বিদেশে বাংলাদেশের কূটনৈতিক মিশনগুলোকে গণমুখী করার চ্যালেঞ্জ নিয়েছে সরকার। বিদেশ-বিভুয়ে খেটে খাওয়া মানুষগুলোর নিজ দেশের দূতাবাসে গিয়ে ভোগান্তি-দুর্ব্যবহারের শেষ দেখতে চায় সরকার। চ্যালেঞ্জ নেওয়া হয়েছে প্রবাসীবান্ধব মিশন করার। টার্গেট বিশ্বের অন্যান্য দেশের প্রবাসীদের মতো বাংলাদেশি প্রবাসীদের জন্যও দূতাবাসকে প্রয়োজনে বন্ধু বানানো। সেই সঙ্গে কূটনৈতিক মিশনগুলোর কার্যকারিতাও বাড়াতে চায় সরকার। নতুন বিনিয়োগ-বাণিজ্য ও শ্রমবাজার তৈরির জন্য যে ধরনের ব্র্যান্ডিং প্রয়োজন সেটাতেও কূটনৈতিক মিশনগুলোকে ব্যর্থ মনে করা হচ্ছে। শুধু নামসর্বস্ব রোড-শো বা আলোচনা অনুষ্ঠানের বাইরে সত্যিকার ‘বাংলাদেশ ব্র্যান্ডিং’-এর জন্য পেশাদারদের কাছ থেকে গণমুখী কূটনীতি প্রত্যাশা করছে সরকার।
প্রবাসীদের অভিযোগ, কথায় কথা বলা হয়, প্রবাসীরা দেশের অর্থনীতি সচল রাখছে। কিন্তু বাস্তবে প্রবাসীরা কোথাও তেমন মর্যাদা পান না। কর্মীদের বিদেশ যাওয়ার পথে ভোগান্তি, সেখানে যতদিন থাকে তখন ভোগান্তি, ফেরার পর ভোগান্তি। তবে সবচেয়ে কষ্টের বিষয় বেশিভাগ সময় দূতাবাসে সাহায্যের জন্য গেলে সেখানে পদে পদে ভোগান্তি, অসম্মান ও অবহেলা। ওমান প্রবাসী সাইফুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, অন্য দেশের লোকেরা যখন দেখে বাংলাদেশিরা নিজ দেশের দূতাবাসেই সম্মান পায় না, তখন সে দেশের মানুষজনও আমাদের কর্মীদের অসম্মান করে। আমরা যদি নিজের দেশের লোককে মর্যাদা না দেই, তাহলে অন্য দেশও দেবে না। আমাদের অর্থনীতিতে যারা এত অবদান রাখছে, তাদের সম্মান দেওয়াটা জরুরি উল্লেখ করে মালয়েশিয়া প্রবাসী সিকান্দার আবু জাফর বলেন, বাংলাদেশের প্রবাসী শ্রমিকদের বেশিরভাগই স্বল্প শিক্ষিত। তাই তারা যখন নিজেদের পাসপোর্ট বা অন্যান্য সেবা নিতে যান তখন তাদের সহজ ভাষায় বুঝিয়ে বলা প্রয়োজন। কিন্তু দূতাবাসের কর্মকর্তাদের দেখাই পাওয়া যায় না। দেখা হলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কর্মকর্তারা ভালো ব্যবহার করেন না। শ্রমঘন দেশগুলোতে থাকা প্রবাসীদের সাধারণ অভিযোগ, দূতাবাসের নিম্নপদস্থ কর্মচারী ও সাধারণ কর্মকর্তাদের সঙ্গে দালালদের যোগসাজশে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে দুর্নীতি হয়। সিন্ডিকেটের মাধ্যমে টাকা দিলে সহজেই কাজ হয়, না হলে বছরের পর বছর ঘুরতে হয়। অথচ এসব অভিযোগ দেওয়ার জন্য খুঁজলেও পদস্থ কূটনীতিকদের সঙ্গে দেখা করারই সুযোগ হয় না সাধারণ প্রবাসীদের। সৌদি আরব প্রবাসী ব্যবসায়ী রাহাত আহমেদ মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশে নিজের অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়ে বলেন, দূতাবাসে সাধারণ কর্মীদের সাক্ষাৎ পাওয়াটাই দুষ্কর। আর মিশনের দায়িত্বে থাকা কূটনীতিকরা সাধারণ প্রবাসীদের কাছে রীতিমতো আকাশের চাঁদ। হাতেগোনা জাতীয় কয়েকটি অনুষ্ঠানে শুধু বক্তব্য দেওয়ার সময়ই তাদের দেখতে পাওয়া যায়। তাও আমন্ত্রিত প্রবাসীরাই সেই সুযোগ পায়। শুধু প্রবাসীরাই নন, এসব অভিযোগের সঙ্গে প্রায় একমত পরিকল্পনা মন্ত্রী এম এ মান্নান। গত সপ্তাহে অভিবাসন নিয়ে এক অনুষ্ঠানে তিনি খোলাখুলিই বলেছেন, দূতাবাসগুলো প্রবাসীদের কাক্সিক্ষত সেবা দিচ্ছে না। দূতাবাসগুলো মোটেও অভিবাসীবান্ধব নয়। দূতাবাসগুলোর যেখানে ২৪ ঘণ্টা প্রবাসীদের সেবা দেওয়া উচিত, সেখানে তারা ঘড়ি ধরে দিন দেখে সেবা দেন। দূতাবাসে কর্মরতদের আরও বেশি সেবামূলক ও দায়িত্বশীল মনোভাব থাকা প্রয়োজন। বর্তমান সরকার বিদেশ গমনইচ্ছুক ও প্রবাসীদের কল্যাণে নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছে কিন্তু এর সফলতা নির্ভর করবে মিশনগুলোর ওপরই। দূতাবাসগুলো হবে শ্রমিক বাজারের প্রধান কেন্দ্র। আমাদের রফতানি বাজারের প্রধান অফিস। প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী ইমরান আহমেদও দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রবাসীদের প্রয়োজনীয় সেবার ব্যবস্থা না থাকার কথা বলেছেন। তবে প্রতিমন্ত্রী আন্তরিকভাবে সেবা প্রদানের অঙ্গীকার করে বলেছেন, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে রেমিট্যান্সের অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যারা অনেক কষ্ট করে দেশে বৈদেশিক মুদ্রা পাঠাচ্ছেন তাদের কল্যাণে ও মর্যাদা রক্ষায় সরকার বদ্ধপরিকর। তারাই বিদেশের মাটিতে দেশের মর্যাদা রক্ষায় কাজ করছেন। তাই দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হয় এমন কাজ তারা যেমন করবে না তেমনি দূতাবাসগুলোকেও তাদের পাশে থাকতে হবে বন্ধুর মতো। তিনি ইতিমধ্যেই প্রবাসীদের উদ্দেশে বলেছেন, প্রবাসীদের সমস্যার সমাধানে আমার আন্তরিক চেষ্টা আছে। আপনাদের সমস্যা নিয়ে আপনারা অফিসে আসুন। কথা বলে আপনাদের সব সমস্যার সমাধান করা হবে।’ অন্যদিকে, প্রবাসীদের অধিকার নিয়ে প্রায় যুগের বেশি সময় ধরে কাজ করা অধ্যাপক ড. এ কে আবদুল মোমেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হওয়ায় আশায় বুক বেঁধেছেন প্রবাসীরা। যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী অধ্যাপক তানভীর চৌধুরীর মতে, এতদিন দূতাবাসের সেবা বঞ্চনা নিয়ে সোচ্চার ও উচ্চকণ্ঠ ছিলেন ড. মোমেন। দীর্ঘ সময় প্রবাসে থাকায় চেষ্টা করলে তার পক্ষে পরিস্থিতির পরিবর্তন সম্ভব বলে বিশ্বাসী এই প্রবাসীরা। অবশ্য পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন ইতিমধ্যেই কয়েকদফায় সাংবাদিকদের সঙ্গে আলোচনায় প্রবাসীদের সঙ্গে দেশের সম্পৃক্ততা বাড়াতে পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেন বলেন, ইতিমধ্যে বাংলাদেশি মিশনগুলোকে নির্দেশনা দিয়েছি প্রবাসীদের ডাটাবেজ তৈরি করতে। এর মাধ্যমে তাদের সমস্যা সমাধানের পাশাপাশি দেশের উন্নয়নে প্রবাসীদের সম্পৃক্ত করা যাবে। বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশিদের অভিজ্ঞতা ও কর্মক্ষমতা কাজে লাগানোর জন্য পরিকল্পিত এই ডাটাবেজ কাজে লাগবে। এছাড়া প্রবাসী দিবস নিয়েও সরকার সিরিয়াসলি ভাবছে। এ দিনটি উদযাপনের বিষয়টি এখনো সরকারিভাবে উত্থাপিত হয়নি।
যতদিন না হয় ততদিন আমরা বেসরকারিভাবে দিবসটি উদযাপন করব। প্রবাসী সপ্তাহ উদযাপন নিয়েও চিন্তা চলছে। তিনি বলেন, দেশের উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে আরও বিনিয়োগ ও প্রযুক্তি দরকার। এ বিষয়ে প্রবাসীরা আমাদের সাহায্য করতে পারেন। তারা বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে পারেন, সে জন্য আমার মন্ত্রণালয় থেকে সব ধরনের সাহায্য-সহযোগিতা করব। দেশের ৪৯ ভাগ মানুষের বয়স ২৫ বছরের নিচে। এই জনগণকে আমাদের কাজে লাগাতে হবে। প্রবাসীদের উদ্দেশে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, ‘আপনারা যাঁরা দেশের বাইরে আছেন, তাঁরা মিশনে গিয়ে আপনাদের পেশাগত তথ্য দেবেন। এতে আপনাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে আমাদের সুবিধা হবে। আপনাদের কাছে আমরা সহজে পৌঁছাতে পারব।’