মঙ্গলবার, ২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা
চকবাজার ট্র্যাজেডি

স্বজনদের খোঁজে এখনো ভিড়

১৪ মরদেহ শনাক্তে লাগবে আরও ১৫ দিন

নিজস্ব প্রতিবেদক

স্বজনদের খোঁজে এখনো ভিড়

পুরান ঢাকার ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পঞ্চম দিনেও ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) মর্গে নিহতদের স্বজনদের দেখা গেছে। লাশের খোঁজে গতকালও মর্গের সামনে ভিড় করেন তারা। ডিএনএ নমুনা নেওয়া হয় আরও দুজনের। স্বজন হারানোর বিলাপে শেষ মুহূর্তের স্মৃতিগুলো যেন তাদের ঘুরেফিরেই তাড়া করে। পুরান ঢাকার চকবাজারে বুধবার রাতের অগ্নিকাণ্ডে নিখোঁজ স্বজনের লাশ পেতে মর্গে আসেন কারও মা, বাবা, স্ত্রী ও সন্তানরা। ডিএনএ রিপোর্ট ধরে ১৪ লাশ বুঝিয়ে দিতে আরও ১৫ দিন সময় লাগবে বলে জানিয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।

রিকশাচালক শাহাবুদ্দিনের ছবি নিয়ে ঘুরতে দেখা যায় তার স্ত্রী সখিনা বেগমকে। তিনি তিন ছেলেকে নিয়ে সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মর্গ, সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ মর্গ ঘুরে স্বামীর লাশের সন্ধান পেতে ঢামেক মর্গে এসে ডিএনএ নমুনা দেন। কোথাও খেঁাঁজ মেলেনি শাহাবুদ্দিনের। স্ত্রী সখিনাকে অপেক্ষা করতে হবে ডিএনএ রিপোর্ট পর্যন্ত। এখান থেকে পুলিশের গাড়িতে করে সিআইডি কার্যালয়ে নিয়ে নমুনা সংগ্রহ করানো হয়। ঢাকা জেলা প্রশাসনের হিসাব মতে, বিভিন্ন হাসপাতালে থাকা ১৯টি লাশের বিপরীতে ডিএনএ টেস্টের নমুনা জমা দিয়েছে ৩৮ জন। আবার রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি বলছে, অগ্নিকাণ্ডের পর থেকে তাদের কাছে অন্তত ১৮ জন নিখোঁজের তথ্য রয়েছে।   এদিকে, অগ্নিকাণ্ডে দগ্ধ রিকশাচালক আনোয়ার হোসেনের অবস্থা খুবই আশঙ্কাজনক বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। দগ্ধদের চিকিৎসায় গঠিত ৯ সদস্য মেডিকেল বোর্ডের প্রধান অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম জানান, আনোয়ারের অবস্থা ভেরি ক্রিটিক্যাল। তার শরীরের ৬১ শতাংশ পুড়ে গেছে এবং তাকে আইসিইউতে রাখা হয়েছে। আনোয়ার ছাড়াও সোহাগসহ আরও তিনজনের অবস্থাও তেমন ভালো নয়। তবে তাদের শারীরিক অবস্থা স্ট্যাবল রয়েছে। মর্গের সামনে ডিএনএ নমুনা দিতে অপেক্ষমাণ সখিনা জানান, শাহাবুদ্দিনের বাড়ি ভোলার দৌলত খান উপজেলার চান কাজি মালবাড়ি গ্রামে। তার স্বামী কামরাঙ্গীরচরের লোহার ব্রিজ এলাকায় ভাড়া থেকে দেড় বছর ধরে ঢাকায় রিকশা চালাতেন। তিন ছেলেকে নিয়ে তিনি থাকতেন গ্রামে। ছেলেদের মধ্যে বড় ১৪ বছরের শান্ত, এরপর ১১ বছরের সাগর ও ৯ মাস বয়সী রাব্বী। ঘটনার দিন রাতে নন্দ কুমার দত্ত লেন দিয়ে রিকশা চালিয়ে যাচ্ছিলেন শাহাবুদ্দিন। ওই রাতের পর থেকে তার কোনো খোঁজ মেলেনি। রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির ফিল্ড অফিসার শাকিলা আক্তার জানান, অনেকেই সপরিবারের দগ্ধ হয়ে মারা গেছেন। তাদের কারও কারও রক্তের সম্পর্কের স্বজনদের পাওয়া যায় না। রক্তের সম্পর্কে স্বজন না হওয়ায় ডিএনএ পরীক্ষার নমুনাও তারা দেন না। এখন পর্যন্ত ১৮ জন নিখোঁজের তথ্য পাওয়া গেছে।

দুপুরে মালিবাগে সিআইডি কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি শেখ মো. রেজাউল হায়দার জানান, অগ্নিকান্ডে র ঘটনায় অজ্ঞাত ১৯ লাশের মধ্যে ১৪টি তাদের পরিবারকে বুঝিয়ে দিতে ১৫ দিন সময় লাগবে। বাকি পাঁচটি লাশ শনাক্ত করতে তিন সপ্তাহ বা তারও বেশি সময় লাগতে পারে। ৬৭টি লাশের নমুনা আমাদের কাছে রয়েছে এবং এটা সংরক্ষিত থাকবে। কোনো পরিবার যদি পরে দাবি জানায় তাহলে তখন পরীক্ষা করা হবে। তবে অবশ্যই আদালতের মাধ্যমে আসতে হবে। এর আগে বৃহস্পতিবার থেকে ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ শুরু হয়। ৬৭টি লাশ থেকে ২৫৬টি (রক্ত, টিস্যু, হাড় ও বাক্কাল সোয়াব) ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা হয়। পরে শনিবার একটি বিচ্ছিন্ন পৃথক হাতকে পৃথক আলামত হিসেবে গণ্য করে সেটিও নমুনা হিসেবে সংগ্রহ করা হয়।

চকবাজারের ঘটনা দুর্ঘটনা নয়, অবহেলা : চকবাজারের চুড়িহাট্টায় আগুনের ঘটনাকে অনাকাক্সিক্ষত উল্লেখ করে হাই কোর্ট বলেছেন, ‘এটাকে দুর্ঘটনা বলা যাবে না, এটা অবহেলা। এর দায় কাউকে না কাউকে নিতে হবে। একজন দায়িত্বশীল আরেকজনের ওপরে দোষ চাপিয়ে দিচ্ছেন, এটা ঠিক নয়।’ এ ঘটনায় হতাহতদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া, পুরান ঢাকা থেকে কেমিক্যাল গোডাউন ও গ্যাস সিলিন্ডার অপসারণ এবং নিমতলীর ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির ১৭ দফা সুপারিশ বাস্তবায়নের নির্দেশনা চেয়ে করা পৃথক তিনটি রিট আবেদনের শুনানিতে গতকাল বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহাসান ও বিচারপতি কে এম কামরুল কাদেরের সমন্বয়ে গঠিত হাই কোর্ট বেঞ্চ এ মন্তব্য করেন। আদালতের রিট আবেদনের পক্ষে শুনানিতে ছিলেন ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল, আইনজীবী অমিত দাস গুপ্ত, মো. রিয়াজ উদ্দিন ও ইউনুছ আলী আকন্দ। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানিতে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এ বি এম আবদুল্লাহ আল মাহমুদ বাশার। শুনানির শুরুতেই রাষ্ট্রপক্ষে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এ বি এম আবদুল্লাহ আল মাহমুদ বাশার সময়ের আবেদন করেন। অগ্নিকান্ডে র ঘটনায় সরকার খুব আন্তরিক বলেও উল্লেখ করেন তিনি। এ সময় আদালত বলেন, চকবাজারের অগ্নিকান্ডে র ঘটনায় কাউকে না কাউকে দায় নিতে হবে। আগুনে মানুষ পুড়ে মরে তাহলে সিটি করপোরেশন কী করে? শুধু আন্তরিক হলে হবে না। কাজ করতে হবে। হাই কোর্ট বলেন, নিমতলীর ঘটনার পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উচ্চ পর্যায়ের কমিটির যে সুপারিশ ছিল, সেগুলোর বাস্তবায়ন হলে চকবাজারে এই দুর্ঘটনা ঘটত না। নিমতলীর আগুনের ঘটনার পর প্রধানমন্ত্রী দুই বোনকে দত্তক নিয়েছিলেন। এ সময় ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, সরকার এ ব্যাপারে খুবই আন্তরিক। এ সময় আদালত বলেন, আন্তরিক হলে লাভ নেই। মানুষ তো চলে গেছে। কাজ তো করতে হবে।

জাতীয় প্রেস ক্লাবের শোক : জাতীয় প্রেস ক্লাবের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভায় চকবাজার ট্র্যাজেডিতে হতাহতের ঘটনায় গভীর শোক ও শ্রদ্ধা এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের প্রতি সমবেদনা জানানো হয়েছে। গতকাল দুপুরে ক্লাবের সভাকক্ষে নিহতদের স্মরণে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। সরকার ঘোষিত রাষ্ট্রীয় শোক দিবস পালনের অংশ হিসেবে ক্লাবপ্রাঙ্গণে জাতীয় ও ক্লাব পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়। গত ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে রাজধানীর চকবাজারে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে  নিহতদের স্মরণে গভীর শোক ও সমবেদনা জানিয়ে ক্লাব সভাপতি সাইফুল আলম বলেন, এই শোকের ঘটনায় সারা জাতির সঙ্গে আমরা একাত্মতা প্রকাশ করছি। সাধারণ সম্পাদক ফরিদা ইয়াসমিন বলেন, এ ধরনের ঘটনার যাতে পুনরাবৃত্তি না ঘটে এজন্য সংশ্লিষ্ট সব মহলকে সজাগ থাকতে হবে। তারা এ ঘটনার দ্রুত তদন্ত এবং জড়িতদের বিচারের আওতায় আনার দাবি জানান।

সর্বশেষ খবর