শনিবার, ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

শোকের মাতম কান্না আহাজারি

৪৬ লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর, ডিএনএ টেস্টে বাকিদের শনাক্ত করা হবে

মাহবুব মমতাজী

শোকের মাতম কান্না আহাজারি

গতকাল রাজধানীর চকবাজার দুর্ঘটনাস্থলের মসজিদে নামাজ শেষে নিহতদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে মোনাজাতের সময় সর্বস্তরের মানুষ কান্নায় ভেঙে পড়েন -বাংলাদেশ প্রতিদিন

পুরান ঢাকার চকবাজারে অগ্নিকাণ্ডে নিহতদের স্বজনরা এখনো আহাজারি করছেন। দুই দিন আগেও রিকশা-গাড়ি আর মানুষে সরগরম ছিল নন্দকুমার দত্ত গলি। মুহূর্তের আগুনে পুড়ে চকবাজারের চুড়িহাট্টা মোড় এখন ধ্বংসস্তূপ। শোকে স্তব্ধ এলাকাটি। চুড়িহাট্টার মতো ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল, আজিমপুর কবরস্থান ও নোয়াখালীর সোনাইমুড়ীতেও স্বজনদের আহাজারি চলছে। থামছে না মাতম। গতকালও ধ্বংসস্তূপ, হাসপাতাল আর মর্গে অনেকে ছোটাছুটি করেছেন নিখোঁজ স্বজনের খোঁজে। প্রিয়জনের শেষ বিদায়ে হাউমাউ করে কান্নায় ভেঙে পড়েন কেউ কেউ। মানুষের হৃদয়বিদারক এমন দৃশ্যে ভারি হয়ে যায় আশপাশের বাতাস। চুড়িহাট্টায় ধ্বংসস্তূপ অপসারণের সময় অনেককে শোকে পাথর হয়ে অপেক্ষা করতে দেখা গেছে নিখোঁজের লাশ ফিরে পাওয়ার আশায়। ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর লাশের এমন মিছিলে নিস্তব্ধতা ছড়িয়েছে সবার মাঝে। এদিকে একসঙ্গে ১৩ জনের লাশের খবরে শোকের ছায়া ছড়িয়ে পড়ে নোয়াখালীর সোনাইমুড়ী উপজেলার নাটেশ্বরে। স্বজন হারানোর বেদনায় শোকে মুহ্যমান পরিবারের সদস্যরা। বৃহস্পতিবার রাত ও গতকাল সকাল থেকে নিজ নিজ এলাকার নিহত কয়েকজনের লাশ দাফন সম্পন্ন হয়। এদিকে ঢামেক হাসপাতালে থাকা ৬৭টি পোড়া লাশের মধ্যে হস্তান্তর করা হয়েছে ৪৬টি। এর মধ্যে  ১৪ জনকে দাফন করা হয়েছে আজিমপুর কবরস্থানে। শোকে কাতর রুবিনা ইয়াসমিন ছেলের সন্ধানে গতকালও ঘুরছিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে। তিনি নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তানজিবুল হাসান রোহানের মা। ছেলে হারানোর কষ্টে বিদীর্ণ তার হৃদয়। বলছিলেন, ‘আমার ছেলেডারে আইনা দাও। আমি জানি অয় নাই। অর লাশ লাগব না। শরীরের একটা টুকরা দেও। আমি ওইডা নিয়াই বাঁচুম।’ চকবাজারের ভয়াবহ অগ্নিকাে র পর থেকে নিখোঁজ রোহান। ছেলের লাশের সন্ধানে কেঁদে কেঁদে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন তার মা-বাবা। কখনো মর্গে, কখনো মর্গের পুলিশবক্সে, কখনো বা জেলা প্রশাসনের তথ্য কেন্দ্রে।

মর্গের সামনে রোহানের চাচা আলমগীর খান জানান, ‘রোহানরা তিন ভাই। সে সবার বড় এবং নর্থসাউথের বিবিএ প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী। তাদের গ্রামের বাড়ি চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জে। পুরান ঢাকার আগা মসিহ লেনে তাদের বাড়ি আছে। বুধবার রাতে দুই মোটরসাইকেলে চার বন্ধু মিলে গিয়েছিল চকবাজারে। রোহানের মোটরসাইকেলটি ছিল সামনে। সঙ্গে তার এক বন্ধু আরাফাত ছিল। তার আরেক বন্ধু লাবিবের মোটরসাইকেলটি ছিল পেছনে। হায়দার বক্স লেন দিয়ে তারা যখন চুড়িহাট্টা মসজিদের সামনে তখনই ঘটে বিস্ফোরণ। সামনে থাকায় বিস্ফোরণের আগুন সঙ্গে সঙ্গে লেগে যায় রোহান আর আরাফাতের শরীরে। এ দৃশ্য দেখে লাবিব তার সঙ্গে থাকা অন্য বন্ধুকে নিয়ে ঘটনাস্থলেই মোটরসাইকেল ফেলে পেছনের দিকে পালিয়ে যায়। আগুনের ঘটনা বৃহস্পতিবার রাতে রোহানের পরিবারকে জানায় লাবিব। আরাফাতের লাশটি পাওয়া গেলেও মেলেনি রোহানের লাশ।

রুবিনা-হাসান দম্পতি ছাড়াও প্রিয়জনের সন্ধানে ভিড় জমান আরও অনেকে। পুড়ে অঙ্গার হওয়া লাশ শনাক্ত করতে গতকাল পুলিশের অপরাধ তদন্ত (সিআইডি) বিভাগের অস্থায়ী ক্যাম্প চালু করা হয়। সেখানে ডিএনএ টেস্টের জন্য নমুনা হিসেবে রক্ত, চামড়া ও চুল জমা দেন ২০ জন। এদিকে ফ্রিজ সংকটের কারণে ঢামেক মর্গে লাশের জায়গাও মিলছে না। অশনাক্ত হওয়া ২১টি লাশের মধ্যে ঢামেকে ৩, হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে ৫, কুর্মিটোলায় ৩, সোহরাওয়ার্দীতে ৫ ও মিটফোর্ড হাসপাতালে ৫টি লাশ রাখা হয়েছে বলে জানান ঢাকার জেলা প্রশাসক আবু ছালেহ মো. ফেরদৌস খান।

জানা যায়, আজ শনিবার পর্যন্ত ঢামেক মর্গে ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করবে সিআইডি। এর পর থেকে সিআইডির ল্যাবে যোগাযোগ করতে হবে। সিআইডির অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিএনএ অ্যানালিস্ট নুসরাত ইয়াসমিন সাংবাদিকদের বলেন, ‘অত্যাধুনিক ডিএনএ ল্যাবরেটরিতে সংগৃহীত নমুনা পরীক্ষা করা হবে। নিহতদের ডিএনএ নমুনার সঙ্গে স্বজনদের ডিএনএ মিলে গেলেই পুলিশের মাধ্যমে লাশ হস্তান্তর করা হবে। বেশির ভাগ লাশই পোড়া, এ কারণে আমাদের সময় লাগবে। এ ক্ষেত্রে ছয় মাসও লেগে যেতে পারে।’

ঝলসে যাওয়া চেহারা আর পুড়ে যাওয়া শরীর চিনতে না পারায় ডিএনএ টেস্টের রিপোর্টের জন্য অপেক্ষা করতে হবে পাঁচ বছরের শিশু সানিনকেও। সকাল থেকে মামার কোলে চড়ে পুরো মর্গ এলাকায় মায়ের খোঁজ করে সে। তখনো শিশুটি বুঝে উঠতে পারেনি, কী হয়েছে! সবাই বলছে, তার মা আর নেই। বাসার নিচে যাওয়ার পর তার মা কোথায় গেল জানে না সানিন। মায়ের জন্য সানিনের পাঁচ মাস বয়সী ছোট্ট অবুঝ বোন বিবি মরিয়মও কাঁদছে সারাক্ষণ। বুধবার রাতে আগুনের ঘটনায় সানিনের মা বিবি হালিমা বেগম শিলা নিখোঁজ রয়েছেন। শিলার লাশ খুঁজে পেতে মেয়ে সানিন ও তার বাবা জহিরুল হক সুমনেরও ডিএনএ নমুনা নিয়েছেন চিকিৎসকরা।

চকবাজারে অগ্নিকােন্ডর ঘটনাস্থল থেকে ২০০ গজ দূরেই পরিবার নিয়ে থাকতেন শিলা। শিলার স্বামী সুমন চকবাজারেই ব্যাগের ব্যবসা করেন। তবে ওই রাতের আগুন তাদের ঘর পর্যন্ত পৌঁছায়নি। ভাগ্যই শিলাকে আগুনের কাছে নিয়ে গেছে। ঘটনার দিন সানিন অসুস্থ থাকায় শিলা নিচে গিয়েছিলেন ওষুধ কিনতে। সেই ওষুধের দোকান থেকে ওষুধ নিয়ে তার ফেরা হয়নি।

শ্রমিক নিরাপত্তা ফোরামের উদ্বেগ : এদিকে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে অগ্নিকাে  ৭৮ জনের মৃত্যু এবং আরও ৪১ জন আহতের ঘটনায় শ্রমিক নিরাপত্তা ফোরাম (এসএনএফ) গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। সংগঠনটির আহ্বায়ক ড. হামিদা হোসেন জানান, আহতদের মধ্যে ঢামেক বার্ন ইউনিটে গুরুতর অবস্থায় নয়জন চিকিৎসাধীন আছেন। ফায়ার সার্ভিসের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০১২ সালের পর থেকে বাংলাদেশে ৮৮ হাজার অগ্নিকাে র ঘটনা ঘটেছে, এতে নিহত হয়েছেন ১ হাজার ৪০০ জন এবং আহত হয়েছে অন্তত ৫ হাজার।

আজিমপুর কবরস্থানে ১৪ জনের দাফন : বৃহস্পতিবার রাতে চকবাজারের আগুনে নিহত ১৪ জনকে রাজধানীর আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করা হয় বলে জানিয়েছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) সমাজকল্যাণ কর্মকর্তা মো. শাহাদাত হোসেন। যাদের দাফন করা হয় তারা হলেন- ইয়াসিন (৩২), ইসহাক (৪৮), আরাফাত ইসলাম সিয়াম (১৯), রাশেদুল ইসলাম মিঠু (৪০), তার স্ত্রী সানিয়া ইসলাম (৩১), ছেলে শাহীর (৩), নয়ন খান (২৫), অছিউদ্দিন (২৩), বিল্লাল হোসেন (৪৬), জুম্মান (৫২), আলী (৩২), তার বড় ভাই অপু রায়হান (৩৩), তার ছেলে আরাফাত (৩) ও জয়নাল আবেদিন বাবুল (৫৬)।

নোয়াখালীর ১৩ জনের দাফন সম্পন্ন, শোকের ছায়া : রাজধানী ঢাকার চকবাজার ট্র্যাজেডিতে নিহতদের মধ্যে নোয়াখালীর ১৩ জনের পরিচয় নিশ্চিত করেছে জেলা প্রশাসন। গতকাল বিকেলে জেলা প্রশাসক তন্ময় দাস এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

এদিকে নোয়াখালীর সোনাইমুড়ীসহ বিভিন্ন উপজেলার নিহতদের বাড়িতে চলছে শোকের মাতম। স্বজন হারানোর বেদনায় শোকে মুহ্যমান পরিবারের সদস্যরা। বৃহস্পতিবার রাতে ঢাকা থেকে লাশ বাড়ি পৌঁছলে এলাকায় শোকের ছায়া নেমে আসে। স্বজনদের আহাজারিতে বাতাস ভারি হয়ে ওঠে। বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত ও গতকাল সকাল থেকে স্ব-স্ব এলাকা নিহতদের কয়েকজনের দাফন সম্পন্ন হয়েছে। জেলা প্রশাসনের তালিকা অনুযায়ী নিহতরা হলেন-১. কামাল হোসেন, পিতা- নুর মোহাম্মদ, গ্রাম মুজাহিদপুর, উপজেলা বেগমগঞ্জ ২. মোশাররফ হোসেন, পিতা-মাহফুজুর রহমান, গ্রাম-হরিদ বল্লবপুর, উপজেলা-বেগমগঞ্জ ৩. আলী হোসেন, পিতা-বুলু মিয়া, গ্রাম-পশ্চিম নাটেশ্বর ৪. হেলাল হোসেন, পিতা- সৈয়দ আহম্মদ, গ্রাম-পূর্ব নাটেশ্বর ৫. সিদ্দিক উল্লাহ, পিতা- মৃত সুরুজ মিয়া, গ্রাম-পূর্ব নাটেশ্বর ৬. মাসুদ রানা, পিতা সাহেব উল্লাহ, গ্রাম-ঘোষকামতা ৭. মাহবুবুর রহমান রাজু, পিতা-সাহেব উল্লাহ ৮. আয়েশা খাতুন, স্বামী রফিকুল মিয়া, গ্রাম চাঁনগাঁও ৯. আবদুর রহিম, পিতা-আলী আজ্জম, গ্রাম-ওয়াসেকপুর ১০. জসিম উদ্দিন, পিতা-শহীদুল হক, গ্রাম-চর এলাহী, উপজেলা- কোম্পানীগঞ্জ ১১. নাছির উদ্দিন, পিতা-গাউস মিয়া, গ্রাম নাটেশ্বর ১২. আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, পিতা-সিরাজ মিয়া, গ্রাম-দৌলতপুর ১৩. শাহাদাত উল্লা হিরা, পিতা-মৃত মমিন উল্লা, গ্রাম-মির্জা নগর।

নিহতদের মধ্যে গতকাল সকাল ৮টায় পূর্ব নাটেশ্বর গ্রামের হেলাল উদ্দিন, ৯টায় ঘোষকামতা গ্রামের মাসুদ রানা ও মাহাবুবুর রহমান রাজুর জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। এর আগে বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত ১০টায় বেগমগঞ্জের মুজাহেদপুরে কামাল হোসেন, কোম্পানীগঞ্জের জসিম উদ্দিন ও ৩টার দিকে পশ্চিম নাটেরশ্বর গ্রামের মৃত ভুলু মিয়ার ছেলে মোহাম্মদ আলী হোসেনের দাফন সম্পন্ন হয়।

ডেন্টাল কলেজছাত্রের লাশ দাফন : পুরান ঢাকার চকবাজারের ভয়াবহ আগুনে নিহত বাংলাদেশ ডেন্টাল কলেজের শিক্ষার্থী মোহাম্মদ আশরাফুল হক রাজনের লাশ গতকাল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর উপজেলার ফরদাবাদ গ্রামের পারিবারিক গোরস্তানে দাফন করা হয়। বৃহস্পতিবার রাত ৮টায় বাংলাদেশ ডেন্টাল মেডিকেল কলেজে প্রথম জানাজার পর লাশ ইস্কাটনের বাসভবনে আনা হয়। সেখান থেকে রাতে ফরদাবাদ পৌঁছলে আত্মীয়-স্বজন ও এলাকাবাসীর আর্তধ্বনিতে শোকার্ত পরিবেশের সৃষ্টি হয়। গতকাল সকাল ৮টায় স্থানীয় মসজিদে জানাজার পর পারিবারিক গোরস্তানে দাফন করা হয়। রাজনের বাবা মোহাম্মদ জামসেদ মিয়া তার পুত্রের আত্মার মাগফিরাতের জন্য দেশবাসীর দোয়া চেয়েছেন।

পটুয়াখালীতে দুজনের দাফন সম্পন্ন : চকবাজারে ভয়াবহ অগ্নিকাে  মারা গেছেন মো. এনামুল হক ও মজিবুর হাওলাদার। পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জ উপজেলার কাঁঠালতলী ইউনিয়নে তাদের বাড়ি। সকাল ১০টায় ইউনিয়নের রামপুরা ও সন্তোষপুর গ্রামে আলাদা জানাজা শেষে তাদের পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। ভোররাতে লাশ দুটি কাঁঠালতলীতে পৌঁছলে স্বজনদের আহাজারিতে এলাকায় শোকের ছায়া নেমে আসে। রামপুরা গ্রামের মো. আবদুল মতলেব কাজীর ছেলে এনামুল হক অভি পড়াশোনা শেষ করে চাকরি শুরু করেছিলেন। সন্তোষপুর গ্রামের মোসলেম হাওলাদারের ছেলে মজিবুর হাওলাদার চকবাজারের একটি প্লাস্টিক কারখানায় দীর্ঘদিন ধরে চাকরি করছিলেন।

 

সর্বশেষ খবর