মঙ্গলবার, ২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

পোড়া লাশের মিছিলে মানুষ কাঁদেন, প্রধানমন্ত্রী জাগলে তারাও জাগেন

পীর হাবিবুর রহমান

পোড়া লাশের মিছিলে মানুষ কাঁদেন, প্রধানমন্ত্রী জাগলে তারাও জাগেন

আবেগ-অনুভূতিহীন, এক কথায় বোধহীন সমাজে আগুনে পোড়া লাশের মিছিল দেখলে আমরা শোকাহত হই। স্বজন হারানোর বেদনায় যারা শোকের মাতম করেন তা দেখে আমরাও অশ্রুসজল হয়ে উঠি। কেউ কেউ কাঁদি। একের পর এক কোথাও না কোথাও বড় বড় দুর্ঘটনা ঘটে। লাশের মিছিল বড় হলে সব মহলে শোরগোল ওঠে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জেগে উঠলে তখন দায়িত্বশীলরা বাঘের গর্জন করেন। হুলস্থূল শুরু করেন। মনে হয়, এরপর আর এভাবে বিভীষিকাময় ঘটনায় নিহতের সংখ্যা দেখে আঁতকে উঠতে হবে না। আর মৃত্যুর ভয় তাড়া করবে না। চকবাজারের চুড়িহাট্টার সর্বশেষ দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়া আগুনে পুড়ে নারী-পুরুষ-শিশু নির্বিশেষে মানব সন্তানদের মুহূর্তে কয়লার মতো পুড়ে যাওয়ার ঘটনায় যে প্রাণহানি ঘটেছে তার কথাই বলছি।

নিমতলী থেকে চকবাজার ট্র্যাজেডির ভয়াবহতাই শুধু আমরা দেখিনি, এর আগেও নৌপথে লঞ্চ দুর্ঘটনায় সলিল সমাধি হতে দেখেছি। সড়কপথে একের পর এক দুর্ঘটনায় মানুষের করুণ মৃত্যুর আর্তনাদ শুনেছি। চট্টগ্রামে অতি বৃষ্টি এলেই দেখেছি পাহাড় ধসে মানুষের মৃত্যু। যে মৃত্যু অনাকাক্সিক্ষত, যে মৃত্যু পরিকল্পিত ব্যবস্থাপনা, আইন ও বিধিবিধানের কঠোর কার্যকারিতা এবং ব্যাপক জনসচেতনতা তৈরির মধ্য দিয়ে প্রতিরোধ করা যায়- সেখানে আমরা দিনের পর দিন ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছি। প্রতিরোধ ও কার্যকর ব্যবস্থা নিশ্চিত করে মানবসৃষ্ট ভুলের জন্য বা আইন ও বিধিবিধান অমান্য অথবা তার কার্যকারিতা এবং মনিটর ব্যাহত হওয়ার কারণে আজ আগুনের ভয়াবহতায়ই হোক আর নৌ বা সড়ক দুর্ঘটনায়ই হোক মানুষ হত্যা থামছে না। আজ এখানে তো কাল ওখানে। শোকের মিছিল চলছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চকবাজার ট্র্যাজেডির আহত আগুনে পোড়া মানুষকে ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে দেখতে গিয়ে যথার্থ বলেছেন, ‘নিমতলীতে অগ্নিকান্ডের পর পুরান ঢাকা থেকে রাসায়নিক বা কেমিক্যালের গুদাম সরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু মালিকদের আপত্তির কারণে সেটা সম্ভব হয়নি।’ এ ঘটনাকে দুঃখজনক অভিহিত করে শেখ হাসিনা আরও বলেছেন, ‘এই ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের পর আমি আশা করি, পুরান ঢাকা থেকে রাসায়নিক গুদামগুলো সরিয়ে নেওয়ার যে দাবি উঠেছে, তাতে আর কেউ আপত্তি করবেন না।’

এ দুর্ঘটনা নিয়ে এখন পর্যন্ত নানামত উঠে এসেছে। স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, ওয়াহেদ ভবনের সামনে একটি পিকআপ ভ্যানের গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়ে এই ভয়াবহ আগুনের সূত্রপাত। কেউ বলছেন, ভবনের দোতলা থেকে আগুনের সূত্রপাত, যেখানে ছিল সুগন্ধির ক্যান ও বাল্বের গুদাম। লাইটার রিফিল করার ক্যানও সেখানে পাওয়া গেছে। কেউ কেউ বলছেন, ভবনের নিচে গোডাউনে রীতিমতো কেমিক্যালের বিপুল মজুদ রাখা হয়েছিল। এটিই এই অভিশপ্ত ট্র্যাজেডির কারণ। তদন্ত চলছে, চলুক। তদন্ত রিপোর্ট আসার পর দুর্ঘটনার কারণ জানা যাবে। কিন্তু যে মানব সন্তানরা মানবসৃষ্ট অপরাধের জন্য, কারও মুনাফার লোভ, কারও চরম দায়িত্বহীনতার কারণে এরকম বলা নেই কওয়া নেই হঠাৎ দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠা আগুনের লেলিহান ভয়াবহতায় নিহত হতে হয়েছে তারা আর কোনো দিন ফিরে আসবে না। প্রশ্ন থেকেই যায়, পুরান ঢাকা থেকে মুনাফালোভীদের অন্যায় রমরমা ভয়ঙ্কর বাণিজ্যের বিরুদ্ধে এখন কথা বলছেন, সরিয়ে নিতে কাজ শুরু করে দিয়েছেন, হামেশা টিভি চ্যানেলের ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে বড় বড় কথা বলছেন নিমতলীর ট্র্যাজেডির পর তারা কেন এই কারখানা সরাতে পারেননি। ঢাকা দক্ষিণের সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে কেন সেখানকার ব্যবসায়ী ও মানুষকে নিয়ে দিনের পর দিন বৈঠক করে এটি সরাতে পারলেন না। সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গ ও প্রশাসনের কর্তারা নিমতলী হত্যাকান্ডের পর কেন ব্যর্থ হলেন পুরান ঢাকার এই রাসায়নিক গুদাম সরিয়ে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের মৃত্যুফাঁদ থেকে মানুষকে নিরাপদ করতে?

ঢাকা উত্তরের মেয়র অকাল প্রয়াত আনিসুল হক নেতৃত্বের সততা, সাহসিকতা ও দূরদৃষ্টিতার কারণে তার নির্বাচনী এলাকাকে বদলেই দিচ্ছিলেন না, তেজগাঁওয়ের যুগের পর যুগ মাফিয়া নিয়ন্ত্রিত অবৈধ ট্রাকস্ট্যান্ড উচ্ছেদ করেছিলেন জনমত সঙ্গে নিয়েই। বনানী কবর স্থানের পাশের বিশাল জায়গা দখলমুক্ত করেছিলেন। সিলেটের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী বিএনপি থেকে নির্বাচিত হয়েও গোটা নগরীকে ঢেলে সাজাতে, রাস্তাঘাট বড়োসড়ো করতে মানুষকে সঙ্গে নিয়েই একের পর এক দেয়াল ভেঙে দিয়ে তার কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছেন। নগরের উন্নয়নে তার ডাকে সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত যেমন পৈতৃক কোটি টাকার জায়গা ছেড়ে দেয়াল ভাঙতে দিয়েছেন তেমনি নগরের অনেক মানুষও দিয়েছেন। শুভ কাজে জনগণ পাশে দাঁড়ায় নেতৃত্ব যদি লোভমোহের ঊর্ধ্বে উঠে মানুষের কল্যাণে সাহসি পদক্ষেপ নেন। আনিসুল হকের মতো নেতা আর আসবেন না। কিন্তু সিলেটের আরিফ যদি পারেন অন্য মেয়ররা কেন পারবেন না?

সারা দেশে শেখ হাসিনার সরকার ব্যাপক উন্নয়ন কর্মযজ্ঞ করে যাচ্ছেন। বিশাল বিশাল মেগাপ্রকল্প নেওয়া হচ্ছে দেশজুড়ে। বাস্তবায়নের দৃশ্যমান চিত্রও দেখা যাচ্ছে। কিন্তু পৃথিবীর সবচেয়ে নোংরা ও যানজট কবলিত রাজধানী হচ্ছে ঢাকা। ঢাকাকে নিরাপদ ও সুন্দর পরিকল্পিত নগরীতে পরিণত না করে সারা দেশে যতই উন্নয়নের জোয়ার বইয়ে দেওয়া হোক তা কাজে আসবে না। সরকারের মন্ত্রিসভার বাইরে থাকা প্রবীণ রাজনীতিবিদদের কারও নেতৃত্বে এই লক্ষ্যে প্রতিনিধিত্বশীল ব্যক্তিবর্গ বিশেষ করে নগর পরিকল্পনায় অভিজ্ঞদের নিয়ে প্রধানমন্ত্রী একটি কমিটি গঠন করে প্রস্তাবনা নিতে পারেন। গোটা নগরী যানজটে মৃত হয়ে পড়েছে। পুরান ঢাকা বসবাস অনুপযোগী। ঘিঞ্জি, সরু গলিপথের রাস্তাই নয়, যানবাহন চলাচলের অযোগ্য। অন্যদিকে রাসায়নিক গোডাউন নিয়ে মানুষ যেন মৃত্যুদূতের সঙ্গে ঘুম যায়। কখন কার জীবন যায় কেউ জানে না। নগরীজুড়ে যেখানে সেখানে নোংরা ময়লা পড়ে থাকে। অপরিচ্ছন্ন নগরীতে বৃষ্টি নামলে আর কদিন পর পানিতে ডুবে যাবে। এবার ঢাকায় যে মশার উপদ্রব, মশার যে কামড় তা থেকে কেউ রেহাই পাচ্ছেন না। মশা মারার ওষুধ যাচ্ছে কোথায়? এই পরিণতি ট্যাক্স দেওয়া মানুষেরা কেন বহন করছেন? দায়িত্বশীলরা নাগরিক সুবিধা না দিয়ে কীভাবে শান্তির ঘুমে ডুবে যান?

সড়ক দুর্ঘটনায় ক্যান্টনমেন্ট রমিজ উদ্দিন স্কুল অ্যান্ড কলেজের দুই সহপাঠী মীম ও আবদুল করিমের করুণ মৃত্যুর পর সাধারণ স্কুল ছাত্ররা গোটা দেশকে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদী আন্দোলনে জাগিয়েছিল। এমন আন্দোলন মানুষ দেখেনি কোনো দিন। সেই আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সেদিনও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কার্যকর উদ্যোগ নিয়ে পরিস্থিতি সামলে ছিলেন। অনেক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল পরিবহন ও চালকদের বিষয়ে। সেই সিদ্ধান্ত কি সঠিকভাবে মনিটর হচ্ছে? গতকাল উত্তরা-১০ নম্বর সেক্টরে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এক মাদ্রাসা ছাত্রকে বিকাশ পরিবহনের দুটি বাস আবার প্রতিযোগিতামূলক ও বেপরোয়াভাবে চালাতে গিয়ে চাপা দিয়ে মেরেছে। অনিয়ম নিয়ে কথা ওঠে। তদন্ত হয়। সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় সেগুলো আর বাস্তবায়ন হয় না। দায়িত্বশীলরা ঘুমিয়ে যান, দায়িত্বহীন অসচেতন মানুষেরা ভুলে যান আর অন্যায়কারীরা আইনকানুন ও নিয়ম লঙ্ঘন করেন।

বুড়িগঙ্গা নদীতে অবৈধ দখল উচ্ছেদ অভিযান ব্যাপক জনসমর্থন পেয়েছিল। হঠাৎ কেন বন্ধ কেউ জানে না। নৌ ও সড়ক পথের দুর্ঘটনা রোধে দায়িত্বশীলরা কতটা সজাগ, সতর্ক ও আইন বিধিবিধান কার্যকরে সফল সেটা তাদেরই বিবেচনা ও মনিটর করতে হবে। একের পর এক লাশের মিছিল মানুষকেও যেন অনেকটা অনুভূতিহীন করে দিয়েছে। সয়ে গেছে যেন সমাজে মানুষ পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাওয়ার ঘটনাও। তাই এবার চকবাজার ট্র্যাজেডির পর একদিকে যেমন শোকের মাতম, কান্না, আহাজারি ও আর্তনাদ বাতাস ভারি করেছে তেমনি সমাজের সচেতন শিক্ষিত মানুষদের দেখা গেছে পিকনিকের মতো আনন্দ উৎসবে মেতে তার রঙিন বর্ণালি ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দিতে। একটা সময় ছিল, দুর্ঘটনায় লাশের মিছিল দেখে অনেক উৎসবের অনুষ্ঠান বাতিল বা স্থগিত হয়ে যেত। দিনবদলের সঙ্গে মানুষ কতটা বদলালে সেসব আর আজকাল স্থগিত হয় না। একের পর এক দুর্ঘটনা আগুনের দাবানলে সারি সারি মানুষের মৃত্যু তবুও পুরান ঢাকার মুনাফালোভীরা নিজের জীবনের মায়া ছেড়ে কেমিক্যাল গোডাউন সরায় না। স্বেচ্ছায় না সরালে সরকারকে জোরপূর্বক আইনের আওতায় এনে তাদের এখন সরিয়ে দেওয়ার সময়। মানুষের জীবনের চেয়ে দুনিয়ায় মূল্যবান কিছু হতে পারে না। মুনাফা লাভের সঙ্গে মানুষের জীবন মৃত্যুর খেলা চলে না। 

সর্বশেষ খবর