা গেছে, ২০১৮ সালে বৈমানিক নিয়োগের একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে বিমানের মানবসম্পদ উপবিভাগ। বিজ্ঞপ্তিতে প্রার্থীর যোগ্যতা হিসেবে এসএসসি ও এইচএসসি (গণিত, পদার্থবিজ্ঞানসহ) অথবা সমমানের ন্যূনতম জিপিএ-৩ থাকার কথা বলা হয়। এ ছাড়া ও-লেভেল এবং এ-লেভেল হলে গ্রেড বি থাকা প্রার্থীরা অংশ নিতে পারবেন। বিজ্ঞপ্তিতে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়, জিইডি ডিগ্রিধারীরা এতে অংশ নিতে পারবেন না। বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) থেকে কমার্শিয়াল পাইলট লাইসেন্সধারীরা (সিপিএল) অথবা বেবিচক থেকে এনডোর্স করা ব্যক্তিরা প্রার্থী হতে পারবেন। ২০১৮ সালে বিমানের ওই বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার কিছু দিন পর আবারও সংশোধন আনা হয়। এতে জিইডি ডিগ্রিধারীদের ব্যাপারে কিছু বলা হয়নি। ফলে তারাও আবেদনের সুযোগ পান এবং লিখিত পরীক্ষায় অংশ নেন। পাঁচ-সাত জন প্রার্থী পাসও করেছেন। এ ছাড়া বোয়িং ৭৩৭ ও ড্যাস-৮ উড়োজাহাজ চালানোর অভিজ্ঞতাসম্পন্নদের ক্ষেত্রে আবেদনের যোগ্যতা সর্বোচ্চ ৩০ বছরের (মুক্তিযোদ্ধার সন্তানের ক্ষেত্রে ৩২ বছর) পরিবর্তে ৪০ বছর পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। এভাবে বার বার নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি পরিবর্তন করে বিশেষ কোনো ব্যক্তিকে সুযোগ দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে। তবে কর্তৃপক্ষ দাবি করছে, ২০১৮ সালে প্রথম যে বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছিল, তাতে অনেক কম আবেদন পড়ে। এ কারণে পরবর্তী সময়ে আবার সংশোধন করে বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়, যেন আরও বেশি প্রার্থী আবেদন করতে পারেন। বিশেষ কোনো ব্যক্তিকে সুযোগ দিতে এটি করা হয়েছে বলে যারা অভিযোগ করছেন, তারা ঠিক বলছেন না।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর