রবিবার, ২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

সেই শামীমা ফের আলোচনায়

কূটনৈতিক প্রতিবেদক

সেই শামীমা ফের আলোচনায়

ঘটনা চার বছর আগের। যুক্তরাজ্যের পূর্ব লন্ডনের স্কুলপড়ুয়া তিন বান্ধবী একসঙ্গে নিখোঁজ হয়। তিন দিন পর জানা যায় তারা জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটের (আইএস) মতাদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে সিরিয়ায় পাড়ি দিয়েছেন। সেই তিন মেয়ের একজন শামীমা বেগম এখন যুক্তরাজ্যে ফিরে যাওয়ার আকুতি জানিয়েছেন। কিন্তু যুক্তরাজ্য সরকার তার ব্রিটিশ নাগরিকত্ব বাতিল করেছে। বাবা-মার সূত্রে বাংলাদেশি বংশো™ভূত শামীমার বাংলাদেশি নাগরিকত্বও নেই। বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই অবস্থান পরিষ্কার করে জানিয়েও দিয়েছে। ফলে রাষ্ট্রহীন হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে সিরিয়ায় শরণার্থী শিবিরে সন্তান জন্ম দেওয়া শামীমা বেগমের। তবে ব্রিটেনের বিরোধী রাজনৈতিক মহল থেকে শামীমার নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি তোলা হয়েছে। বিশ্ব এখন তাকিয়ে আছে শামীমার ভবিষ্যৎ কোন দিকে যায় তা দেখতে।

জানা যায়, ২০১৫ সালের ১৭ ফেব্র“য়ারি গেটউইক বিমনবন্দর দিয়ে তুরস্কে পাড়ি দেন তিন মেয়ে শামীমা বেগম, আমিরা আবাসি ও খাদিজা সুলতানা। সেখান থেকে সীমান্ত অতিক্রম করে সিরিয়া যান। শামীমা বেগম, খাদিজা সুলতানা ও শারমিনা বেগম এই তিনজন বাংলাদেশি পরিবারের সন্তান। বেথনাল গ্রিন একাডেমির তিন ছাত্রীর মধ্যে শামীমা বেগম ও আমিরা আবাসির বয়স ছিল ১৫ বছর। অপর ছাত্রী খাদিজা সুলতানা ছিলেন ১৬ বছর বয়সী। তাদের তিন মাস আগে একই বিদ্যালয়ের ছাত্রী শারমিনা বেগম নামের আরেক শিক্ষার্থী সিরিয়ায় পাড়ি দিয়েছিলেন। শারমিনার সঙ্গে যোগাযোগের সূত্র ধরেই তিন  মেয়ে একসঙ্গে সিরিয়ায় পাড়ি দেন বলে ধারণা। এর মধ্যে খাদিজা সুলতানা ২০১৬ সালে বোমা হামলায় নিহত হন বলে খবর পাওয়া গিয়েছিল। যুক্তরাজ্যের দৈনিক টাইমসের সাংবাদিক অ্যান্থানি লয়েড সম্প্রতি সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলীয় একটি শরণার্থী শিবিরে সাক্ষাৎ পান শামীমার। তবে আমিরা আবাসির ভাগ্যে কী ঘটেছে, তা জানা যায়নি। বর্তমানে ১৯ বছর বয়সী শামীমা বেগম বলেন, সিরিয়া প্রবেশ করে তারা সরাসরি রাক্কায় চলে যান। সেখানে একটি ঘরে বিভিন্ন দেশ থেকে আসা তরুণীদের একসঙ্গে রাখা হয় বিয়ে দেওয়ার জন্য। শামীমা ২০ থেকে ২৫ বছর বয়সী ইংরেজি ভাষায় কথা বলে এমন ছেলেকে বিয়ের জন্য আবেদন করেন। ১০ দিনের মাথায় ২৭ বছর বয়সী ডেনমার্কের ধর্মান্তরিত এক ছেলের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। শামীমা জানান, তিনি তাঁর স্বামীর সঙ্গে আইএসের শেষ ঘাঁটি বাঘুজ এলাকায় ছিলেন। সেখান থেকে পালিয়ে আসার সময় তাঁর স্বামী সিরিয়ান বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেন। আর তিনি শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিয়েছেন। শরণার্থী শিবিরেই তৃতীয়বারের মতো সন্তানের জন্ম দিয়েছেন শামীমা। এর আগে অপুষ্টি আর রোগে ভুগে তাঁর দুই সন্তানের মৃত্যু হয়েছে। তার প্রথম সন্তান ছিল মেয়ে। ১ বছর ৯ মাস বয়সী ওই সন্তানকে এক মাস আগে সিরিয়ার বঘুজ এলাকায় দাফন করেছেন। এর তিন মাস আগে তার আট মাস বয়সী দ্বিতীয় সন্তান মারা যায়। শামীমা বলেন, সেখানে প্রয়োজনীয় ওষুধ-চিকিৎসক কিছুই ছিল না। তাদের বঘুজ এলাকা ছাড়ার পেছনে এটিও একটি কারণ। শামীমা এখন যুক্তরাজ্যে ফিরে নবাগত সন্তানকে নিয়ে নীরব জীবনযাপন করতে চান। যুক্তরাজ্যে ফেরার জন্য তিনি সবকিছু করতে রাজি। কিন্তু জটিলতা তৈরি হয়েছে যুক্তরাজ্য তার নাগরিকত্ব বাতিল করায়। গণমাধ্যমে শামীমার ফেরার ইচ্ছা প্রকাশের পরপরই শামীমার মায়ের কাছে ব্রিটিশ সরকারের এক চিঠিতে বলা হয়েছে, তার মেয়েকে জানাতে যে তার নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। ব্রিটিশ নাগরিকত্ব আইন অনুসারে, একজন ব্যক্তি নাগরিকত্ববঞ্চিত হতে পারে যদি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মনে করেন যে এটা ‘জনস্বার্থের জন্য সহায়ক’। তবে ওই ব্যক্তি রাষ্ট্রহীন হতে পারবেন না। ব্রিটেনের হোম অফিস যুক্তি দিচ্ছে, শামীমা বেগমের নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া হলেও সে রাষ্ট্রবিহীন নাগরিকে পরিণত হবে না। শামীমার বাংলাদেশে নাগরিকত্ব পাওয়ার আইনি অধিকারের বিষয়টিকে সামনে এনে ব্রিটিশ হোম অফিস বলছে, শামীমার মা একজন বাংলাদেশি নাগরিক বলে মায়ের উত্তরাধিকার সূত্রে শামীমাও বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দাবি করার অধিকার রাখে। কারণ বাংলাদেশের বিদ্যমান আইন অনুযায়ী, ‘ব্লাড লাইন’ বা উত্তরাধিকার সূত্রে যে কোনো ব্যক্তি অন্য দেশে জন্মালেও বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পাওয়ার অধিকার রাখে। তবে বিদেশে জন্ম নেওয়া বাংলাদেশি বাবা-মায়ের সন্তান যদি বাংলাদেশি নাগরিকত্ব পাওয়ার কোনো উদ্যোগ না নেয়, তাহলে ২১ বছর বয়সে সেই ব্যক্তির বাংলাদেশি নাগরিকত্ব আপনা-আপনি খারিজ হয়ে যাবে। ব্রিটিশ হোম অফিস দাবি করে, শামীমার বয়স এখন ১৯। তাই আইনত তার এখনো দ্বৈত নাগরিকত্ব রয়েছে। কিন্তু ব্রিটিশ হোম অফিসের এ ধরনের বক্তব্যের পর বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছে, শামীমার বাংলাদেশে প্রবেশের বা নাগরিকত্বের কোনো সুযোগ নেই। ঢাকার লিখিত বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশ সরকার অত্যন্ত গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করছে, বিভিন্ন গণমাধ্যমে শামীমা বেগমকে বাংলাদেশ ও যুক্তরাজ্যের দ্বৈত নাগরিক হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। আমরা দৃঢ়তার সঙ্গে জানাতে চাই, শামীমা বাংলাদেশের নাগরিক নন। তিনি জন্মসূত্রে যুক্তরাজ্যের নাগরিক।

