সোমবার, ২৮ জানুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

দলে ঘাপটি মেরে থাকা চলবে না

----------- ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী

দলে ঘাপটি মেরে থাকা চলবে না

জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য ও গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেছেন, বিএনপিকে ঘাপটি মেরে বসে থাকা চলবে না। অতি দ্রুত কাউন্সিলের মাধ্যমে দলে নতুন নেতৃত্ব আনতে হবে। এতে দল গতিশীল হবে। গতকাল দুপুরে রাজধানীর সাতমসজিদ রোডে নিজ বাসভবনে বাংলাদেশ প্রতিদিনের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা বলেন। ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, যখনই দলের নতুন কমিটি হবে তখন নেতা-কর্মীরা মিটিং-মিছিল করা শুরু করবে। তারা রাজনৈতিক কর্মকা  চালাতে চেষ্টা করবে। এখনকার মতো ঘাপটি মেরে বসে থাকলে চলবে না। তাছাড়া মামলা-হামলাসহ তাদের অনেকেরই ব্যবসা-বাণিজ্য বা বয়োবৃদ্ধতার কারণে পিছুটান রয়েছে। এ জন্যই তরুণ নেতৃত্ব জরুরি। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি ও নির্বাচনের অনিয়ম তুলে ধরে বিএনপির প্রার্থীদের একদিন আধাবেলা অনশন কর্মসূচি দেওয়ার পরামর্শও দেন। এ ছাড়া সামনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ নির্বাচনে বিএনপির সহযোগী সংগঠন ছাত্রদলকে অংশ নেওয়ারও অনুরোধ করেন তিনি। ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, থমকে যাওয়া নেতা-কর্মীদের নাড়া দেওয়ার জন্যই বিএনপির কাউন্সিল করা উচিত। কাউন্সিলে গঠনতন্ত্রে কিছু সংশোধনী আনতে হবে। এখনকার গঠনতন্ত্রে চেয়ারপারসনকে সব ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। সেই ক্ষমতার কিছুটা কাটা দরকার। দ্বিতীয়ত, স্থায়ী কমিটি বয়োবৃদ্ধের ভারে জড়াক্রান্ত। নড়তে-চড়তে পারে না। এটাকে নতুনভাবে সাজাতে হবে। সেখানে মহিলাদের সংখ্যা বাড়াতে হবে। যারা সরাসরি মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন, যুদ্ধে ফ্রন্টে কাজ করেছেন, তাদের রাখতে হবে। তিনি বলেন, তাদের উচিত হবে ২০ দল ভেঙে দেওয়া। এটা থাকার কোনো মানে হয় না। কর্নেল অলিকে আবার দলে ফেরত নেওয়া উচিত। তাহলেই বিএনপি পুনরুজ্জীবিত হবে। আর কাউন্সিলের মাধ্যমে সবাইকে নির্বাচিত হতে হবে। কাউকে মনোনিত করা যাবে না। নির্বাচনে বিএনপির ধসের কারণ কীÑজানতে চাইলে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, ধস তো নামেনি। নির্বাচনে লুন্ঠন হয়েছে, ভোট ডাকাতি হয়েছে। তবে বিএনপি দীর্ঘদিন ধরে মাঠে ছিল না। বিএনপিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাধ্যমে নামতেই দেওয়া হয়নি। প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, তফসিল ঘোষণার পর এমনটা হবে না। কিন্তু তিনি তার কথা রাখেননি। রাজনৈতিকভাবে গ্রেফতার হওয়াদের তালিকা চেয়েছিলেন। দেওয়ার পর গ্রেফতার আরও বেড়ে যায়। এত বড় বিপর্যয় ঘটে গেল, আমরা একটা মামলা পর্যন্ত করতে পারিনি। প্রিসাইডিং অফিসাররা কাগজপত্র দিচ্ছেন না। তারা বলছেন, আমাদের বিপদে ফেলবেন না। এসব না করার জন্য বলছে তারা। দেশের যে অবস্থা কোথাও কথা বলা যাবে না। আমার মনে হয় মানুষ আপাতত থমকে গেছে। তিনি বলেন, বিএনপিতে তারেক রহমান খুবই জনপ্রিয়, এটা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু তিনি যে পদ্ধতিতে হয়েছেন, তা সঠিক ছিল না। তিনি তো দেশেই আসতে পারছেন না। বিদেশের মাটিতে বসে এত বড় দলকে নিয়ন্ত্রণ করা সহজ কাজ নয়। ফলে ফোনে বা স্কাইপে কাজ করলে ভুলভ্রান্তি আসবেই। এখন পর্যন্ত বিএনপির নেতা ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। নির্বাচনের এক মাসের মধ্যে কর্মসূচি নেই। এ জন্য কি সে দায়ী না স্থায়ী কমিটি দায়ী? তারেক রহমান ও বেগম খালেদা জিয়া বিএনপির প্রাণ আখ্যা দিয়ে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু যেই মা সন্তানের জন্য সবকিছু করে তাকেও সন্তানকে এক সময় ছেড়ে দিতে হয়। তাহলে সে তাড়াতাড়ি হাঁটতে শিখতে পারে। আমার মতে, তারেক রহমানকে দুই বছরের জন্য অব্যাহতি নেওয়া উচিত। তিনি বিলাতে বসে পড়াশোনা করুন। এতে বিএনপি নেতা-কর্মীরা নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে শিখতে পারবে। এখন কোনো কিছ্ ুহলেই বিলাতের অজুহাত দেওয়া হয়। তিনি কিছু দিনের জন্য অবসরে থাকলে বন্ধ হয়ে যেত। ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, তারেক রহমান ভবিষ্যতে একদিন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হবেন। কিন্তু আজকে তার উচিত হবে, দুই বছরের জন্য সরে দাঁড়ানো। তাহলেই পার্টিটা আরও পুনরুজ্জীবিত হবে। আর দলে মনোনয়ন বাণিজ্য বন্ধ করতে হবে। বেগম জিয়া প্রসঙ্গে বলতে চাই, তিনিই বিএনপিকে আজ এতদূর নিয়ে এসেছেন। কিন্তু তিনি জেলে রয়েছেন। তার মুক্তি দাবি করছি। কিন্তু তার ওপরও সব দায়িত্ব চাপানো উচিত হবে না শারীরিক কারণে কিংবা মানসিক কারণে। তাই তাকে ইমেরিটাস চেয়ারপারসন করে তার কাছ থেকে দলের পরামর্শ নেওয়া উচিত। কিন্তু তিনি কাউকে বহিষ্কার করতে পারবেন না, কাউকে নিতেও পারবেন না।  বিএনপি নেতা-কর্মীরা তার পরামর্শ নিতে বাধ্য থাকবেন। কিন্তু দল পরিচালনার দায়িত্বটা তার হাতে থাকবে না। এটা আমার প্রস্তাব। কিন্তু সিদ্ধান্ত তারা দলীয় কাউন্সিলেই নেবেন।

গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের এই প্রতিষ্ঠাতার মতে, নতুন স্থায়ী কমিটির দায়িত্ব হবে, আগামী এক বছরের জন্য তাদের কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ। তাদের আন্দোলনের কর্মসূচি নিতে হবে। যারা একাদশ জাতীয় নির্বাচনে প্রার্থী ছিলেন তাদের সবাইকে নিয়ে আধাবেলা গণঅনশন করা উচিত।

কারণ, বেগম জিয়াও নিয়মতান্ত্রিক কর্মসূচি করতে বলেছেন। আরেক দিন গণতন্ত্রের মৃত্যুর কফিন সাজিয়ে অবস্থান ধর্মঘট করতে পারে। ঢাকা থেকে শুরু করে পর্যায়ক্রমে প্রতিটি জেলা-উপজেলায় এসব কর্মসূচি করতে পারে বিএনপি। তাদের জাতীয় সংলাপের মাধ্যমে স্থির করতে হবে, তারা সংসদে যাবেন কি যাবেন না। আমার পরামর্শটা খোলামনে তারা দেখতে পারেন। গ্রহণ করা না করা তাদের ব্যাপার।

জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট কীভাবে কারা পরিচালনা করছে? কোন লক্ষ্যে এগোচ্ছে ঐক্যফ্রন্ট? এ বিষয়ে জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা ড. কামাল হোসেন। লিখিতভাবে না হলেও এটাই স্বীকৃত। এ ছাড়া একটি স্টিয়ারিং কমিটি ও একটি কো-অর্ডিনেটর কমিটি রয়েছে। এর প্রধান শরিক দল বিএনপি। জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট আছে, আরও থাকবে। সামনে জাতীয় সংলাপ রয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল, জাতির কাছে দিকনির্দেশনা চাওয়া। নিজেরা বলব কম, শুনব বেশি। জাতীয় সংলাপে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের পরামর্শ নিয়ে সামনে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের এগোতে হবে। সবাই যদি না চায়, তাহলে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট থাকবে না। যার যার মতো পথ চলবে।

