বুধবার, ৩০ জানুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

হঠাৎ শ্রমবাজারে স্থবিরতা

লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৫ লাখ কম কর্মী প্রেরণ, মালয়েশিয়া এখন বন্ধ, সৌদি আরবের ভিসা বিক্রি হচ্ছে ১২-১৫ লাখ টাকায়, মধ্যপ্রাচ্যের বেশির ভাগ বাজার বন্ধ

জুলকার নাইন

হঠাৎ করেই বন্ধ হয়ে যাওয়া বাংলাদেশের অন্যতম শ্রমবাজার মালয়েশিয়ায় এক অদৃশ্য সংকটে আটকে আছে জনশক্তি রপ্তানি। জিটুজি প্লাস পদ্ধতি বন্ধ করার পর সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলেও পাঠানো যাচ্ছে না শ্রমিক। দেশটির অনেক প্রতিষ্ঠান শ্রমিকদের চাহিদাপত্র চেয়ে সংশ্লিষ্ট বিভাগে জমা করলেও মিলছে শুধুই আশ্বাস। ফলে মালয়েশিয়ায় বৈধভাবে জনশক্তি প্রেরণ এক রকম থমকে গেছে। কবে খুলবে এই বন্ধ দুয়ার তা জানে না কেউ। কিন্তু থেমে নেই হয়রানি। অবৈধ উপায়ে পাঠানোর হাতছানি দিয়ে বিভিন্নজনের কাছে টাকা, পাসপোর্ট নিয়ে নিচ্ছে দালাল চক্র। একই সময়ে সৌদি আরবও কমিয়ে দিয়েছে জনশক্তি আমদানি। ফলে সৌদি আরবের ভিসা ট্রেডিং ব্যবসা চলছে রমরমা। কিছুদিন আগেও দালালরা যে ভিসা বিক্রি করেছে ছয়-সাত লাখ টাকায়, সেই ভিসার দাম এখন হাঁকা হচ্ছে ১২ থেকে ১৫ লাখ টাকা।

জানা যায়, ২০১৮ সালে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় ৫ লাখ কম কর্মী পাঠানো হয়। ২০১৮ সালে ১২ লাখ কর্মী পাঠানোর লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও বাস্তবতা হলো, কর্মী গেছেন সাড়ে সাত লাখের মতো। এই সময়ে মালয়েশিয়া ও সৌদি আরব ছাড়া বাকি দেশগুলোতে খুব একটা কর্মী যাননি। এর মধ্যেই বছরের শেষ দিকে বন্ধ হয়ে যায় মালয়েশিয়ার দুয়ার। শুধু লক্ষ্যমাত্রার চেয়েই কম নয়, ২০১৮ সালে তিন বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম সংখ্যক কর্মী বিদেশে চাকরি নিয়ে গেছেন। অথচ ২০১৭ সালে রেকর্ডসংখ্যক কর্মীর কর্মসংস্থান হয়েছিল। ওই বছর ১০ লাখ ৮ হাজার কর্মী বিভিন্ন দেশে চাকরি পান। আর ২০১৮ সালে বিদেশে চাকরি পেয়েছেন মাত্র ৭ লাখ ৩৪ হাজার ১৮১ জন। প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় বলছে, বিভিন্ন শ্রমবাজারে নানা ধরনের সমস্যা তৈরি হওয়ায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। টার্গেটের চেয়ে অনেক কম কর্মী নিয়োগ হওয়ার পেছনে মন্ত্রণালয়ের কোনো ত্রুটি নেই। শ্রমবাজারগুলোতেই বড় সমস্যা হয়েছে। সৌদি আরব কর্মী নিয়োগ কমিয়ে দিয়েছে। এ ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশে কর্মী নিয়োগ দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ রয়েছে। মালয়েশিয়া হঠাৎ করে গত বছরের মাঝামাঝি কর্মী নিয়োগ বন্ধ করে দেয়। এ ছাড়া গত বছর নভেম্বরে সৌদি আরব সরকার ‘সৌদিকরণ কর্মসূচি (প্রতি কারখানায় ২০ শতাংশ সৌদি নাগরিক থাকা বাধ্যতামূলক)’ শুরু করেছে। এর মাধ্যমে প্রবাসীদের জন্য ১২ ধরনের চাকরি বন্ধ ঘোষণা করেছে সৌদি সরকার। এতে সে দেশের শ্রমবাজার আস্তে আস্তে বাংলাদেশিদের জন্য সংকুচিত হয়ে আসছে। ইতিমধ্যে এসব কাজে জড়িত বাংলাদেশিরা দেশে ফিরতে শুরু করেছেন।

পরিসংখ্যান অনুসারে, শুধু সৌদি আরব নয়, মধ্যপ্রাচ্যের প্রচলিত বাজারগুলোর বেশির ভাগেই নিয়োগ কমে গেছে। ২০১৭ সালে সৌদি আরবে নিয়োগ পায় ৫ লাখ ৫১ হাজার শ্রমিক। তবে পরের বছর নিয়োগ কমিয়ে দেয় সৌদি আরব। ফলে ২০১৮ সালে এসে সেখানে নিয়োগ পায় ২ লাখ ৫৭ হাজারের কিছু বেশি। বাহরাইনে ২০১৭ সালে ২০ হাজার কর্মী পাঠানো গেলেও ২০১৮ সালে পাঠানো সম্ভব হয়েছে মাত্র ৮০০। ২০১৭ সালে ২০ হাজারের বেশি পাঠানো জর্ডানে ২০১৮-তে গেছেন মাত্র সাড়ে ৯ হাজার। কুয়েতেও রপ্তানি কমেছে অর্ধেক। সেখানে ২০১৭ সালে ৫০ হাজার কর্মী পাঠানো সম্ভব হলেও ২০১৮ সালে পাঠানো হয়েছে ২৭ হাজারের মতো। এক সময় দুই থেকে চার লাখ কর্মী যাওয়া আরব আমিরাতে ২০১৮ সালে কর্মী পাঠানো সম্ভব হয়েছে মাত্র ৩ হাজার। কর্মকর্তারা বলছেন, মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশে শ্রমবাজারে কিছুটা সমস্যা রয়েছে। সমস্যা দূর না হওয়ার কারণেও কর্মী নিয়োগ কম হয়েছে। যদিও মন্ত্রণালয় সমস্যা থাকা দেশগুলোর সঙ্গে দফায় দফায় আলাপ-আলোচনা চালিয়ে গেছে। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। প্রতিটি দেশ শুধু আশা জাগিয়েছে। দেশগুলোর প্রতিনিধিরা বাংলাদেশ সফর করে আশ্বাসও দিয়েছিলেন শ্রমবাজার খুলে দেওয়ার। তারা শুধু কথার কথাই বলেছেন, কাজের কাজ কিছু হয়নি। প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব রৌনক জাহান বলেছেন, নতুন বছরে নতুন বাজার খোলার দিকেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। আরও কয়েকটি শ্রমবাজার চালুর জন্য কাজ চলছে। একই সঙ্গে বন্ধ থাকা মালয়েশিয়া ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে আবারও কর্মী পাঠানোর প্রক্রিয়া বেশ এগিয়েছে বলে জানান সচিব।

মালয়েশিয়ায় বাজার চালু নিয়ে অনিশ্চয়তা : মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার খোলার বিষয়ে মালয়েশিয়ায় সর্বশেষ যৌথ ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় গত বছর সেপ্টেম্বরে। এরপর দুই দেশের মধ্যে আর কোনো বৈঠক হয়নি। কুয়ালালামপুরে বাংলাদেশ হাইকমিশন দেশটির কর্তৃপক্ষের কাছে বৈঠক আয়োজনে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে তেমন কোনো সফলতার খবর নেই। মন্ত্রণালয় থেকেও মালয়েশিয়া কর্তৃপক্ষের কাছে চিঠি দিয়ে বৈঠকের কথা জানানো হয়েছে। কিন্তু মালয়েশিয়া কর্তৃপক্ষ বৈঠকের বিষয়ে ইতিবাচক কোনো সাড়া দেয়নি। ফলে মালয়েশিয়ায় কর্মী নিয়োগের বিষয়টি অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে। প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ঢাকার বৈঠকের পর কুয়ালালামপুরে বৈঠক হয়। কুয়ালালামপুরের বৈঠকটি ফলপ্রসূ মনে হয়েছিল। কিন্তু দিন যত যাচ্ছে মালয়েশিয়ায় কর্মী নিয়োগের বিষয়টি আরও জটিল হচ্ছে। মালয়েশিয়ার কর্তৃপক্ষের কাছে বৈঠকের সময় চেয়ে চিঠি দিলেও তারা কোনো সাড়া দিচ্ছে না। ইতিমধ্যে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় কয়েক দফা চিঠি দিয়েছে।

বৈধ যাত্রার সংকটে বাড়ছে অবৈধ যাত্রা : সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এমনিতেই অনিয়মিত অভিবাসনও বাংলাদেশের জন্য একটা বড় সমস্যা। বৈধ পথের শ্রমবাজারের স্থবিরতার জন্যই এ সংকট আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। বাড়ছে অবৈধ যাত্রা। ইউরোপীয় কমিশনের পরিসংখ্যান দফতর ইউরোস্ট্যাটের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০০৮ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত এক লাখেরও বেশি বাংলাদেশি ইউরোপের দেশে দেশে অবৈধভাবে প্রবেশ করেছেন। এ বছরের শুরুতে ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ দাবি করেছে, প্রতি বছর ভারতে বাংলাদেশ থেকে গড়ে ৫০ হাজার নারী পাচার হয়। বছর তিনেক আগেও সাগর পথে হাজারো মানুষের মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডে যাওয়ার কারণে বাংলাদেশসহ বিশ্বজুড়ে আলোচনা ছিল। আবার মিয়ানমারের বিপুলসংখ্যক নাগরিক বাংলাদেশে প্রবেশ করেছেন। ফলে পাচারের ঝুঁকি থাকছেই। ছাত্র ও পর্যটক সাজিয়ে বিভিন্ন দেশে লোক পাঠানোসহ নানা উপায়ে বাংলাদেশ থেকে বিদেশে যাওয়ার চেষ্টা থেমে নেই। বাংলাদেশ যখন মধ্যম আয়ের দেশের দিকে যাচ্ছে এবং নিরাপদ অভিবাসন প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছে, তখন এসব ঘটনা উদ্বেগজনক হারে ঘটছে। মানব পাচার ও অভিবাসন নিয়ে কাজ করেন এমন কয়েকটি সংগঠন বলেছে, বেশির ভাগ মানব পাচার হয় মালয়েশিয়া, ভারত, পাকিস্তানসহ ইউরোপের কয়েকটি দেশে। একশ্রেণির দালালের মাধ্যমে তারা বেশি বেতনের চাকরির লোভে বিদেশ যাচ্ছেন। এতে বৈধ শ্রমবাজারের ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়ছে। এখান থেকে উত্তরণ না ঘটাতে পারলে দেশের বহু মানুষ নিঃস্ব-সর্বস্বান্ত হয়ে পড়বে। সরকার মানব পাচার প্রতিরোধ আইন করলেও তার প্রয়োগ হচ্ছে না বললেই চলে। ন্যাশনাল লেভেল শেয়ারিং ফর অ্যাডাপশন অব কম্প্রিহেনসিভ ল অ্যাগেইনস্ট ট্রাফিকিং ও রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিট (রামরু) জানিয়েছে, অবৈধ অভিবাসন ঠেকাতে না পারলে বিভিন্ন দেশের শ্রমবাজার হারাতে হতে পারে বাংলাদেশকে।

 

সর্বশেষ খবর