রবিবার, ৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

৫০ বছরে হারিয়ে গেছে ৫২০ নদী

নিজস্ব প্রতিবেদক

এখন আর নদীতে পালতোলা নৌকার বহর দেখা যায় না। কিলোমিটারের পর কিলোমিটার পানিশূন্য নদীর কোথাও কোথাও চলে চাষবাস। খনন না করা ও দখলদারদের থাবায় নদীর নাব্যতা যেমন কমছে, ঠিক একই ভাবে কমছে নদীর সংখ্যাও। নদী গবেষকরা বলছেন, ষাটের দশকে সাড়ে সাতশ নদী ছিল বাংলাদেশে। বর্তমানে এ সংখ্যা কমে মাত্র ২৩০টিতে দাঁড়িয়েছে। ৫০ বছরে হারিয়ে গেছে ৫২০টি নদী। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রবাহিত ২৩০ নদীর মধ্যে ৫৯টি আন্তর্জাতিক। তবে সরকারি হিসেবে দেশে নদীর সংখ্যা ৪০৫। শুকনো মৌসুমে এসব নদীতে পর্যাপ্ত পানি থাকে না। ফলে বদলে যাচ্ছে নদীগুলোর গতিপথ, শুকিয়ে মরে যেতে যেতে দেশের মানচিত্র থেকেই হারিয়ে যাচ্ছে একের পর এক নদী।

নদী গবেষক গৌরাঙ্গ নন্দীর গবেষণায় জানা যায়, বর্তমানে কপোতাক্ষের কপিলমুনি অংশ একবারে শুকিয়ে গেছে। এর নিচের অংশে জোয়ারে পানি আসার পরিমাণ কমছে। ফলে এ অংশও দ্রুত শুকিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। কপোতাক্ষ নদের দৈর্ঘ্য মোট ৩৬৭ কিলোমিটার। উত্তরে চুয়াডাঙ্গার দর্শনা থেকে সুনামগঞ্জের তাহিরপুর এ নদের ওপরের অংশ, যাকে ভৈরব অববাহিকাও বলা হয়। এর দৈর্ঘ্য ১১০ কিলোমিটার, তাহিরপুর থেকে খুলনার পাইকগাছার শিববাড়ী পর্যন্ত বর্তমান কপোতাক্ষ, যার দৈর্ঘ্য ১৭৫ কিলোমিটার; আর রাড়ুলী থেকে সুন্দরবন পর্যন্ত কপোতাক্ষের বিচ্ছিন্ন অংশ, যার দৈর্ঘ্য ৮২ কিলোমিটার। এ নদের তাহিরপুর থেকে কপিলমুনি পর্যন্ত অংশে বর্তমানে আর প্রবাহ নেই।

রংপুর শহর থেকে মাত্র ১০ কিলোমিটার দূরে গঙ্গাচড়া উপজেলা। এ উপজেলার ১০টি ইউনিয়নের মধ্যে সাতটিই হচ্ছে তিস্তাবেষ্টিত। শুকনো মৌসুমে তিস্তায় থাকে হাঁটু জল। ডালিয়া থেকে কাউনিয়া পর্যন্ত প্রায় ৭০ কিলোমিটারজুড়ে জেগে উঠেছে চর। বগুড়ার এক সময়ের প্রমত্তা করতোয়া নাব্যতা হারাতে হারাতে এখন সরু খাল। একই চেহারা গাইবান্ধার ঘাঘট ও লালমনিরহাট-কুড়িগ্রামের ধরলা নদীর। শুকনো মৌসুমে নাব্যতা হারাচ্ছে ব্রহ্মপুত্র নদও। ভৈরব নদের দৈর্ঘ্য প্রায় ১৫৯ কিলোমিটার। এর মধ্যে যশোর অংশের ২৫ কিলোমিটার এলাকা প্রায় শুকিয়ে গেছে। বর্তমানে ভৈরব নদকে মানুষ ডাস্টবিন হিসেবে ব্যবহার করছে।

বাংলাদেশের প্রধান নদ-নদীগুলোর বাইরে স্থানীয় ছোট নদীগুলোকে চিহ্নিত করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। উইকিপিডিয়ায় দেখা গেছে, প্রধান নদীগুলোর বাইরে বর্তমানে পানি উন্নয়ন বোর্ড চিহ্নিত স্থানীয় নদীর সংখ্যা মাত্র ৪০৫টি। সংশ্লিষ্ট সূত্রের দাবি, এসব নদীর বেশিরভাগই শুষ্ক মৌসুমে শুকিয়ে যায়। ফলে নাব্যতা হারাতে হারাতে এগুলো চলে গেছে দখলদারদের হাতে। ফলে মানচিত্র থেকে বিদায় নিচ্ছে বহু নদী ও ছোট বড় জলাশয়। চিত্রা নদীর উৎপত্তি চুয়াডাঙ্গা জেলায়। বাংলাপিডিয়া অনুসারে, চুয়াডাঙ্গা ও দর্শনার নিম্নাঞ্চল থেকে উৎপন্ন হয়ে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে দর্শনা, কালীগঞ্জ, শালিখা ও কালিয়া উপজেলার মধ্য দিয়ে প্রায় ১৭০ কি.মি. প্রবাহিত হয়ে নড়াইল জেলার গাজীরহাটে নবগঙ্গা নদীর সঙ্গে মিলেছে। নড়াইল শহরের বাঁধাঘাট এলাকা থেকে চিত্রা নদীর পথ ধরে উত্তর এবং দক্ষিণে যেদিকেই যাওয়া যাক দেখা যাবে নদীর কোল ঘেঁষে সারি সারি বাড়ি। একতলা থেকে বহুতল বাড়ি। স্থানীয়রা জানান, নদীর জায়গা দখল করেই বেশিরভাগ স্থাপনা গড়ে ওঠেছে। এসব জায়গা অবৈধ দখলের কারণ হিসেবে স্থানীয়রা বলছেন, এ নদীর কোনো ভাঙা-গড়া না থাকায় নদী পাড়ের বাসিন্দারা দখল করতে উৎসাহিত হচ্ছেন। আর নেই কোনো প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ। বাংলাদেশের বিভিন্ন নদ-নদীর এই দুর্দশার জন্য একদিকে পাশের দেশ ভারত ও বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বোঝাপড়ায় ঘাটতিকে দায়ী করা হয়। এ ছাড়াও জবর দখল ও অবৈধ স্থাপনা নির্মাণও সমানভাবে দায়ী।

পরিবেশ গবেষক আবু নাসের বলেন, প্রতিটা নদীর চরিত্র আছে। আমাদের ভাবনাচিন্তাগুলো কেবল তুরাগ বুড়িগঙ্গাকেন্দ্রিক। যদিও এই দুটো নদীকেও আমরা দূষণের হাত থেকে রক্ষা করতে পারিনি। বিচ্ছিন্নভাবে ভেবে সারা দেশের মরে যাওয়া নাম হারানো নদীগুলোকে ফিরে পাওয়া সম্ভব নয়। এ জন্য টেকসই পরিকল্পনাভিত্তিক প্রকল্প। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্র বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. কাউসার আহাম্মদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, নদী রক্ষায় এবং নদী খননে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে আগের তুলনায় বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ এখন চোখে পড়ছে। আমাদের সবাইকে এ বিষয়ে আরও সোচ্চার হওয়া প্রয়োজন। প্রয়োজন নদীদূষণ রোধ করা। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারিপর্যায়েও নদী রক্ষার জন্য সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।

সর্বশেষ খবর