শনিবার, ৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

সেই সালেক এখন কোথায়

জাহালমকে ফাঁসিয়ে ব্যাংক ঋণ নিয়ে সম্পদ বানিয়ে ধরাছোঁয়ার বাইরে

সরকার হায়দার, পঞ্চগড়

সেই সালেক এখন কোথায়

সোনালী ব্যাংকের প্রায় সাড়ে ১৮ কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনার মূল হোতা আবু সালেক। ২০১০ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি ব্যাংকটির মিরপুর ক্যান্টনমেন্ট শাখা থেকে তোলা হয়েছিল এসব টাকা। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সালেকের বিরুদ্ধে মামলা করে। কিন্তু সোনালী ব্যাংকে ব্যক্তিক ও অব্যক্তিক হিসাব খোলার সময় সালেকের যে ছবি ব্যবহার করা হয়েছিল তার সঙ্গে চেহারার মিল থাকায় প্রায় তিন বছর জেলের ঘানি টানতে হয়েছে টাঙ্গাইলের নিরীহ জাহালমকে।

এই কাহিনী প্রকাশ হওয়ামাত্রই দেশময় সমালোচনার ঝড় ওঠে। সেই সালেক কোথায়? তার হদিস পাওয়া না গেলেও এবার তার বিপুল সম্পদের খোঁজ মিলেছে পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলায়। ওই এলাকার লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গণমাধ্যমে জালিয়াতির মাধ্যমে অর্থ আত্মসাতের খবর প্রকাশের পর হেলমেট মাথায় মোটরসাইকেলে ঘুরতেন সালেক। ৩-৪ মাস আগে তাকে বোদা উপজেলায় দেখা গিয়েছিল। তবে তার স্বজনরা বলছেন, এক বছর ধরে সালেকের এলাকায় কারও সঙ্গে যোগাযোগ নেই। স্থানীয়দের কেউ কেউ বলছেন, সালেক ভারত পালিয়ে গেছেন। রাতারাতি কোটি টাকার সম্পদের মালিক বনে যাওয়া সালেক বোদায় হঠাৎ খুলে বসেন স্যামসাং-এর শো-রুম। ব্যাংক জালিয়াতির ঘটনাটি জানাজানি হলে ৮ মাস আগে সেটি বন্ধ করে দেন। বোদা পৌরসভার প্রামাণিক পাড়া এলাকায় প্রায় ২০ শতক জমির উপরে গড়েন একতলা বিশাল বাড়ি। আগে সেখানে ভাড়াটিয়া থাকলেও এখন সেই বাড়ির গেটেও ঝুলছে তালা। সিপাহিপাড়া এলাকায়ও ২০ শতক জমির ওপর সালেক স্থাপন করেন রুটি-বিস্কুটের কারখানা। নাম ‘ঢাকা বেকারি’। কারখানাটি তিনি ভাড়া নিয়েছিলেন। কারখানার মালিকের সঙ্গে প্রতারণার করেন সালেক। ভাড়ার চুক্তিতে জামানত হিসেবে যে টাকার অংক লেখা থাকার কথা ছিল, সালেক তা লিখতে অস্বীকৃতি জানান।

জমির মালিক শাহীন আলম জানান, আবু সালেক তার জমিতে তাকে কারখানা তুলতে বলেন। তার কথামতো কারখানা করতে সাড়ে ৮ লাখ টাকা খরচ হয়। এই টাকা অগ্রিম ভাড়া হিসেবে চুক্তিপত্রে উল্লেখ না করে দেখানো হয় মাত্র দেড় লাখ টাকা।  বোদায় হঠাৎ জমি কেনা এবং বাড়ি নির্মাণ করার টাকার উৎস কোথায়- এমন জানতে চাইলে সালেক তার পরিবারের লোকজনদের বলতেন, ঢাকায় তার শেয়ার ব্যবসা, দুধের ব্যবসা এবং গার্মেন্টের যন্ত্রাংশ সাপ্লাইয়ের ব্যবসা আছে।

এ প্রতিবেদকের কথা হয় সালেকের ভগ্নিপতি খাদেমুল ইসলাম রমজানের সঙ্গে। তিনি বোদার শমশেরনগর দাখিল মাদ্রাসার শিক্ষক। রমজান বলেন, গত বছরের ২ ফেব্রুয়ারি সালেকের সঙ্গে তার শেষ দেখা হয়। এরপর সে আর বাড়িতে আসেনি।   জানা যায়, আবু সালেকের বিরুদ্ধে সোনালী ব্যাংকের ১৮ কোটি ৪৭ লাখ টাকা জালিয়াতির ঘটনায় ২০১২ সালের এপ্রিলে রাজধানীর মতিঝিল থানায় ৩৩টি মামলা হয়। কিন্তু এসব মামলায় আবু সালেকের বদলে জেল খাটেন পাটকল শ্রমিক জাহালম। জাহালমের বাড়ি টাঙ্গাইলের ঠিকানায় চিঠি পাঠিয়ে ২০১৪ সালের ১৮ ডিসেম্বর প্রধান কার্যালয়ে হাজির হতে বলে দুদক। সোনালী ব্যাংকে সালেকের ১০টি ব্যাংক অ্যাকাউন্টের ভুয়া ঠিকানাগুলোর একটি ছিল জাহালমের পাশের গ্রাম। ছবির সঙ্গে মিল থাকায় জাহালমের খোঁজ করতে থাকে পুলিশ। পরে ২০১৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি নরসিংদীর ঘোড়াশালের মিল থেকে তাকে আটক করা হয়। বিষয়টি নিয়ে তার পরিবার জাতীয় মানবাধিকার কমিশনে অভিযোগ করলে অনুসন্ধানে নামে সংস্থাটি। গত বছরের ২২ এপ্রিল কাশিমপুর কারাগারে গিয়ে জাহালমের সঙ্গে কথাও বলেন কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক। মানবাধিকার কমিশনের তদন্দেই বেরিয়ে আসে আবু সালেক আর জাহালম একই ব্যক্তি নন। পরে উচ্চ আদালতের আদেশে গত ৩ ফেব্রুয়ারি মধ্যরাতে জাহালম মুক্ত হন। কমিশনের ওই তদন্তেই উঠে আসে আবু সালেকের পূর্ণাঙ্গ নাম-ঠিকানা। আবু সালেকের বাড়ি ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়া ইউনিয়নের সিঙ্গিয়া গ্রামে। তার বাবা আবদুল কুদ্দুস। আবু সালেক উচ্চমাধ্যমিক পাস। একসময় কাজ করতেন জাতীয় পরিচয়পত্রের ডাটা এন্ট্রি অপারেটরের। সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে তিনি ব্যাংক জালিয়াতি করেছেন। কয়েক বছর আগে ঠাকুরগাঁও শহরে ৫ শতক জমির পাশাপাশি দোকান-জমি করেন পঞ্চগড়েও। 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর