সোমবার, ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

দুবাইগামী বিমান ছিনতাইয়ের চেষ্টা ব্যর্থ

আকাশে হুমকি । শাহ আমানত বিমানবন্দরে জরুরি অবতরণ । কমান্ডো অভিযানে নিহত ছিনতাইকারী

নিজস্ব প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম ও ঢাকা

দুবাইগামী বিমান ছিনতাইয়ের চেষ্টা ব্যর্থ

চট্টগ্রাম শাহ আমানত বিমানবন্দরে বাংলাদেশ বিমানের সেই ফ্লাইটটি (বামে), নিরাপত্তার দায়িত্বে বিমানবন্দরে অবস্থান নেয় সেনাবাহিনী ও পুলিশ -বাংলাদেশ প্রতিদিন

গতকাল দেশের আকাশে বাংলাদেশ বিমানের দুবাইগামী যাত্রীবাহী একটি ফ্লাইট ছিনতাইয়ের চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ময়ূরপঙ্খী উড়োজাহাজ উড্ডয়নের পর এক  অস্ত্রধারী যাত্রী তা নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার চেষ্টা করে। এ সময় বিমানটি ১৫ হাজার ফুট ওপর দিয়ে চট্টগ্রাম যাচ্ছিল। প্রথমে কেবিন ক্রু ও পরে পাইলটকে জিম্মি করে এ অস্ত্রধারী যুবক। কিন্তু পাইলট কৌশলে সন্ধ্যা পৌনে ৬টার দিকে উড়োজাহাজটি চট্টগ্রাম   হযরত শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করান। এ উড়োজাহাজটি অবতরণের কিছুক্ষণ আগেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বহন করে অপর একটি উড়োজাহাজ ঢাকার উদ্দেশ্যে চট্টগ্রামের শাহ আমানত বিমানবন্দর ত্যাগ করে।   

উড়োজাহাজটি অবতরণের পর শাহ আমানতের সব কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়। দেশের সব বিমানবন্দরে রেড অ্যালার্ট জারি করা হয়। জরুরি বহির্গমন পথে সব যাত্রী বের হয়ে আসেন। একজন কেবিন ক্রুকে জিম্মি হিসেবে আটক রাখে অস্ত্রধারী। চট্টগ্রাম বিমানবন্দরের রানওয়েতে ফ্লাইটটি অবতরণের সঙ্গে সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তা ঘিরে ফেলে। এর কিছুক্ষণ পর অভিযানে নামে কমান্ডো বাহিনী। কমান্ডো অভিযান শুরুর মাত্র ৮ মিনিটের মধ্যে সন্ধ্যা ৭টা ২৪ মিনিটে ৭৩৭ উড়োজাহাজটি জিম্মিদশা থেকে মুক্ত হয়। নিহত হন বিমান ছিনতাইয়ের চেষ্টাকারী অস্ত্রধারী সেই যুবক।

ঘটনার পরে চট্টগ্রাম জিওসি মেজর জেনারেল এস এম মতিউর রহমান এক ব্রিফিংয়ে বলেন, বিমান ছিনতাইকারীকে পাকড়াও করা হয়েছে। তাকে প্রথমে আত্মসমপর্ণের জন্য অনুরোধ করা হয়। কিন্তু তিনি তা না করায় অ্যাকশনে যায় অভিযানিক দল। এতে গুলিতে নিহত হন সেই ছিনতাইকারী।

এদিকে নিরাপত্তা বাড়াতে নানা পদক্ষেপের মধ্যে বিমানবন্দর পেরিয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত বিমান সংস্থার উড়োজাহাজে কীভাবে আগ্নেয়াস্ত্র হাতে এই যুবক উঠে পড়লেন, সেই প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। নিরাপত্তা ব্যবস্থায় কোনো ত্রুটি ছিল কিনাÑ সাংবাদিকদের প্রশ্নে বেবিচক চেয়ারম্যান নাঈম হাসান বলেন, ‘আমাদের যে সিস্টেম আছে এ ধরনের ব্যক্তি নিরাপত্তা বেষ্টনী অতিক্রম করা এপারেন্টলি সম্ভব নয়। তারপরও কী হয়েছিল, তা তদন্ত করে দেখব।’