এ ছাড়া বাংলাদেশের দ্বৈত নাগরিকত্বের জন্য শামীমা কখনো আবেদনও করেননি। তিনি কখনোই বাংলাদেশে আসেননি। যে কারণে তাকে বাংলাদেশে আশ্রয় দেওয়ার কোনো প্রশ্নই আসে না। সব ধরনের সন্ত্রাস ও উগ্রবাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ সরকার জিরো টলারেন্স নীতিতে রয়েছে।’ পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম জানিয়েছেন, ‘বাংলাদেশ সরকার শামীমা বেগমের ব্রিটিশ নাগরিকত্ব বাতিলের খবর সংবাদ মাধ্যম থেকে জেনেছে। শামীমা বেগমের দ্বৈত নাগরিকত্ব আছে এমন তথ্য সঠিক নয় এবং এই ভুল খবরের ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকার গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। বাংলাদেশ স্পষ্ট ভাষায় জানাচ্ছে, শামীমা বেগম বাংলাদেশি নাগরিক নন। তিনি জন্ম সূত্রে ব্রিটিশ নাগরিক এবং কখনই বাংলাদেশের দ্বৈত নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করেননি। কাজেই তাকে বাংলাদেশে ঢুকতে দেওয়ার কোনো প্রশ্নই নেই।’ বাংলাদেশের এ বিবৃতির পর শামীমার বাংলাদেশে প্রবেশের কোনো সুযোগ নেই। অবশ্য শামীমাও বাংলাদেশে আসার বিষয়ে কোনো ইচ্ছাও প্রকাশ করেনি। শামীমা নিজেই ব্রিটিশ গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন তার বাংলাদেশি পাসপোর্ট নেই এবং তিনি কখনো বাংলাদেশে ছিলেন না। কখনো বাংলাদেশে আসেননি। বাংলা ভাষা বা বাংলাদেশ সম্পর্কেও কোনো ধারণা নেই। শামীমার ব্রিটেনে ফিরতে চাওয়ার এ দাবিকে সমর্থন করে দেশটির বিরোধী লেবার পার্টির নেতা জেরেমি করবিন বলেছেন, শামীমা বেগমের ব্রিটেনে ফেরার অধিকার রয়েছে। নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়ার বিষয়টিকে চরম পন্থা বলেও অভিহিত করেন তিনি। করবিনের মতো একই মত দিয়েছেন ব্রিটেনের শ্যাডো হোম সেক্রেটারি ডায়ান অ্যাবোট। শামীমার মতো তার সন্তানও ব্রিটেনে ফিরতে পারবেন বলেই আশা করছেন সবাই।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর