বুধবার, ২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

ভারত গুঁড়িয়ে দিল পাকিস্তানি জঙ্গি ঘাঁটি

অংশ নেয় ১২ যুদ্ধবিমান । ৩০০ জন নিহতের দাবি । উত্তাপ-উত্তেজনা । সীমান্তে সতর্ক দুই দেশের বাহিনী

নয়াদিল্লি ও কলকাতা প্রতিনিধি

ভারত গুঁড়িয়ে দিল পাকিস্তানি জঙ্গি ঘাঁটি

মিরাজ-২০০০ বোমারু বিমান দিয়ে হামলা চালায় ভারত (প্রতীকী ছবি বামে)। হামলায় পাকিস্তানের ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা -এএফপি

পাকিস্তানের ভিতরের জঙ্গি ঘাঁটি গুঁড়িয়ে দিয়েছে ভারতীয় বিমানবাহিনী। গতকাল ভোর ৪টার দিকে ভারতীয় ১২টি যুদ্ধবিমান সীমান্ত অতিক্রম করে পাকিস্তানের অভ্যন্তরে বালাকোটে অবস্থিত জঙ্গল-পাহাড়ে ঘেরা জইশ-ই-মোহাম্মদের জঙ্গি ঘাঁটি গুঁড়িয়ে দেয়। মাত্র কয়েক মিনিটের হামলায় লেজার নির্দেশিত পথে পাক অধিকৃত কাশ্মীরের প্রায় ৮০ কিলোমিটার ভিতরে ১ হাজার কিলোগ্রাম ওজনের বোমা ফেলে প্রায় ৩০০ জঙ্গিসহ আস্তানা নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হয়। নিহতের মধ্যে জঙ্গি সংগঠনের শীর্ষস্থানীয় একাধিক নেতাও রয়েছেন। একে  একে বালাকোট, চাকোটি ও মুজাফফরাবাদে জইশ-ই-মোহাম্মদের তিনটি লঞ্চপ্যাড ধ্বংস করেছে ভারত। গুঁড়িয়ে দিয়েছে জইশের কন্ট্রোল রুম আলফা-৩। কাশ্মীরের পুলওয়ামাতে ৪০ ভারতীয় জওয়ানকে জঙ্গি হামলায় হত্যার পাল্টা হিসেবে হামলা করল ভারত। ১৯৭১ সালের পর এই প্রথম ভারতীয় বিমানবাহিনী সীমানা অতিক্রম করে পাকিস্তানে সার্জিক্যাল অপারেশন চালাল। গতকাল নয়াদিল্লিতে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে হামলার বিবরণ দেন। এখন পর্যন্ত পাকিস্তান কোনো পাল্টা হামলা করেনি। তবে ভারতীয় সেনাদের সর্বোচ্চ সতর্কবাণী জারি করে সীমান্তে অ্যালার্ট করা হয়েছে। বিভিন্ন সূত্রে বলা হয়েছে, প্রায় ২১ মিনিট ধরে পাক অধিকৃত কাশ্মীরের আকাশে ছিল ভারতীয় বিমান সেনার যুদ্ধবিমানগুলো। ভারতীয় সেনা সূত্রের খবর, চকোটিতে বোমাবর্ষণ করা হয়েছে রাত ৩টা ৫৮ মিনিট থেকে ভোর ৪টা পর্যন্ত। মুজাফফরাবাদে বোমাবর্ষণ চলে রাত ৩টা ৪৮ থেকে ৩টা ৫৫ মিনিট পর্যন্ত। ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে এই সেনা অভিযান নিয়ে সবিস্তার রিপোর্ট দিয়েছেন। প্রতিরক্ষামন্ত্রী নির্মলা সীতারমণ, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং, অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি, পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজসহ উচ্চপদস্থ মন্ত্রীরা এ বৈঠকে ছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর ওই বৈঠকের পর পররাষ্ট্র সচিব বিজয় কেশব গোখলে বিবৃতি দেন। এ অভিযানের পর ভারতীয় বিমান সেনাকে অভিনন্দন জানিয়ে টুইট করেছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতা। কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী লিখেছেন, ‘ভারতীয় বিমান সেনার পাইলটদের সালাম জানাই।’ ভারতীয় বিমান সেনার অভিযানকে কুর্নিশ জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি, দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল প্রমুখ। ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিজয় গোখলে জানান, ভারতের বিমানবাহিনীর সদস্যরা পাকিস্তানের বালাকোটে অবস্থিত জইশ-ই-মোহাম্মদের জঙ্গি ঘাঁটি গুঁড়িয়ে দিয়েছে। এতে সাধারণ নাগরিক ও সামরিক প্রতিষ্ঠানের ওপর হামলা করা হয়নি। কেবল জঙ্গিদের বিরুদ্ধে হামলা করা হয়েছে। গত দুই দশক ধরে পাকিস্তানের ভাওয়ালপুরে মাসুদ আজহারের নেতৃত্বে জইশ-ই-মোহাম্মদ সন্ত্রাসবাদী কাজ করে চলেছে। এ সংগঠন ২০০১ সালে ভারতের পার্লামেন্ট ও ২০১৬ সালে পাঠানকোট বিমানঘাঁটিতে হামলা চালায়। এ সংগঠনকে জাতিসংঘ নিষিদ্ধ করেছে। তার পরও তারা পাকিস্তানে থেকে অবাধে কাজকর্ম চালিয়েছে। ২০০৪ সালে পাকিস্তান লিখিতভাবে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তাদের জমিতে জঙ্গি সংগঠনকে কাজ করতে দেবে না। কিন্তু তা মানা হয়নি। এমনকি বুধবার পাকিস্তান সরকারকে জানানো হয়েছিল পাকিস্তান ও পাক অধিকৃত কাশ্মীরে এ সংগঠন অবাধে সশস্ত্র প্রশিক্ষণ শিবির চালিয়ে আসছে। কিন্তু পাকিস্তান তা অস্বীকার করেছে। শত শত জিহাদি এ প্রশিক্ষণ শিবিরে প্রশিক্ষণ নিয়ে চলেছে, যা পাকিস্তান সরকারের অজানা নয়। পাকিস্তান সরকার এসব জঙ্গিশিবির ধ্বংস করার কোনো উদ্যোগ নেয়নি। পরে গোয়েন্দা সূত্র ব্যবহার করে ভারতীয় বিমানবাহিনীর সেনারা পাকিস্তানের অভ্যন্তরের বালাকোটের জঙ্গিশিবির ধ্বংস করে দিয়েছে। এ শিবিরে বহু জঙ্গি কমান্ডার মারা গেছেন। এ শিবির পরিচালনা করতেন জঙ্গি মাসুদ আজহারের শ্যালক মাওলানা ইউসুফ আজহার। ভারতীয় বিমানবাহিনী বলেছে, গতকাল সার্জিক্যাল স্ট্রাইকে ভোররাত সাড়ে ৩টা নাগাদ পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরে ঢুকে পড়ে বিমান সেনার মিরাজ ২০০০ ফাইটার বিমান। বেছে বেছে হামলা চালানো হয় জইশ-ই-মোহাম্মদের জঙ্গিগুলোয়। পুলওয়ামার হামলার পর জম্মু-কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর জঙ্গি ঘাঁটিগুলো পাকিস্তানের পক্ষ থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়। ফলে বেশ খানিকটা ভিতরে ঢুকে হামলা চালানো হয়। বালাকোট খাইবার-পাখতুনখাওয়ার একটি শহর; যা নিয়ন্ত্রণরেখা থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার ভিতরে। সেখানেই জইশ-ই-মোহাম্মদের প্রধান জঙ্গিশিবির রয়েছে। ফলে সেখানে গিয়েই এ হামলা চালানো হয়। সোমবার দিবাগত ভোররাতে মুজাফফরাবাদ ও চকোটিতে জঙ্গিশিবিরে হামলা চালানো হয়েছে। ২১ মিনিট চলে এ হামলা। তবে এ হামলায় হতাহতের কথা অস্বীকার করেছে পাকিস্তান। এ ব্যাপারে তারা কিছু ছবিও প্রকাশ করেছে। পাকিস্তানের দাবি, ভারত আক্রমণ করতে চেয়েছিল, কিন্তু পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাদের প্রতিহত করেছে। পাকিস্তান আন্তবাহিনী জনসংযোগ পরিদফতর (আইএসপিআর) বলেছে, সীমান্তরেখা লঙ্ঘন করেছে ভারতীয় বিমানবাহিনীর জঙ্গিবিমান। তবে তৎক্ষণাৎ জোরালো জবাব দেওয়ায় তারা পালিয়ে গেছে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মুখপাত্র মেজর জেনারেল আসিফ গফুর বলেছেন, ‘মুজাফফরাবাদ সেক্টর থেকে পাকিস্তানে অনুপ্রবেশ করেছে ভারতীয় বিমানবাহিনীর বিমান। বালাকোট সেক্টরে বোমা ফেলেছে। তবে পাক অধিকৃত কাশ্মীরে ভারতের এ হামলায় কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি।’

ভারতের সংবাদ সংস্থা এএনআইর খবরে জানানো হয়, ভারতের বিমান হামলার বিষয়টি টের পাওয়ার পর পাকিস্তানি সেনারা প্রতিরোধের চেষ্টা চালায়। তাদের তরফে পাঠানো হয় এফ-১৬ যুদ্ধবিমান। কিন্তু ভারতের শক্তি দেখে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয় পাকিস্তানি সেনারা। কোনোরকম প্রতিরোধের সাহসই তারা দেখাতে পারেনি। ভারতীয় বিমান হামলার পর জরুরি বৈঠক করেছেন পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মাহমুদ কুরেশি। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কার্যালয়ে ওই বৈঠকে অংশগ্রহণ করেছেন পাকিস্তানের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ও কূটনীতিকরা। পরে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ‘দেশের মানুষের দুশ্চিন্তার কিছু নেই। আমরা সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে সফল লড়াই করেছি। আমরা শান্তিকামী জাতি এবং সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে সচেতন রয়েছি। আমাদেরও আত্মরক্ষার্থে জবাব দেওয়ার অধিকার আছে।’

দুই পক্ষকে ধৈর্য ধরতে বলল চীন : পুলওয়ামায় জঙ্গি হামলায় সেনা নিহতের প্রতিশোধে পাকিস্তানের বালাকোটে ভারতীয় বিমানবাহিনীর হামলার পর সৃষ্টি হওয়া যুদ্ধ পরিস্থিতিতে উভয় পক্ষকে ধৈর্য ধারণের আহ্বান জানিয়েছে চীন। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বরাত দিয়ে পিটিআই এ খবর জানিয়েছে। চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র লু কাং বলেন, আমরা আশা করি ভারত এবং পাকিস্তান উভয়ই চলমান পরিস্থিতিতে ধৈর্য ধরবে এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে সহায়তা করে এমন কিছু করে নিজেদের সম্পর্কের উন্নতি ঘটাবে।

সর্বশেষ খবর