জানা গেছে, সন্দেহভাজন এই ছিনতাইকারীর নাম মাজেদুল হক ওরফে মাহাদী। তিনি ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যাচ্ছিলেন। তার গ্রামের বাড়ি লক্ষ্মীপুরে। কমান্ডোদের কাছে তিনি প্রধানমন্ত্রী ও তার স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে চাচ্ছিলেন।

আইএসপিআরের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সেনা কমান্ডোদের অভিযানে ছিনতাইকারী পরাভূত। পরিস্থিতি সেনা কমান্ডোদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এতে আরও বলা হয়, বাংলাদেশ বিমানের ময়ূরপঙ্খী উড়োজাহাজ ছিনতাইয়ের চেষ্টার ঘটনা ঘটে। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে ওই উড়োজাহাজ থেকে একজন অস্ত্রধারীকে বের করে আনা হয়। ময়ূরপঙ্খী উড়োজাহাজ ছিনতাইয়ের চেষ্টার খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেটি ঘিরে রাখেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। ময়ূরপঙ্খী উড়োজাহাজটি বোয়িং-৭৩৭ মডেলের। ১৪২ জন যাত্রী ও ৫ জন ক্রু নিয়ে বিজি-১৪৭ ফ্লাইটটি ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম হয়ে দুবাই যাচ্ছিল।

সিভিল এভিয়েশন চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল নাঈম হাসান বলেন, ছিনতাইকারীর হাতে ছিল অস্ত্র। বুকে বোমা বাঁধা থাকতে পারে। ওই বিমানে থাকা জাসদের সংসদ সদস্য মঈন উদ্দীন খান বাদল গণমাধ্যমকে বলেন, ‘বিমানে দেড়শ যাত্রী ছিলেন। পাইলট আমার সঙ্গে নেমে এসেছেন। তিনি বলেছেন, তাকে পারসু করার চেষ্টা করেছিল ছিনতাইকারী। বলেছিল, সে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে চায়।’

চট্টগ্রামের জিওসি মেজর জেনারেল এস এম মতিউর রহমান আরও বলেন, ৫টা ৩৩ মিনিটে বিমান বাহিনী জানতে পারে। ৫টা ৪১ মিনিটে বিমানটি জরুরি অবতরণ করে। প্রথমে আত্মসমর্পণের আহ্বান জানানো হয়। কিন্তু আহ্বানে সাড়া না দিয়ে সে আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে। পরে স্বাভাবিকভাবে অভিযান চালানো হয়। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় ২৫-২৬ বছর বয়সী অস্ত্রধারী তরুণকে আটক করা হয়। পরে সে মারা যায়। তিনি বলেন, কোনো যাত্রী এবং কেবিন ক্রু হতাহত হননি। সবাই নিরাপদে নেমেছেন। কারও কোনো ক্ষতি হয়নি। বিমানও অক্ষত এবং চলাচলের উপযুক্ত। ওই ছিনতাইকারী তার নাম জানিয়েছে মাহাদী। সে প্রধানমন্ত্রী এবং তার স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিল। সে বাংলা ভাষায় কথা বলেছে। আমরা জানতে পেরেছি সে বাংলাদেশি এবং তার সঙ্গে একটা পিস্তল ছিল। তিনি আরও বলেন, সন্দেহভাজন ছিনতাইকারীকে কথা বলে ব্যস্ত রাখা হয়েছিল। এই অভিযানের নেতৃত্ব দেন হলি আর্টিজান বেকারিতে নেতৃত্বদানকারী লে. কর্নেল ইমরুল কায়েস। সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে জিওসি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর বিমানের সঙ্গে এ ঘটনার কোনো সম্পর্ক নেই। এ বিমানটি ঢাকা-চট্টগ্রাম হয়ে দুবাই যাওয়ার কথা ছিল। ছিনতাইকারী সম্পর্কে পরে বিস্তারিত জানানো হবে।

এর আগে বিমান বাহিনীর জহুরুল হক ঘাঁটির প্রধান মফিদুর রহমান জানান, ২৫-২৬ বছর বয়সী অস্ত্রধারী একজনকে আটক করা হয়েছে। যাত্রী-ক্রু সবাই সুস্থ আছেন। আটক ব্যক্তির সঙ্গে তিনি নিজেই কথা বলে বিষয়টি সুরাহা করেছেন। কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। সেনাবাহিনীর স্পেশাল ফোর্স, নৌ-কমান্ডো, সোয়াত ও র‌্যাব অভিযানে অংশ নেয়। প্রধানমন্ত্রীর দফতর সরাসরি তদারকি করে। তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।

বিমানবন্দরে ব্রিফিংয়ে এয়ার ভাইস মার্শাল মফিদুর রহমানের বরাত দিয়ে আমাদের চট্টগ্রাম অফিস জানায়, ঘটনার পরপরই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে জানমাল রক্ষা করার নির্দেশ দেওয়া হয়। কৌশলে জিম্মিদশার অবসান ঘটানো হয়েছে। তবে কারও কোনো ক্ষতি হয়নি। সবাই অক্ষত রয়েছেন। বিমানেরও কোনো ক্ষতি হয়নি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিমানে থাকা একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, ঢাকা থেকে উড্ডয়নের কয়েক মিনিটের মধ্যেই ছিনতাইকারী বিমানের পাইলটকে নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টা চালায়। তার হাতে ছিল আগ্নেয়াস্ত্র ও বোমাসদৃশ বস্তু। ছিনতাই প্রচেষ্টার অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে বিমানটি চট্টগ্রাম চলে আসে। কয়েক রাউন্ড চক্কর দিয়ে বিমানটি দ্রুততার সঙ্গে শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে।

শাহ আমানত বিমানবন্দরের একাধিক সূত্র জানায়, ঢাকা থেকে বিমানটি উড্ডয়নের সঙ্গে সঙ্গে এক ব্যক্তি ককপিটের দিকে তেড়ে যায়। এ সময় ছিনতাইকারী ক্রুর কাছে গিয়ে ধাক্কা দেয় এবং তার সঙ্গে পিস্তল ও বোমা থাকার কথা বলে। ককপিট না খুললে বিমানটি উড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দেয়। এর মধ্যে ছিনতাইকারীর কথা ক্রুরা পাইলটকে গোপনে সংকেত দেন। পাইলট জরুরি অবতরণের জন্য শাহ আমানত বিমানবন্দরে বার্তা পাঠায়। ককপিটের দরজা না খোলায় ছিনতাইকারী চিৎকার করছিল। ততক্ষণে বিমানটি শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে জরুরি অবতরণ করে। অবতরণের পরপর চারটি জরুরি গেট দিয়ে যাত্রীরা দ্রুততার সঙ্গে বিমান থেকে নেমে আসেন।

খেলনা পিস্তল : গত রাতে চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ মাহবুবার রহমান সাংবাদিকদের বলেন, বিমান ছিনতাই করতে গিয়ে যে যুবক কমান্ডো অভিযানে নিহত হয়েছে, তার হাতে থাকা অস্ত্রটি খেলনা পিস্তল। জিম্মি সংকটের অবসানের পর রাতে চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ মাহবুবার রহমান এ কথা জানান। তিনি বলেন, ‘তার কাছে যে অস্ত্রটি পাওয়া গেছে এটা ফেইক, খেলনা পিস্তল। তাছাড়া শরীরে তেমন কিছু পেঁচানো ছিল না।’

তদন্ত কমিটি গঠন : বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের বিমান ময়ূরপঙ্খী ছিনতাই চেষ্টার ঘটনা তদন্তে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলীর নির্দেশে পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট এ কমিটি গঠন করা হয়। এতে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মোকাব্বির হোসেনকে প্রধান করা হয়েছে।

 

 

সর্বশেষ খবর