রবিবার, ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

শিক্ষার ঘাটে ঘাটে দুর্নীতি

সাঈদুর রহমান রিমন

দেশের শিক্ষা খাতে অনিয়ম, দুর্নীতি আর ঘুষ বাণিজ্য চরম আকার ধারণ করেছে। সরকারি ও প্রকল্পের টাকা লুটপাটের ক্ষেত্রে এ সেক্টর সব দফতরকে ছাড়িয়ে গেছে। থানা শিক্ষা অফিস থেকে শুরু করে আঞ্চলিক শিক্ষা অফিস, শিক্ষা ভবন এমনকি মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন বিভাগে রয়েছে ঘুষের প্রভাব। স্কুলে ছাত্র ভর্তি, শিক্ষক নিয়োগ, বদলি, পদায়ন, শিক্ষকের এমপিওভুক্তি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অনুমোদন, জাতীয়করণসহ অবসরে যাওয়া শিক্ষকদের পেনশনের টাকা তুলতে ঘুষ দিতে হয়। এ ছাড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্মাণ, মেরামত, আসবাবপত্র ও শিক্ষা সরঞ্জাম কেনাকাটা ও সরবরাহের প্রতিটি ধাপেই চলে সীমাহীন চাঁদাবাজি। শিক্ষা প্রকৌশল বিভাগে চলে সরকারি অর্থের যথেচ্ছ অপচয় আর লুটপাট। চলতি অর্থবছরের বাজেটে (২০১৮-১৯) শিক্ষা খাতে ৫২ হাজার কোটি টাকার বেশি বরাদ্দ রাখা হয়েছে। গত ১০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ এ বরাদ্দের অর্ধেকের বেশি ব্যয় হচ্ছে অবকাঠামো উন্নয়নে। ফলে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতরে অনিয়ম-দুর্নীতিও বেড়েছে। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদফতরে ঘুষ ছাড়া কিছুই হয় না। নানা নামে ঘুষ নেন কর্মকর্তারা। এমপিওভুক্তি, পদোন্নতি, টাইম স্কেল- সব এখান থেকেই হয় বলে পদে পদে হয়রানির শিকার হন প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষকরা। রাজধানীসহ বড় শহরগুলোয় ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল কিংবা কিন্ডারগার্টেনের অনুমতি নিতে মোটা অঙ্কের টাকা ঘুষ দিতে হয়। হাইস্কুল ও কলেজের ক্ষেত্রে এই ঘুষের পরিমাণ সর্বনিম্ন দুই লাখ টাকা। কোনো কারণে প্রতিষ্ঠান বা নির্দিষ্ট শিক্ষকের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসেবে অনুদান বা বেতন বন্ধ হয়ে গেলে তা পুনরায় চালু করতে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা ঘুষ দিতে হয়। পেনশনের কাগজপত্র প্রক্রিয়ায় ঘুষ লাগে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে জাতীয়করণের উদ্যোগ নিতে চাইলে কমবেশি ২০ ধাপে ঘুষ দিতে হয়। প্রতিষ্ঠানের পক্ষে ‘ইতিবাচক পরিদর্শন রিপোর্ট’ করিয়ে নিতে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত ঘুষ দেওয়া এখন অলিখিত বিধান হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমপিওভুক্তির কাজে একজন শিক্ষক বা কর্মচারীকে ন্যূনতম ২০ হাজার থেকে দেড় লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ দিতে হয়। ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে এমপিওভুক্তির কাজ মাঠ প্রশাসনে ছেড়ে দেওয়ার পর এই ঘুষ বাণিজ্য আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। ফলে শিক্ষকদের হয়রানির মাত্রাও বেড়ে গেছে কয়েকগুণ। এ ছাড়া নাম, বয়সসহ নানা বিষয় সংশোধন, টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড পেতে উপজেলা শিক্ষা অফিস থেকে ফাইল পাঠাতে ঘুষ দিতে হয় ৮-১০ হাজার টাকা। জেলা শিক্ষা অফিসে দিতে হয় ৫-৭ হাজার টাকা। শিক্ষা খাতের এসব দুর্নীতি ও অনিয়ম রোধে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্টদের ৩৯ দফা সুপারিশসহ সতর্ক বার্তা দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এসব সুপারিশে প্রশ্নপত্র ফাঁস, নোট বা গাইড বই বন্ধ, কোচিং বাণিজ্য রোধ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো নির্মাণ, এমপিওভুক্তি, নিয়োগ ও বদলিসহ বিভিন্ন দুর্নীতির উৎস এবং তা বন্ধের জন্য সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। দুর্নীতি প্রতিরোধে গঠিত ‘শিক্ষা সংক্রান্ত প্রাতিষ্ঠানিক টিম’-এর অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে এ সুপারিশমালা সংযুক্ত করা হয়েছে।

২০ সিন্ডিকেটে দাপুটে ২০০ জন : শিক্ষা খাতের শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগ, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর, পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদফতর, শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতর এবং এসব সংস্থাভুক্ত ১৩টি প্রতিষ্ঠানের সর্বত্র ঘুষ বাণিজ্য নিশ্চিত করতে শিক্ষা ভবন থেকে মাঠ পর্যায় পর্যন্ত গড়ে উঠেছে সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেট। প্রভাবশালী কর্মকর্তা বা কর্মচারী নেতার নেতৃত্বে গড়ে তোলা ২০টি লুটেরা সিন্ডিকেটের আওতায় দুই শতাধিক দাপুটে ব্যক্তি দেশজুড়ে দাপিয়ে বেড়ায়। তাদের লুটপাটের নানা কূটকৌশল বাস্তবায়নে শিক্ষা খাতের ছয় শতাধিক কর্মকর্তা, কর্মচারী, ঠিকাদারসহ একশ্রেণির শিক্ষক সদা তৎপর থাকে বলে অভিযোগ আছে। অভিযুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নাম-পদবিসহ পূর্ণাঙ্গ তালিকা জমা আছে শিক্ষা ও শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতরসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে। তবু এ চক্রের অপকর্মে বাধা দিতে সাহস করে না কেউ। এদের দাপটে নিম্নশ্রেণির কর্মচারী থেকে শুরু করে প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারা পর্যন্ত তটস্থ থাকেন। অনুসন্ধানে জানা যায়, শিক্ষা অধিদফতরের একজন সহকারী পরিচালকের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা সিন্ডিকেটের সঙ্গে যুক্ত আছে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী অ্যাসোসিয়েশনের দুই নেতা। অন্যদিকে তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী সমিতির জাঁদরেল এক নেতার সমন্বয়ে গড়ে ওঠা আরেকটি সিন্ডিকেটের সঙ্গে সম্পৃক্ত আছে কয়েকজন প্রশাসনিক কর্মকর্তা। শিক্ষা ভবনের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, সিন্ডিকেটের নেতৃস্থানীয়রা রাতারাতি শত কোটি টাকার মালিক বনেছেন। রাজনৈতিক দলে সম্পৃক্ত থাকায় প্রভাব খাটান তারা। এ ছাড়া পরিচালক-মহাপরিচালক পর্যায়ের শীর্ষ কর্মকর্তাদের শ্যালক, ভাই কিংবা ভাগ্নে পরিচয় দেওয়া কয়েকজনও এসব সিন্ডিকেটের সক্রিয় ভূমিকায় রয়েছেন। তাদের আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে মাঠ পর্যায়ের বেশ কয়েকজন শিক্ষা কর্মকর্তাও অনিয়ম, দুর্নীতি এবং অনৈতিক কর্মকাে  বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন।

অভিযুক্তদের লঘু শাস্তি : একটি শক্তিশালী গোয়েন্দা সংস্থার অনুসন্ধানের ভিত্তিতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে একটি প্রতিবেদন পাঠানো হয়। ওই প্রতিবেদনে শিক্ষা অধিদফতরের চার উপ-পরিচালক, ১৮ জন উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা, ৬৮ জন উপজেলা পরিদর্শক, একাডেমিক সুপারভাইজার, প্রোগ্রামার ও ১৬ জন কর্মচারীসহ ১১৭ জনের নাম উল্লেখ করে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে বলা হয়। এ চিঠির পর অধিদফতরের পদস্থ কর্মকর্তারা নড়েচড়ে বসে এবং তড়িঘড়ি অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে, এক শাখা থেকে ভিন্ন শাখায় বদলি করে বিষয়টি আপাত সামাল দেন। বর্তমানে অভিযুক্ত ওই কর্মকর্তারা আবারও লোভনীয় পদ ও স্থানে পোস্টিং নিয়ে পুরনো অপকর্মে মেতে উঠেছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে নাম তালিকাযুক্ত নির্দেশনাপত্র অনুযায়ী দোষীদের মধ্যে উপ-পরিচালক মর্যাদার দুই কর্মকর্তাসহ জেলা-উপজেলা পর্যায়ের ১৮ শিক্ষা কর্মকর্তাকে বদলি করা হয়েছে। অন্যান্য কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে বিভাগীয় শাস্তি নিশ্চিত করার পাশাপাশি তাদের কর্মকা  পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। দুর্নীতির বিভিন্ন ঘটনার তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, মাঠ পর্যায়ের শিক্ষা অফিসের ঘুষ-দুর্নীতি-লুটপাটের সিন্ডিকেটে বড় ভূমিকা পালন করেন সেখানকার হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা, স্টেনো-টাইপিস্ট, অফিস সহকারী ও নৈশপ্রহরী পর্যায়ের কর্মচারীরা। কোথাও আবার একশ্রেণির অসাধু অধ্যক্ষ ও প্রধান শিক্ষক এমনকি শিক্ষক ও কর্মচারী নেতা এবং প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটির প্রভাবশালী সদস্যরাও ঘুষ সংগ্রহের দালালিতে লিপ্ত থাকেন।

সর্বশেষ খবর