মঙ্গলবার, ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা
ইডেনের সাবেক অধ্যক্ষ খুন

শ্বাসরোধেই হত্যা, খুনি একাধিক

সাখাওয়াত কাওসার

শ্বাসরোধেই হত্যা, খুনি একাধিক

ইডেন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ মাহফুজা  চৌধুরী পারভীনকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে। খুনি ছিল একাধিক। নিহতের মুখে রক্ত এবং শরীরের বিভিন্ন অংশে ক্ষতচিহ্নের উল্লেখ করে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ময়নাতদন্ত সংশ্লিষ্টরা। অন্যদিকে হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে দুই গৃহকর্মী ও তাদের সরবরাহকারীকে খুঁজছে পুলিশ। বিশ্লেষণ চলছে রাজধানীর ৩৫ নম্বর মিরপুর রোডের সুকন্যা টাওয়ারের ৩২টি সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ। পুলিশ বলছে, গৃহকর্মী রুমা ওরফে রেশমা (৩০) ও স্বপ্না (৩৫) এবং তাদের সরবরাহকারী রায়েরবাজারের রাকিবের মা ছাড়া অন্য কেউ এ ঘটনায় জড়িত কি না তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তবে নিহতের স্বামী ইসমত কাদির গামা বলছেন, তাদের কোনো শত্রু নেই। দুই গৃহকর্মীর দিকেই সন্দেহ তাদের। গতকাল বনানী কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়েছে।

পুলিশের ধারণা, মাহফুজা চৌধুরী খুন হয়েছেন বিকাল সাড়ে তিনটা থেকে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার মধ্যে। খুনি ছিল একাধিক। ধস্তাধস্তির অনেক চিহ্ন রয়েছে নিহতের শরীরে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই পরিবারের গাড়িচালক সুজন শেখের সঙ্গে রবিবার বেলা তিনটা ২১ মিনিটে সর্বশেষ কথা হয়েছে নিহত মাহফুজার। এ প্রতিবেদককে সুজন বলেন, গত তিন মাস ধরে ১৪ হাজার টাকা বেতনে আমি চাকরি করছি। গতকাল (রবিবার) আমাকে বেতন দিয়েছেন তিনি। এর আগে ফোন করে তিনি আমাকে পান নিয়ে যেতে বলেছিলেন। ৭০ টাকার পান নিয়ে গিয়েছিলাম আমি। ম্যাডাম আমাকে ১০০ টাকা দিয়েছিলেন। বলেছিলেন আগামীকাল আবার বাকি টাকার পান নিয়ে আসতে। সুজন আরও বলেন, বেতন নিতে বাসায় যাওয়ার সময় দুই বুয়াকে আমি বাসাতেই দেখেছিলাম।  নিহতের স্বামী ইসমত কাদির গামা বলেন, বাসায় রাখা ৫০ হাজার টাকার মধ্যে ৩৫ হাজার টাকা ওর (মাহফুজা) দাঁতের চিকিৎসার জন্য রাখা ছিল। আজ (সোমবার) দাঁতের ডাক্তারের কাছে যাওয়ার কথা ছিল। খুনিরা তার বাসা থেকে ২০ ভরি ওজনের স্বর্ণালঙ্কার এবং একটি মোবাইল সেট নিয়ে গেছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, রায়েরবাজারের রাকিবের মা, রেখা এবং মমতা তাদের কাজের বুয়া সরবরাহ করতেন। যোগদানের কয়েক দিন পরেই বুয়ারা কাজ করতে চাইত না। সে জন্য আবার নুতন বুয়ার বিষয়ে তাদের বলা লাগত। প্রতিটি নতুন বুয়ার জন্য তিন হাজার টাকা করে নিত তারা। সাইন্স ল্যাবরেটরি মোড় সংলগ্ন প্রিয়াঙ্গন শপিং সেন্টারের ঠিক পেছনেই অবস্থান সুকন্যা টাওয়ারের। ২০ তলা এই ভবনের ১৬/সি নম্বর ডুপ্লেক্স ফ্ল্যাটে বসবাস ছিল আওয়ামী লীগ নেতা ইসমত কাদির গামা ও মাহফুজা চৌধুরী দম্পতির।

 দুই ছেলের একজন মেজর অভিক যশোর ক্যান্টনমেন্টে কর্মরত। ছোট ছেলে অমিত তার এক মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে থাকেন ইন্দিরা রোডে। গতকাল বেলা দেড়টার দিকে সরেজমিন সুকন্যা টাওয়ারে গিয়ে দেখা যায়, অসংখ্য মানুষের ভিড়। ভবনের নিচতলার পার্কিংয়ে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত অ্যাম্বুলেন্সে রাখা আছে মাহফুজা চৌধুরীর মৃতদেহ। প্রিয় শিক্ষিকা-সহকর্মী-স্বজনের এমন নির্মম মৃত্যুর খবর শুনে ছুটে এসেছেন অনেকে। নীরবে চোখের পানি ঝরছিল তাদের চোখ থেকে।

জানা গেছে, গত ৪ জানুয়ারি শনিবার রেশমা গৃহকর্মী হিসেবে কাজে যোগ দেয়। তার বাবার নাম আবদুর রশীদ। বাড়ি ফরিদপুরের বোয়ালমারী থানার মজিরদিতে। স্বপ্না কাজে যোগ দেয় ২ ফেব্রুয়ারি। তার বাবার নাম আবদুল করিম। কিশোরগঞ্জের ইটনা রায়েরকুটিতে তার গ্রামের বাড়ি। অপর গৃহকর্মী রাশিদা ওরফে পারভীন দীর্ঘদিন ধরেই গামা-মাহফুজা দম্পতির বাসায় কাজ করছে। 

ঢাকা মহানগর পুলিশের রমনা বিভাগের উপকমিশনার মারুফ হোসেন সরদার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, হত্যাকাে  জড়িতদের গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত আছে। ধারণা করা হচ্ছে, এজাহারভুক্ত দুই গৃহকর্মীই হত্যাকাে  জড়িত এবং আরেকজন তাদের সহযোগী।

এদিকে গতকাল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ময়নাতদন্ত শেষে বেলা ১২টার দিকে অধ্যক্ষের লাশ নিয়ে যাওয়া হয় তার শেষ কর্মস্থল ইডেন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে। সেখানে তৈরি হয় এক হৃদয়বিদারক পরিবেশের। এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তার অবদানের কথা স্মরণ করে হাউমাউ করে কাঁদছিলেন কলেজের স্টাফ, সহকর্মী ও ছাত্রীরা। ২০১১ সালে ইডেন কলেজ থেকেই অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন শেষে অবসরে যাওয়ার কথা ছিল তার। তবে সরকার তিন বছর চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়ায় ২০১৩ সালে অবসরে যান মাহফুজা চৌধুরী। ইডেন কলেজে প্রথম দফা জানাজা শেষে তাকে নিয়ে আসা হয় সুকন্যা টাওয়ারে।

বর্তমান অধ্যক্ষ ড. শামসুন্নাহার বলেন, কলেজের বঙ্গবন্ধু কর্নার, কলেজের গেট নির্মাণ, ছাত্রী হল নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন তিনি। তার হত্যাকারীদের দ্রুততর সময়ের মধ্যে আইনের আওতায় নিয়ে আসার দাবি জানান তিনি।

র‌্যাব-২ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ বলেন, আমরা বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছি। আশা করছি খুব শিগগিরই অপরাধীরা ধরা পড়বে।

প্রসঙ্গত, গত রবিবার সুকন্যা টাওয়ারের নিজ ফ্ল্যাটে খুন হন মাহফুজা চৌধুরী। এ ঘটনার পর থেকেই বাসার দুই গৃহকর্মী পলাতক। তবে বাসায় থাকা আরেক গৃহকর্মী রাশিদাকে (৫৫) নিউ মার্কেট থানায় নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের পর ছেড়ে দেয় পুলিশ। গতকাল এ ঘটনায় নিহতের স্বামী ইসমত কাদির গামা বাদী হয়ে মামলা করেছেন।

সর্বশেষ খবর