মঙ্গলবার, ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

কবে ফিরবে রোহিঙ্গারা

ঢাকায় ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও কানাডার প্রধানমন্ত্রীর দূত আসছেন জাতিসংঘ মহাসচিব ও ইউএনএইচসিআরের বিশেষ দূত

জুলকার নাইন

মিয়ানমার থেকে নির্যাতিত ও বাস্তুচ্যুত হয়ে বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গাদের বিষয়ে আলোচনার জন্য গতকাল ঢাকা এসেছেন ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেতনো মারসুদি। কক্সবাজারে গিয়ে রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শন করেছেন বিশ্ববিখ্যাত অভিনয় শিল্পী অ্যাঞ্জেলিনা জোলি। বাংলাদেশে পাঁচ দিনে সফরের শেষ পর্যায়ে আছেন কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর মিয়ানমার বিষয়ক বিশেষ দূত বব রে। আসছেন জাতিসংঘ মহাসচিবের মিয়ানমারবিষয়ক বিশেষ দূত ক্রিস্টিন শ্রেনার বার্গনার ছাড়াও জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআরের একজন বিশেষ দূত ও পোল্যান্ডের একজন মন্ত্রী। তাঁদের সব সফরেই গুরুত্বের সঙ্গে উঠে আসছে রোহিঙ্গা ইস্যু। শুধু এখন নয়, রোহিঙ্গা ক্যাম্পের পরিবেশ ও শিবিরে আশ্রিতদের বিভিন্ন সংকট নিয়ে কথা বলতে ভিভিআইপিদের সফরের শেষ নেই। কিন্তু কেউ জানে না বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া এই বিশাল জনগোষ্ঠী কবে নাগাদ ফিরতে পারবে নিজেদের দেশ মিয়ানমারে। আদৌ মিয়ানমার এ বিষয়ে কী ধরনের পরিকল্পনা করছে সে ধারণাও নেই কারও।

জানা যায়, রোহিঙ্গাদের ফিরে যাওয়ার বিষয়টি এখন নানা শর্তের বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের প্রত্যাবাসন চুক্তি অনুযায়ী, প্রত্যাবাসন হতে হবে স্বেচ্ছায়, নিরাপদে এবং সম্মানজনকভাবে। তা ছাড়া রোহিঙ্গাদের প্রমাণ করতে হবে যে তারা রাখাইনের বাসিন্দা ছিল। এর মধ্যেই মিয়ানমারে অবস্থান করলেও দীর্ঘসময় ধরে এমনিতেই নাগরিকত্ব বঞ্চিত ছিল রোহিঙ্গারা। তাই তাদের পক্ষে মিয়ানমারের নাগরিকত্ব প্রমাণ করা এমনিতেই কঠিন। অন্যদিকে, নাগরিকত্ব, ক্ষতিপূরণ ও নির্যাতন-নিপীড়নের বিচার ছাড়া রোহিঙ্গাদের বড় অংশই ফিরে যেতে চায় না। অন্যদিকে মিয়ানমারও এখন পর্যন্ত এসবের কোনোটিরই নিশ্চয়তা না দিয়ে কালক্ষেপণ করছে। আন্তর্জাতিক পরিম লও দুই ভাবে বিভক্ত। চীন, রাশিয়া, ভারতের মতো দেশগুলো একে এখনো বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের দ্বিপক্ষীয় সমস্যা হিসেবে দেখছে। পশ্চিমা দেশগুলো এটাকে বৈশ্বিক সংকট বললেও অন্য দেশগুলোর মতো তারাও মিয়ানমারে থাকা স্বার্থ দ্বারাই পরিচালিত হচ্ছে। বেশির ভাগ দেশ অবশ্য রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে স্বেচ্ছায়, নিরাপদে এবং সম্মানজনকভাবে প্রত্যাবাসন সমর্থন করার কথা বললেও সেখানে ফেরার আগ পর্যন্ত বাংলাদেশেই তাদের মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ করার পক্ষে। এ জন্য বাংলাদেশকে নানান ধরনের চাপ প্রয়োগে দ্বিধা বোধ করছে না কেউ। এমনকি তাদের মুখে রোহিঙ্গাদের দীর্ঘ মেয়াদে বাংলাদেশে অবস্থান করানো ইস্যুতে বাংলাদেশকে নানান ধরনের প্রস্তুতি নেওয়ার কথাও শোনা যাচ্ছে বিভিন্ন সময়। বিপরীতে প্রত্যাবাসনের জন্য মিয়ানমারকে চাপ দেওয়ার বিষয়েও আন্তর্জাতিক কণ্ঠ বেশ নরম হয়ে এসেছে। অন্যদিকে, মিয়ানমার সহায়ক পরিবেশ তৈরি না করায় গত বছরের নভেম্বরে নির্ধারিত সময় অনুযায়ী রোহিঙ্গাদের রাখাইনে পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু করা যায়নি। রোহিঙ্গারারাও স্বেচ্ছায় যেতে না যাওয়ায় সম্ভব হয়নি আরেকটি প্রক্রিয়া। এখন সরকার নতুন মেয়াদে নির্বাচিত হওয়ার পর যখন রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে ফের উদ্যোগী হয়েছে তখন রাখাইনে আরাকান আর্মির সঙ্গে ফের লড়াইয়ে নেমেছে মিয়ানমারের সেনারা। ফলে রাখাইনের নিরাপত্তা পরিস্থিতি খারাপ হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে অনিচ্ছুক মিয়ানমার যে কিছু করবে না, সেই আশঙ্কাটা আবার জোরালো হচ্ছে। জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা ও বাংলাদেশ সরকারের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এখন বাংলাদেশে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা অবস্থান করছে। রোহিঙ্গাবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থার সমন্বয়ের দায়িত্বে থাকা ইন্টার সেক্টর কো-অর্ডিনেশন গ্রুপ (আইএসসিজি) সূত্রে জানা গেছে, রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে বায়োমেট্রিক পদ্ধতির আওতায় আসা রোহিঙ্গার সংখ্যা রয়েছে ১১ লাখ ১৮ হাজার। অথচ বর্তমানে শিবিরে রোহিঙ্গার হদিস মিলছে ৯ লাখ ১৫ হাজার। দুই লাখ রোহিঙ্গার হদিস মিলছে না। বেশ কিছু রোহিঙ্গা পালাতে গিয়ে ধরা পড়ার পর বিষয়টি কর্তৃপক্ষের নজরে আসে। রোহিঙ্গাদের মধ্যে শিবির পালানোর প্রবণতা ঠেকাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাগুলো উদ্যোগ নিলেও বাস্তবে স্থানীয় জনসাধারণের সঙ্গে মিশে গিয়ে তারা পালিয়ে গেলে সবাইকে চিহ্নিত করা সম্ভব হয় না। কারণ মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের আকৃতি, ভাষা, পোশাক-পরিচ্ছদ, আচার-আচরণ স্থানীয়দের সঙ্গে যথেষ্ট মিল রয়েছে। আর এ সুযোগে রোহিঙ্গা পুরুষ, নারী ও শিশুরা সহজেই স্থানীয় জনগণের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমার সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের ওপর নৃশংসতা শুরু করলে পরবর্তী কয়েক মাসে অন্তত সাত লাখ রোহিঙ্গা প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। এর আগে ২০১৬ সালের অক্টোবরে রোহিঙ্গাদের ওপর আরেক দফা নৃশংসতা শুরু করলে অন্তত ৮৭ হাজার রোহিঙ্গা পালিয়ে আশ্রয় নেয় বাংলাদেশে। সবমিলিয়ে সংখ্যা এগারো লাখ পেরিয়ে যায়। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য ২০১৭ সালের ২৩ নভেম্বর নেপিডোতে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে একটি চুক্তি সই হয় কিন্তু সেই চুক্তি বাস্তবায়নের দেখা নেই।

ইন্দোনেশিয়া রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে কার্যকর ভূমিকা রাখবে- ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী : ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেতনো মারসুদি বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেনের সঙ্গে গতকাল জাতীয় সংসদ ভবনে সাক্ষাৎ করেন। এ সময় ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী আঞ্চলিক ও বহুপক্ষীয় কাঠামোর আওতায় রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে আরও কার্যকর ভূমিকা রাখার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। ইন্দোনেশিয়ার মন্ত্রী বিভিন্ন ক্ষেত্রে বর্তমান সরকারকে সহযোগিতার আশ্বাস প্রদান করেন এবং দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরও উন্নয়নের আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর