রবিবার, ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

সিন্ডিকেটে জিম্মি শিক্ষা ভবন

নিজস্ব প্রতিবেদক

‘শিক্ষা ভবন’ (মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতর-মাউশি) অনিয়ম, দুর্নীতি আর ঘুষ বাণিজ্যের প্রধান আখড়ায় পরিণত হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষা অধিদফতরে ঘাপটি মেরে থাকা দুই শতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারীর কয়েকটি সিন্ডিকেট নানা পর্যায়ের দুর্নীতি চালিয়ে যাচ্ছে। শিক্ষক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সংক্রান্ত জরুরি কাজে সারা দেশ থেকে আসা লোকজনকে কত-শত বেকায়দায় ফেলে টাকা পয়সা যে হাতিয়ে  নেওয়া হয় তা কেবল ভুক্তভোগী ছাড়া অন্য কারও বোঝার উপায় নেই। প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আসা শিক্ষকদের কাছ থেকে ঘাটে ঘাটে ঘুষ বাণিজ্য করেও দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেট ক্ষান্ত নয়। তারা শিক্ষা ভবনে চাঁদাবাজ সিন্ডিকেটও গড়ে তুলেছেন। কর্মচারীদের স্বজন পরিজন, তদবিরবাজ ঠিকাদার গ্রুপ ও বহিরাগতদের সমন্বয়ে গজিয়ে ওঠা শিক্ষা ক্লাবের নামে চলে চাঁদাবাজি। শিক্ষা ভবনের দুর্নীতি বন্ধে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশনাসহ প্রতিবেদন ও শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির একাধিক সুপারিশ থাকলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। সিন্ডিকেটের মূল হোতারা ঘুরে ফিরে শিক্ষা ভবনেই স্থায়ী আসন পেতে বহাল আছেন। বরং তাদের দোর্দ  দাপটের সামনে মুখ খুলে কথা বলার সাহসও নেই কারোর। সূত্রমতে, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, বিভিন্ন অধিদফতর, প্রকল্প, ঢাকাসহ ১০টি শিক্ষা বোর্ড, এনসিটিবি, নায়েম, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর, ব্যানবেইস, অবসর বোর্ড, কল্যাণ ট্রাস্টসহ বিভিন্ন দফতর এবং ঢাকার কলেজগুলোতেও এসব কর্মকর্তা যুগ যুগ ধরে চাকরি করছেন। তারা সেবা না করে ঘুষ-দুর্নীতির সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন। সারা দেশে শিক্ষক নিয়োগ, পদায়ন, বদলি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শাখা খোলার অনুমতি, জাতীয়করণ, এমপিওভুক্তি, সার্টিফিকেট সত্যায়ন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবর্তনের অনুমতিসহ নানা কাজেই সিন্ডিকেটের ঘুষ বাণিজ্যের একচ্ছত্র দাপট রয়েছে। এই সিন্ডিকেটের বাইরে গিয়ে মন্ত্রণালয় থেকে কোনো কাজ করার বিন্দুমাত্র সুযোগ নেই কারোর। সে সাহসও রাখেন না সেবা প্রার্থীরা।

দীর্ঘদিন প্রশাসনিক পদ আঁকড়ে থাকা কর্মকর্তারাই ঘুষ-দুর্নীতি সিন্ডিকেটের মূল হোতা। অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, শিক্ষা ভবনে ৯২ জন কর্মকর্তা এক যুগেরও বেশি সময় ধরে কর্মরত। শারীরিক শিক্ষা বিভাগ, মনিটরিং অ্যান্ড ইভ্যালুয়েশন বিভাগের একাধিক উপ-পরিচালক, জাতীয়করণ হওয়া কলেজগুলো পরিদর্শন করার ক্ষেত্রে অসংখ্য অভিযোগে অভিযুক্ত মাউশির বহুল বিতর্কিত এক উপ-সচিবকে বহু চেষ্টা করেও শিক্ষা ভবন থেকে বদলি করা যাচ্ছে না। আলোচিত আরও দুই উপ-পরিচালক এবং এক আইন কর্মকর্তা এতই দাপুটে যে, তাদের কয়েক দফা জনস্বার্থের আদেশ দিয়েও শিক্ষা অধিদফতর থেকে নিচেও নামানো যায়নি। বিভিন্ন বিভাগে আরও ৭ জন সহকারী পরিচালকের চাকরি এই শিক্ষা ভবনের একই কক্ষে একই চেয়ার টেবিলে চলছে ১৬/১৭ বছর ধরে।

দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষা ভবন নামের ঘুষের মেলায় নিজেকে জড়িয়ে রাখা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সংখ্যা দেড় শতাধিক। তারা কয়েকটি সিন্ডিকেটে বিভক্ত হয়ে শিক্ষা অধিদফতরের সবগুলো ইউনিটে ঘুষ দুর্নীতির অপ্রতিরোধ্য সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন। তারা প্রত্যেকেই দাপুটে। দুর্নীতির মাধ্যমেই তারা গড়েছেন কোটি কোটি টাকার সম্পদ। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নানা ইউনিটেও তাদের দারুণ সখ্যতা, প্রভাবশালী নেতাদের সঙ্গেও গলায় গলায় ভাব। শিক্ষা ভবনের চিহ্নিত এ দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেটের কেউকেটারা রীতিমতো মুজিবকোট পরিধান করে সরকারি দফতরে বসে দায়িত্ব পালন করেন। তাদের অনিয়ম-দুর্নীতির অসংখ্য অভিযোগ জমা পড়ে আছে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরে। মাউশির একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, দুর্নীতিবাজ ঘুষ সিন্ডিকেটের কারও বিরুদ্ধে হাজারো অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগ এলেও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয় না বললেই চলে। বড় বড় অপরাধেও তাদের সর্বোচ্চ ‘তিরস্কৃত করা হলো’ মর্মে চিঠি পাঠিয়েই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা নিজেদের দায়িত্ব এড়ান শুধু।

শিক্ষকদের আহাজারি-অভিশাপ : দেশের প্রায় ৩০ হাজার সরকারি- বেসরকারি মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান; ইবতেদায়ি, দাখিল ও আলিম মাদ্রাসার প্রায় ১০ লাখ শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী আছেন। তাদের চাকরি সংক্রান্ত যাবতীয় কাজ ঢাকার এই শিক্ষা ভবন ও মাদ্রাসা বোর্ডের কব্জায়। সারা দেশ থেকে প্রতিদিন এখানে নানা কাজে আসেন গড়ে প্রায় তিন হাজার শিক্ষক-কর্মচারী। এই ভবনে ঘুষ ছাড়া কোনো কাজ হয় না বললেই চলে। এখানে সারা দেশ থেকে আসা শিক্ষকদের হাতে কলমে ঘুষ বাণিজ্য শেখানো হচ্ছে নিত্যদিন। শিক্ষকতা থেকেই প্রেষণে কর্মকর্তা হিসেবে অধিদফতরে নিয়োগ পাওয়া ব্যক্তিরাই নির্লজ্জভাবে শেখান কীভাবে ঘুষের খাত খুঁজে বের করতে হয়, কীভাবে নিতে হয় টাকা। ঘুষের দাবি আদায়ের ক্ষেত্রে কেমন রূঢ় ভাষা ব্যবহার ও কর্কশ আচরণ করতে হয়- তা গলা ধাক্কা দিয়ে গেটের বাইরে বের করে দিয়েই নিরীহ শিক্ষকদের শেখানো হয়। এসব অপ্রত্যাশিত আচরণে বয়সী অনেক শিক্ষক কষ্ট-ক্ষোভে রাস্তায় দাঁড়িয়েই হাউমাউ করে কেঁদে ফেলেন। কেউবা সারা জীবনের চাকরি সূত্রে পাওয়া পেনশনের টাকার দাবি অবলীলায় ছেড়ে দেন। এরপর শিক্ষা ভবনের ছাদের দিকে তাকিয়ে জোর গলায় অভিশাপ দিয়ে বলেন, বাকি জীবন হাত পেতে ভিক্ষার চালে জীবন ধারণ করব, তবু পেনশন তুলতে আর কোনো দিন আসব না। সীমাহীন হয়রানির শিকার ভুক্তভোগী শিক্ষকদের আহাজারি কান্না আর হাত তুলে অভিশাপ বর্ষণের দৃশ্য প্রায়ই দেখতে পান শিক্ষা ভবনের আশপাশের রাস্তায় যাতায়াতকারী মানুষজন।

সিসি ক্যামেরা : ঘুষ-হয়রানি চলছেই : শিক্ষা ভবনে ৩২টি ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা বসিয়েও ঘুষ লেনদেন আর শিক্ষক হয়রানি ঠেকানো যায়নি। পেনশন হয়রানি বন্ধের ব্যাপারে দুর্নীতি দমন কমিশনের পক্ষ থেকে সুনির্দিষ্ট সুপারিশ দেওয়া হয়েছে। একাধিকবার দুদক টিম শিক্ষা ভবনের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণও করেছে। অতিসম্প্রতি মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরে (মাউশি) বদলি ও পদোন্নতিতে ব্যাপক ঘুষ লেনদেনের অভিযোগে শিক্ষা ভবনে অভিযানও চালায় দুদক। তবে শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক দুদক টিমকে জানান, দুর্নীতির কারণে বদলি ও পদোন্নতি কার্যক্রমে পুরোপুরি স্বচ্ছতা আনা যাচ্ছে না। তবে ভুক্তভোগী শিক্ষকদের সমস্যা নিরসনে অভিযোগকারী শিক্ষকদের সরাসরি শুনানির মাধ্যমে অভিযোগগুলো সমাধানের চেষ্টা চালাচ্ছেন বলেও দাবি করেন মহাপরিচালক।

সর্বশেষ খবর