মঙ্গলবার, ২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

ছিনতাই নিয়ে গোলকধাঁধা

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা ও চট্টগ্রাম

ছিনতাই নিয়ে গোলকধাঁধা

খেলনা পিস্তল হাতে অভিনয়ের মুডে পলাশ

বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের দুবাইগামী যাত্রীবাহী উড়োজাহাজ ছিনতাই-চেষ্টা নিয়ে গোলকধাঁধায় তদন্তকারীরা। ঢাকা-চট্টগ্রামের মাঝ আকাশে উড়োজাহাজের ভিতর যাত্রীবেশী ছিনতাইকারী পলাশ আহমেদ মাহাদীর হাতে আসল পিস্তল, নাকি খেলনা পিস্তল ছিল, সে নিয়েও ধূম্রজালের সৃষ্টি হয়েছে। তবে আসল বা খেলনা যাই হোক না কেন, পলাশ কীভাবে উড়োজাহাজে প্রবেশ করল তা নিয়ে রহস্য দানা বেঁধেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পলাশের অতীত-বর্তমান সবকিছু খতিয়ে দেখছেন তদন্তকারীরা। এমনকি পলাশ বিমানের ভিতরে কী ধরনের আচরণ করেছিল সবই তদন্ত করে দেখা হবে। এ ব্যাপারে প্রত্যক্ষদর্শীদের মতামতও নেবেন তদন্তকারীরা। ছিনতাইয়ের মোটিভ মামুলি প্রেম-ভালোবাসা, নাকি এর পেছনে ভয়ঙ্কর কিছু রয়েছে তা তদন্তে মাঠে নেমেছে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা।

জানা গেছে, নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ের ছেলে পলাশ প্রথম জীবনে পড়াশোনা করেছে মাদ্রাসায়। এরপর কলেজে কিছুদিন পড়াশোনার পর সে নানা কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ে। এমনকি মুম্বাই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিজেও তাকে ঘোরাফেরা করতে দেখা গেছে। ব্রিটিশ এয়ারওয়েজে চাকরি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র দাবি করলেও এর সত্যতা মেলেনি। তবে চলচ্চিত্র তারকাদের সঙ্গে তার ঘোরাঘুরির অনেক চিত্রই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখা গেছে।

আইন প্রয়োগকারী সংস্থা পলাশের মোবাইলে কথোপকথন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে শুরু করেছে। পলাশ কাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখত, কী ধরনের কথাবার্তা বলত তা-ও দেখা হচ্ছে। কোনো বিশেষ মহল বা গোষ্ঠীর সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিল কিনা, তা তদন্তের আওতায় নিয়েছেন তদন্তকারীরা। অতীত ও বর্তমানে কোনো ধরনের অপরাধমূলক কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়ে খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে।

আইন প্রয়োগকারী সংস্থার একজন কর্মকর্তা বলেন, তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত অনেক কিছুই বলা যাবে না। তবে এ ঘটনা ঘিরে দেশ-বিদেশে যাতে বাংলাদেশ বিমান ও সিভিল এভিয়েশনের ভাবমূর্তি নষ্ট না হয়, সেদিকটাও খেয়াল রাখতে হবে। এ ব্যাপারে সবারই দায়িত্ব রয়েছে। নজিরবিহীন এ বিমান ছিনতাই-চেষ্টার তদন্তে এখন পর্যন্ত কোনো স্পষ্ট ধারণা করতে পারছেন না তদন্তসংশ্লিষ্টরা। সূত্র জানান, পলাশ আহমেদ কী করে পিস্তলসদৃশ বস্তু নিয়ে উড়োজাহাজে উঠল, তার কোনো সদুত্তর নেই তাদের কাছে। পলাশ তার নির্ধারিত অভ্যন্তরীণ টার্মিনাল দিয়ে উড়োজাহাজে উঠেছে। তার কাছে থাকা নিষিদ্ধ কোনো বস্তুই কেন ধরা পড়ল না, তা নিয়ে প্রশ্ন সৃষ্টি হয়েছে। তবে এ বিষয়ে সংবাদ সম্মেলনে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী বলেন, ‘এখানে এমন কোনো লিকেজ ছিল না বা নেই যে একজন যাত্রী এভাবে বিমানে যেতে পারেন।’

