শুক্রবার, ৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

খালেদার বছর কাটল কারাগারে

মুক্তি চেয়ে কোনো কর্মসূচিতে নেই বিএনপি, আইনি লড়াইতেও টানাপড়েন

মাহমুদ আজহার

খালেদার বছর কাটল কারাগারে

আজ ৮ ফেব্রুয়ারি। এক বছর আগে এই দিনে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় দণ্ডিত হলে কারাগারে পাঠানো হয় সাবেক প্রধানমন্ত্রী বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে। রাজধানীর নাজিমউদ্দিন রোডের পুরনো ‘নির্জন’ কারাগারে ৩৬ মামলার আসামি হয়ে একমাত্র বন্দী তিনি। এর মধ্যে দুটি মামলায় তাঁকে ১০ বছর ও সাত বছর করে সাজা দেওয়া হয়। এ নিয়ে চলছে আইনি লড়াই। কারাগারে নেওয়ার আগে বিএনপির সিনিয়র কিছু নেতা এবং খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা সরকারকে হুঁশিয়ার করে বলেছিলেন, সর্বোচ্চ দু-তিন দিনের মধ্যেই বেগম জিয়াকে কারামুক্ত করা হবে। আইনি প্রক্রিয়ার পাশাপাশি রাজপথে আন্দোলনের বার্তা দিয়েছিলেন তারা। কিন্তু মাসের পর মাস গড়িয়ে আজ এক বছর হতে চলল, মুক্তি মিলছে না বাহাত্তরোর্ধ্ব অসুস্থ বেগম জিয়ার।

অসুস্থতার কারণে কারাগারেই চলছে বিভিন্ন মামলার বিচার। হুইল চেয়ারে করে তাঁকে আদালতে হাজির করা হয়। এমনই এক পরিস্থিতিতে জাতীয় নির্বাচনে যায় বিএনপি। দলের হাইকমান্ড থেকে বলা হলো, বিএনপি চেয়ারপারসনের মুক্তি আন্দোলনের অংশ হিসেবেই নির্বাচনে যাওয়া। কিন্তু নির্বাচনের সময় সবাই ব্যস্ত ছিলেন নিজ সংসদীয় আসন নিয়ে। খালেদা জিয়ার মুক্তি আন্দোলনের কিছুই হয়নি। নির্বাচনের এক মাসেও রাজপথের শক্ত কোনো কর্মসূচিতে যেতে পারেনি বিএনপি। মাঝেমধ্যে বিএনপির সিনিয়র যুগ্মমহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভীর নেতৃত্বে ঝটিকা মিছিল করতে দেখা যায়। এ ছাড়া সংবাদ সম্মেলন আর মানববন্ধনে নিজেকে সীমিত রেখেছে দলটি। গতকালও এক সংবাদ সম্মেলনে এমনই কর্মসূচি ঘোষণা করেন রুহুল কবির রিজভী। তিনি জানান, ‘বেগম খালেদা জিয়াসহ নেতা-কর্মীদের মুক্তি দাবিতে আগামীকাল (আজ) বেলা আড়াইটায় ঢাকার রমনায় ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন হবে। এ ছাড়া ৯ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মহানগরী বাদে দেশব্যাপী একই দাবিতে প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন হবে।’ এ প্রসঙ্গে গতকাল বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. মোশাররফ হোসেনকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, ‘চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে নিয়ে কোনো শক্ত কর্মসূচি দেওয়া হলে তা সবাই দেখবে।’ বিএনপির মাঠ পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের প্রশ্ন, বিএনপির ঢাউস কমিটিতে প্রায় ৬০০ নেতা রয়েছেন। অঙ্গসংগঠনগুলোয় ১ হাজারের বেশি নেতা। তারা সবাই মিলে একদিন রাস্তায় নামলে কর্মী-সমর্থকরাও মাঠে নামতেন। এতে বিশাল সমাবেশ হতো। কিন্তু অধিকাংশ নেতাই পদ নিয়ে লাপাত্তা। শুধু ভোটের সময় তাদের দেখা মেলে। এমন নেতাদের বাদ দিয়ে বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের সব কমিটি পুনর্গঠনের দাবিও মাঠ পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের। নির্বাচনের পর জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে যে দুটি মানববন্ধন হয় তাতে বিএনপি নেতা-কর্মীদের উপস্থিতি ছিল হতাশাজনক। এ প্রসঙ্গে বিএনপির যুগ্মমহাসচিব অ্যাডভোকেট সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, ‘বেগম জিয়াকে যখন কারাগারে নেওয়া হয় তৎক্ষণাৎ আমরা রাজপথের শক্ত কর্মসূচি দিয়েছিলাম। কিন্তু ওই সময় কেন্দ্র থেকে তৃণমূল- সর্বস্তরের নেতা-কর্মীর ওপর মামলা-হামলার খড়্গ নেমে আসে। এখন আমরা সেসব মামলা নিয়েই ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছি। তার পরও আইনি প্রক্রিয়ার পাশাপাশি বিএনপির কর্মসূচি চলছে। মাঠ পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের কাছে আমরা দুঃখিত, আমরা আমাদের প্রিয় নেত্রীকে কারামুক্ত করতে পারিনি। তবে বেগম জিয়ার মুক্তির কোনো বিকল্প নেই। যে কোনো মূল্যে বিএনপি চেয়ারপারসনকে মুক্ত করতে হবে। এ নিয়ে কোনো আপস নেই।’ জানা যায়, বিএনপি চেয়ারপারসনের বিরুদ্ধে থাকা মোট ৩৬ মামলার মধ্যে সাজা হয়েছে দুটিতে। এর মধ্যে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় বিচারিক আদালত পাঁচ বছর কারাদ- দেওয়ার পর হাই কোর্টে সাজা বেড়ে হয় ১০ বছর। মামলাটি বর্তমানে আপিল বিভাগে বিচারাধীন। আর জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীকে সাত বছর কারাদ- দিয়েছে নিম্ন আদালত। এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেছেন তাঁর আইনজীবীরা। বাকি ৩৪ মামলার মধ্যে গ্যাটকো, নাইকো ও বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি দুর্নীতিসহ ১১টি মামলা বিচারাধীন। আর হাই কোর্টের আদেশে স্থগিত রয়েছে ২৩ মামলা। তবে খালেদা জিয়ার মুক্তি নিয়ে আইনি লড়াইয়েও দুই ভাগে বিভক্ত আইনজীবীরা। আইনি কার্যক্রমের চেয়ে তারা লোক দেখানো আইনি প্রক্রিয়ায় যুক্ত থাকতেই বেশি স্বচ্ছন্দবোধ করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এ নিয়ে আইনজীবীদের মধ্যে একাধিকবার হাতাহাতির ঘটনাও ঘটেছে। আইনজীবী নেতাদের ওপর বিরক্ত বিএনপির হাইকমান্ডও। তাদের কারও কারও ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ বলেও বিভিন্ন সময় অভিযোগ করেন বিএনপির সিনিয়র নেতারা। আইনজীবী নেতাদের ভুলের কারণেই বেগম জিয়াকে কারাগারে যেতে হয়েছে বলে দাবি করেন বিএনপির একাধিক সিনিয়র নেতা। তারা বলছেন, শুধু কারাগারই নয়, বিএনপিপ্রধানকে সেনানিবাসের বাড়ি ছাড়তে হয়েছে গুটিকয় আইনজীবীর ভুলের কারণে। বাড়ির বিষয়টি উচ্চ আদালতে না গিয়ে নিম্ন আদালতে গেলে দীর্ঘ সময় যেত বলেও মনে করেন ওইসব নেতা। আইনি প্রক্রিয়ায় কি খালেদা জিয়ার মুক্তি সম্ভব- এমন প্রশ্নে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, ‘খালেদা জিয়াকে মুক্ত করার একমাত্র উপায় রাজপথ উত্তপ্ত করা। যত দিন পর্যন্ত রাজপথ উত্তপ্ত না হবে, তত দিন তাকে আইনি প্রক্রিয়ায় জেল থেকে বের করা যাবে না। এটি আমার দৃঢ় বিশ্বাস। তাই আমরা যতই আইনি প্রক্রিয়ার কথা বলি না কেন, সরকারের সদিচ্ছা ছাড়া তাকে মুক্ত করা যাবে না।’ তবে বিএনপির যুগ্মমহাসচিব ও খালেদা জিয়ার আইনজীবী ব্যারিস্টার এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, ‘সরকার প্রভাব বিস্তার না করলে খালেদা জিয়া অনেক আগেই কারামুক্তি পেয়ে যেতেন। সরকার ইচ্ছা করলেই যে কোনো সময় খালেদা জিয়ার কারামুক্তি সম্ভব। তাঁর কারামুক্তি সরকারের ওপর নির্ভর করছে। তবে সরকার বিচার বিভাগের ওপর হস্তক্ষেপ করছে।’

সর্বশেষ খবর