বিএনপিকে সংসদে যাওয়ার অনুরোধের পক্ষে আপনার যুক্তি কি-এমন প্রশ্নে জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, আমার যুক্তিটা হলো, সদ্য সমাপ্ত নির্বাচনটি একটি ভাঁওতাবাজির ভোট হয়েছে। যা-ই কিছু হোক জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ৮ জন এমপি নির্বাচিত হয়েছেন। তারা সংসদের ভিতরে-বাইরে দুই জায়গায় এ নিয়ে প্রতিবাদের ঝড় তুলতে পারবেন। এ কারণে আমি ব্যক্তিগতভাবে তাদের সংসদে যেতে বলেছি। এটা একান্তই আমার ব্যক্তিগত মত। এ নিয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট যে কোনো সিদ্ধান্তই নিতে পারে। নির্বাচন নিয়ে ট্রাইব্যুনালেও মামলা করা উচিত। কিন্তু বিএনপি করতে পারবে বলে মনে হয় না। তবে প্রতীকীভাবেও করা যেতে পারে। যদিও রায় আমাদের পক্ষে আসবে না।

জামায়াতকে নিয়ে বিএনপি জোটে অনেক সমালোচনা রয়েছে? জামায়াতকে বিএনপির ছাড়া উচিত কিনা-জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি মনে করি, শিগগিরই বিএনপির কাউন্সিল করা উচিত। সেখানে তাদেরকে জামায়াত ছাড়ার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিতে হবে। তবে আমার মতে, জামায়াত যদি তাদের অতীত কৃতকর্মের জন্য জনসাধারণের কাছে ক্ষমা চায়, তাদের নেওয়া যেতে পারে। যদি না চায়, তাহলে বিএনপিকে জামায়াত ছেড়ে দেওয়াই হবে মঙ্গলজনক। কারণ তাদের নিয়ে দেশে-বিদেশে নানা বিতর্ক আছে। জঙ্গিবাদের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগও আছে এ সংগঠনটির বিরুদ্ধে। এটা বিএনপির জন্য বাড়তি ঝামেলা।

বিএনপি শাসনামলে দশ ট্রাক অস্ত্র মামলা, ২১শে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার মতো ঘটনা ঘটেছিল। এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বিএনপির অবস্থান ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন ছিল কিনা? এ প্রসঙ্গে জাফরুল্লাহ চৌধুরীর মন্তব্য হলো, ২১ আগস্টের ঘটনা খুবই মর্মান্তিক। এটা যারা করেছে, কাপুরুষতার পরিচয় দিয়েছে। অবশ্যই প্রকৃত দোষীদের শাস্তি হওয়া উচিত। বিএনপিকেও এর নিন্দা করা উচিত। আমি মনে করি না, বিএনপি এখানে দোষী। তবে দোষীদের শাস্তি দিতে তৎকালীন বিএনপি সরকারেরও উদ্যোগ নেওয়া উচিত ছিল। আর ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলার ঘটনা ভিন্ন। বাংলাদেশ গঠন হওয়ার পর সব রাষ্ট্রপ্রধানই এর পৃষ্ঠপোষকতা করে এসেছেন। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সবারই সতর্ক থাকা উচিত।

ভোটের আগে ব্যবসায়ী, সাংবাদিক, শিল্পীসহ সব পেশাজীবীর সঙ্গে আলোচনার কোনো উদ্যোগ নেয়নি বিএনপি। এটাকে আপনি কীভাবে দেখছেন? এ বিষয়ে জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, ভোটের আগে নানামুখী সমস্যায় ছিল বিএনপি। কারও সঙ্গে কোনো বৈঠক করতে গেলে স্থানের প্রয়োজন। কিন্তু বিএনপিকে তা দেওয়া হয়নি। অন্যদিকে সরকারে থাকায় সেই সুবিধার পুরোটাই ভোগ করেছে আওয়ামী লীগ। তারা সবার সঙ্গেই কথা বলেছে। সবাইকে নিয়ে নির্বাচনী প্রচারণাও চালিয়েছে। কিন্তু বিএনপির প্রার্থীরাও প্রচারণায় নামতে পারেননি। তাদেরও আঘাত করা হয়েছে। তাছাড়া ঐক্যফ্রন্ট প্রচারণায় তেমন সময়ও পায়নি। আর অন্তত দুই সপ্তাহ সময় পেলে প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও সবার সঙ্গে কথা বলা যেত।

গণমাধ্যমের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য কী করার আছে বলে আপনি মনে করেন? এ প্রসঙ্গে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, মিডিয়া নিয়ে বিএনপি তেমন কিছুই ভাবে না। তারা গণমাধ্যমবান্ধবও নয়। সাংবাদিকদের সঙ্গে বিএনপির যোগসূত্র আরও বাড়ানো উচিত বলে আমি মনে করি। ‘প্রো মিডিয়া পলিসি’র উদ্যোগ নিতে হবে বিএনপিকে। তা ছাড়া গণমাধ্যমের অধিকাংশ মালিকই আওয়ামী লীগ পন্থি। তাই তারা বেশি আওয়ামী লীগকে সমর্থন করে।

সর্বশেষ খবর