তাহলে অস্ত্রটা ভিতরে গেল কীভাবে- এ প্রশ্নের জবাবে বিমানসচিব মহীবুল হক বলেন, ‘সেটা অস্ত্র কিনা আমরা ওয়াকিবহাল নই। খেলনা পিস্তল কিনা তাও নিশ্চিত নই। যে কোনো কিছু হতে পারে। তদন্ত প্রতিবেদন পেলে এ নিয়ে বিস্তারিত বলতে পারব।’ তিনি বলেন, ‘আমরা সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজে দেখেছি অন্য দশজন যাত্রীর মতো তাকেও তল্লাশি করা হয়েছিল। তার কাঁধে একটা ব্যাগ ছিল। সে স্ক্যানিং মেশিনের ভিতর দিয়ে গিয়েছে। কিন্তু সেখানেও কিছু দেখা যায়নি।’

এ সময় সিভিল এভিয়েশনের চেয়ারম্যান এম নাঈম হাসান বলেন, ‘বিমান থেকে সবাই বেরিয়ে যাওয়ার পর “সো কলড” হাইজ্যাকার বিমানে একাই ছিল। আমরা সেদিন অনেক কিছুই শুনেছি। তদন্ত প্রতিবেদনে পুরো বিষয়টি বিস্তারিত জানা যাবে।’ তবে বিমানের বেশ কয়েকজন যাত্রী বলেছেন, তারা অস্ত্র দেখেছেন বিমানের ভিতরে। একটি শব্দের পর ধোঁয়াও দেখা যায়। এ সময় যাত্রীরা কান্নাকাটি শুরু করেন। এসব বিষয়ে অবশ্য সংশ্লিষ্টরা কিছু বলতে পারেননি। বিমানবন্দর সূত্র জানান, উড়োজাহাজে ওঠার আগে যাত্রীদের দুই দফা নিরাপত্তা তল্লাশিতে পড়তে হয়। এর পরই বিমানবন্দর থেকে উড়োজাহাজে ঢুকতে হয় যাত্রীদের। কিন্তু নিখুঁত নিরাপত্তার চোখ ফাঁকি দিয়ে রবিবার বিকালে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের বোয়িং ৭৩৭-৮০০ মডেলের উড়োজাহাজ ময়ূরপঙ্খীতে বসে পড়ল পলাশ। উড্ডয়নের পর অস্ত্র বের করে বিমানটি ছিনতাইয়েরও চেষ্টা করে সে। কিন্তু কীভাবে উড়োজাহাজে ঢুকে পড়ল লোকটি? এমন প্রশ্ন করছেন যাত্রী, বিমানের ফ্লাইট পরিচালনা থেকে শুরু করে নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, যদি সত্যিকারের অস্ত্র নিয়ে সে ঢুকে থাকে বিমানে, তাহলে এটা পুরো নিরাপত্তাব্যবস্থার বড় ঘাটতি।

চট্টগ্রাম থেকে আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, শাহ আমানত বিমানবন্দরে কঠোর নিরাপত্তা অব্যাহত রয়েছে। রবিবার রাতেই পলাশের লাশ ময়নাতদন্তের জন্য চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ মর্গে পাঠানো হয়। তার লাশ গ্রহণের জন্য আসেননি কোনো স্বজন। বিমান ছিনতাই-চেষ্টার ঘটনায় গতকাল বিকাল পর্যন্ত কোনো মামলা হয়নি। তবে প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।

কমান্ডো অভিযানে নিহত মাহাদীর লাশ উদ্ধারের পর সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করেন পতেঙ্গা থানার উপপরিদর্শক সুমন দে। ওই সুরতহাল প্রতিবেদনে উল্লখ করা হয়, নিহত তরুণের গায়ের রং শ্যামলা। উচ্চতা পাঁচ ফুট চার ইঞ্চি। বুকে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। পেটের উপরিভাগে নাভির দুই ইঞ্চি ওপরে ডান পাশে একটি গোলাকার ক্ষতচিহ্ন রয়েছে। মৃত্যুর সম্ভাব্য কারণ উল্লেখ করা হয় ‘কমান্ডো অভিযানে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তি (তরুণ) গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন।’

আটকে পড়া যাত্রীদের পাঠানো হয়েছে দুবাইয়ে : ছিনতাই-চেষ্টায় পড়া বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের ফ্লাইট বিজি-১৪৭-এর যাত্রীদের অন্য একটি বিমানে করে দুবাই পাঠানো হয়েছে। গতকাল দুপুর দেড়টায় আটকে পড়া যাত্রীদের নিয়ে বিমানটি দুবাইয়ের উদ্দেশে রওনা করে।

শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ব্যবস্থাপক সরওয়ার-ই-জাহান বলেন, ‘আটকে পড়া যাত্রীদের রবিবার রাতে নগরের বিভিন্ন হোটেলে রাখা হয়। আজ (সোমবার) দুপুরে অন্য একটি ফ্লাইটে করে তাদের দুবাই পাঠানো হয়।’

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর