দীর্ঘ ২৮ বছর বন্ধ থাকার পর অবশেষে হতে যাচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচন। দেশ যখন স্বৈরতন্ত্রের হাত থেকে নিস্তার পেয়ে গণতন্ত্রের পথে হাঁটা শুরু করেছিল, ঠিক তখনই বন্ধ হয়ে যায় দেশের গণতন্ত্রচর্চার প্রাণকেন্দ্র ডাকসু নির্বাচন। তবে দীর্ঘদিন পর হলেও এবার হতে যাচ্ছে বহুল প্রত্যাশিত এ নির্বাচন। গতকাল ঘোষণা করা হয়েছে ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনের তফসিল। সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে ডাকসু নির্বাচন পরিচালনায় নিযুক্ত চিফ রিটার্নিং অফিসার অধ্যাপক ড. এস এম মাহফুজুর রহমান এ তফসিল ঘোষণা করেন। একই সঙ্গে হল সংসদ নির্বাচনের তফসিলও সংশ্লিষ্ট হলসমূহের নোটিস বোর্ডে প্রকাশ করা হয়। ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী গতকালই প্রকাশ করা হয় খসড়া ভোটার তালিকা। হলভিত্তিক এ তালিকা পাওয়া যাচ্ছে হলের নোটিস বোর্ড ও ডাকসু ওয়েবসাইট (ducsu.du.ac.bd)-এ। এদিকে তফসিল ঘোষণা নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে ক্যাম্পাসে ক্রিয়াশীল ছাত্র সংগঠনগুলো। প্রকাশিত ডাকসু নির্বাচনের তফসিলে বলা হয়েছে, ডাকসু গঠনতন্ত্রের ৬(বি) ও ৭(এ) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ২৫টি পদে নির্বাচন আগামী ১১ মার্চ হবে। পদগুলো হলো- ১. সহসভাপতি, ২. সাধারণ সম্পাদক, ৩. সহসাধারণ সম্পাদক, ৪. স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ সম্পাদক, ৫. বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পাদক ৬. কমনরুম ও ক্যাফেটেরিয়া সম্পাদক ৭. আন্তর্জাতিক সম্পাদক, ৮. সাহিত্য সম্পাদক, ৯. সংস্কৃতিবিষয়ক সম্পাদক, ১০. ক্রীড়া সম্পাদক, ১১. ছাত্র পরিবহন সম্পাদক, ১২. সমাজসেবা সম্পাদক, ১৩. সদস্য ১৩ জন।
এদিকে গতকাল ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনের খসড়া ভোটার তালিকা প্রকাশিত হয়। মোট ২০টি হলের নোটিস বোর্ড ও ডাকসু ওয়েবসাইটে এ তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। এতে হলের বৈধ আবাসিক ও অনাবাসিক শিক্ষার্থীদের তথ্য রয়েছে। খসড়া ভোটার তালিকার ব্যাপারে যে কোনো আপত্তি ১৮ ফেব্রুয়ারি সোমবার বিকাল ৪টা পর্যন্ত গ্রহণ করবে হল প্রশাসন। এজন্য ভুলত্রুটি সংশোধনের আপত্তি লিখিতভাবে সংশ্লিষ্ট হলের রিটার্নিং অফিসারের কাছে দাখিল করতে হবে। সংশোধনের পর ২০ ফেব্রুয়ারি বুধবার বিকাল ৪টায় চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশ করা হবে। ওই তালিকা হলসমূহের নোটিস বোর্ড ও ডাকসু ওয়েবসাইটে পাওয়া যাবে।
তফসিলে আরও বলা হয়েছে, ডাকসু নির্বাচনে প্রার্থী হতে ইচ্ছুক শিক্ষার্থীরা ১৯ ফেব্রুয়ারি মঙ্গলবার থেকে ২৫ ফেব্রুয়ারি সোমবার পর্যন্ত স্ব স্ব হলের প্রাধ্যক্ষের অফিস থেকে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করতে পারবেন। মনোনয়নপত্র পূরণ শেষে তা ২৬ ফেব্রুয়ারি সকাল ৯টা থেকে ১২টা পর্যন্ত রিটার্নিং অফিসারদের কাছে জমা দেওয়া যাবে। ২৬ ফেব্রুয়ারি নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবনের সেমিনার কক্ষে রিটার্নিং অফিসাররা এসব মনোনয়নপত্র বাছাই করবেন। বাছাই শেষে পরদিন ২৭ ফেব্রুয়ারি বেলা ১২টায় হলের নোটিস বোর্ড ও ডাকসু ওয়েবসাইটে প্রার্থীদের প্রাথমিক তালিকা প্রকাশ করা হবে। প্রকাশিত তালিকায় কোনো প্রার্থীর আপত্তি থাকলে তা ২৮ ফেব্রুয়ারি বেলা ১২টার মধ্যে ডাকসু সভাপতির (উপাচার্য) কাছে লিখিতভাবে জানাতে হবে। ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী, কোনো প্রার্থী চাইলেই তার মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করতে পারবেন। এজন্য লিখিত ও স্বাক্ষরকৃত আবেদনপত্রসহ সংশ্লিষ্ট হলের রিটার্নিং অফিসারের কাছে ব্যক্তিগতভাবে উপস্থিত হয়ে তার মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করতে হবে। প্রত্যাহারের সুযোগ থাকবে ২ মার্চ বেলা ১টা পর্যন্ত। প্রার্থীদের চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করা হবে ৩ মার্চ বিকাল ৪টায়। হলগুলোর নোটিস বোর্ড ও ডাকসু ওয়েবসাইটে এ তালিকা প্রকাশ করা হবে। বিভিন্ন কারণে যারা চূড়ান্ত ভোটার তালিকায় স্থান পাননি তাদের অন্তর্ভুক্ত করে ৫ মার্চ বেলা ১২টায় সম্পূরক ভোটার তালিকা প্রকাশ করা হবে। এ তালিকাও হলগুলোর নোটিস বোর্ড ও ডাকসু ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হবে।পরে ১১ মার্চ সকাল ৮টা থেকে অপরাহ্ণ ২টা পর্যন্ত একটানা ভোট গ্রহণ করা হবে। ছাত্র সংগঠনগুলোর প্রতিক্রিয়া : এদিকে ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে ক্যাম্পাসে ক্রিয়াশীল ছাত্র সংগঠনগুলো। সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ তফসিলকে স্বাগত জানিয়েছে। অন্যদিকে ছাত্রদল ও বাম ঘরানার ছাত্র সংগঠনগুলো ‘পরিবেশ নিশ্চিতের আগেই’ তফসিল ঘোষণা করা হয়েছে দাবি করে তাদের নিজেদের দাবি আদায়ে আন্দোলনের ইঙ্গিত দিয়েছে।
তফসিল ঘোষণার পর প্রশাসনকে স্বাগত জানিয়ে বেলা ৩টার দিকে শুভেচ্ছা মিছিল করে ছাত্রলীগ। মিছিলটি বিশ^বিদ্যালয় প্রাঙ্গণ প্রদক্ষিণ শেষে সমাবেশ করে। এতে ছাত্রলীগ সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন বলেন, ‘আমাদের এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছে। তার নেতৃত্ব দিয়েছিল এই ডাকসু। সেই পুরনো ইতিহাস, দীর্ঘ ২৮ বছর পর আমরা ডাকসু ফিরে পেয়েছি। ডাকসু নির্বাচনের তফসিল ঘোষিত হয়েছে। একে আমরা স্বাগত জানাই।’ এর আগে দুপুর ১টার দিকে ভোট কেন্দ্র আবাসিক হলের বাইরে একাডেমিক ভবনে করার দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করে বামপন্থি প্রগতিশীল ছাত্রজোট ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ছাত্র ঐক্য। সমাবেশের পর বিকালে ‘নির্বাচনের পরিবেশ তৈরির তফসিল দেওয়া হয়েছে’ দাবি করে প্রগতিশীল ছাত্রজোটের সমন্বয়ক ছাত্র ফ্রন্টের ঢাবি শাখার সভাপতি সালমান সিদ্দিকী বলেন, ‘হলগুলোয় এখনো ভীতিকর পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এ অবস্থায় সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। আমরা ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ছাত্রঐক্য গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি ও ভোট কেন্দ্র হলের বাইরে করার দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে প্রশাসনকে বাধ্য করব দাবি মেনে নিতে।’ একই সঙ্গে জোটগতভাবে তারা নির্বাচনের প্রস্তুতি নেবেন বলেও জানান তিনি। এদিকে ‘অধিকাংশ’ ছাত্র সংগঠনের দাবি উপেক্ষা করেই তফসিল দেওয়া হয়েছে মন্তব্য করে বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার পরিষদের যুগ্ম-আহ্বায়ক নুরুল হক নুর বলেন, ‘এখনো ক্যাম্পাসে অন্য কোনো ছাত্র সংগঠন তাদের কার্যক্রম চালাতে গেলে ছাত্রলীগের নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। এসব ঘটনার একটিরও বিচার করেনি প্রশাসন। তাই প্রশাসনের কাছে অনুরোধ- তারা যেন আজকে থেকে ক্যাম্পাসে তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। আমাদের ভোট কেন্দ্র হলের বাইরে করার যে দাবি তার সঙ্গে একমত ছাত্র সংগঠনগুলোকে সঙ্গে নিয়ে আমরা প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করব।’