মঙ্গলবার, ৫ মার্চ, ২০১৯ ০০:০০ টা

মাদক পাচারে নিরাপদ রুট

দেশজুড়ে বিশাল নেটওয়ার্ক, পৃষ্ঠপোষকতায় জনপ্রতিনিধি-প্রভাবশালী নেতারা দুর্নীতিবাজ প্রশাসনের যোগসাজশ, সম্পৃক্ততা কয়েকজন শোবিজ তারকারও

সাঈদুর রহমান রিমন

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিয়মিত অভিযান, ক্রসফায়ার, গোয়েন্দা তৎপরতা সত্ত্বেও সক্রিয় মাদক মাফিয়ারা। সারা দেশে রয়েছে তাদের শক্তিশালী নেটওয়ার্ক। তারা ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে দেশের বিভিন্ন স্থানে অন্তত ৫৬ জন জনপ্রতিনিধি, শতাধিক প্রভাবশালী নেতা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নানা পর্যায়ের কয়েক শ লোভী সদস্যকে মাদক বাণিজ্যে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িয়ে রেখেছে।

একটি সরকারি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের ওয়ার্ড, থানা, জেলা ও মহানগর পর্যায়ের নেতা থেকে খোদ সংসদ সদস্য পর্যন্ত সম্পৃক্ত রয়েছেন। আছেন ‘সিআইপি’ মর্যাদা পাওয়া ধনাঢ্য ব্যবসায়ী আর সরকারি কর্মকর্তারাও। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের প্রতিবেদনেও এসব প্রভাবশালী ব্যক্তিকে ১৪১ মাদক মাফিয়ার নেপথ্য শক্তি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ইতিমধ্যেই সে তালিকা দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) পাঠানো হয়েছে।

ইয়াবা ব্যবসায় টেকনাফের সাবেক সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদির নাম শীর্ষে থাকলেও ‘ইয়াবা সাম্রাজ্যের’ একচ্ছত্র অধিপতি কিন্তু সাইফুল করিম ওরফে হাজী সাইফুল নামের এক আন্তর্জাতিক চোরাকারবারি। টেকনাফের বাসিন্দা সাইফুল সিআইপি। গত আট বছর ইয়াবার বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করে তিনি হাজার কোটি টাকার মালিক। টেকনাফ-কক্সবাজার এলাকায় অন্তত ৩০ জন সরবরাহকারী এবং সারা দেশে শতাধিক পাইকার ডিলারের মাধ্যমে সবচেয়ে বড় ইয়াবা নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছেন হাজী সাইফুল। রাজধানীসহ আশপাশের এলাকায় মাদক মাফিয়াদের মধ্যে আছে বিহারি ক্যাম্প, রামপুরা ও মেরুল-বাড্ডা, বনানী, গুলশান, ভাটারা, খিলক্ষেত, উত্তরখান, দক্ষিণখান, তুরাগ, ভাসানটেক, শাহআলী, রূপনগর, মিরপুর, তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলের অন্তত ৬৪ জনের নাম; যারা এলাকায় মাদকের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেন। এদের কেউ কেউ মাদক ব্যবসার গডফাদার হিসেবেও এলাকায় পরিচিত। কিন্তু তারা সবাই রয়েছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যে কোনো অভিযানের আগেই তাদের কাছে খবর পৌঁছে যায়।

রাজধানীর বাইরে : সূত্র জানান, জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থা (এনএসআই), সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা (ডিজিএফআই), পুলিশ-র‌্যাব, কোস্টগার্ড, বিজিবি, আনসার-ভিডিপির তালিকা থেকে একটি সমন্বিত প্রতিবেদন তৈরি করে প্রধানমন্ত্রীর দফতরে জমা দেওয়া হয়েছে। ওই প্রতিবেদনসূত্রে জানা যায়, মাদক পাচার ও সরবরাহ বাণিজ্যে কক্সবাজারের পরই অবস্থান কুমিল্লার। অন্যদিকে থানা পর্যায়ে মাদকের আধিক্যের বেলায় টঙ্গী ও আশুলিয়া এলাকা রয়েছে শীর্ষে। এ দুটি এলাকায় প্রতিদিন গড়ে কোটি টাকার মাদক কেনাবেচা চলে বলে তথ্য রয়েছে। কুমিল্লা জেলার তালিকায় ৮৯ জন মাদক ব্যবসায়ীর নাম থাকলেও গডফাদার পর্যায়ের রয়েছেন ১৬ জন। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া সীমান্ত এলাকা মাদক পাচার ও সরবরাহের অন্যতম রুট। এখানে মাদক ব্যবসায় জড়িত রয়েছেন ‘নোয়াখাইল্যা সুমন’ নামে একজন। তিনি একাধিকবার গ্রেফতারও হয়েছিলেন। কিন্তু তার ব্যবসা ও মাদকের বিস্তার বন্ধ করা যায়নি। নারায়ণগঞ্জে মাদক ব্যবসায় অন্তত একডজন মাফিয়া রয়েছেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কোনো কোনো কর্মকর্তার সঙ্গে দহরম-মহরম থাকায় তাদের বিরুদ্ধে অভিযান হলেও ধরা পড়েন না। মাদক মাফিয়াদের তালিকায় রয়েছেন ফেনীর ‘ভাতিজা ইসমাইল’। তিনি বিএনপি দলীয় এক সাবেক (সংরক্ষিত নারী আসন) সংসদ সদস্যের ভাতিজা হিসেবে পরিচিত। তার বাড়ি ফেনী সদরের কাজীরবাগ এলাকায়। তালিকায় রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ-নাটোরের সীমান্তকেন্দ্রিক মোট ২১ জন মাদক গডফাদারের নাম রয়েছে। এরা সীমান্তের ওপার থেকে বড় বড় মাদক চালান এনে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করেন। এর বাইরে দিনাজপুরের হাকিমপুর, হিলি; রাজশাহীর গোদাগাড়ী, চারঘাট; চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ, মনাকষা; চুয়াডাঙ্গার দর্শনা; সাতক্ষীরার কালীগঞ্জ’ ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট; সিলেটের গোয়াইনঘাট, জাফলং; হবিগঞ্জের সাতছড়ি; ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া; ফেনীর ছাগলনাইয়া; খাগড়াছড়ির রামগড়; বান্দরবানের রুমা, নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্ত পয়েন্ট দিয়েও সক্রিয় সংঘবদ্ধ মাদকচক্র। অভিযোগ রয়েছে, স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একশ্রেণির অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশের ভিত্তিতে তারা মাদক ব্যবসা করেন।

শোবিজের গ্ল্যামার : শোবিজের নামি-বেনামি পারফরমাররা ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে যে জড়িত তা প্রথম জানা যায় জান্নাতুল ফেরদৌস নিকিতা ওরফে ‘মডেল নিকিতা’ ধরা পড়ার পর। ২০০৭ সালে তাকে গ্রেফতার করে র‌্যাবের একটি টিম। নিকিতা থেকে র‌্যাব অনেক তথ্য পায়। মাদক ব্যবসার সঙ্গে চলচ্চিত্রের বেশ কয়েকজন নায়িকাসহ শোবিজের অন্তত একডজন গ্ল্যামার গার্লের সন্ধান পান গোয়েন্দারা। মাদক অধিদফতরের এক কর্মকর্তা জানান, বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম এলাকার লাগেজ পার্টির কয়েকজন সদস্য নিয়মিত থাইল্যান্ড যাওয়া-আসা করেন এবং সেখান থেকে সরাসরি ইয়াবা নিয়ে আসেন। কয়েকজন বিমানবালা তাদের সহযোগিতা করেন বলেও জানতে পারেন গোয়েন্দারা। নাটক, সিনেমা ও মিউজিক ভিডিও তৈরির শুটিংয়ের নামে দল বেঁধে কক্সবাজার-টেকনাফ, সেন্ট মার্টিন ঘুরে ইয়াবার বড় বড় চালান নিয়ে ঢাকায় ফেরার তথ্যও রয়েছে গোয়েন্দাদের কাছে। এর আগে বেশ কয়েকটি অভিযানে শুটিং গ্রুপের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ মাদক উদ্ধারের নজির রয়েছে।

মুরগি ব্যবসায়ীদের লিঙ্ক : মুরগি ব্যবসায়ী ও মাদক ডিলারদের মধ্যে চমৎকার দহরম-মহরম। উভয়েই রাতারাতি কোটিপতি বনে যাওয়ায় সাধারণ মানুষের মধ্যে ‘টাশকি’ অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। কুড়িল, খিলক্ষেত, বিমানবন্দর, বাড্ডা, মিরপুর, কাপ্তানবাজার, গেন্ডারিয়া, যাত্রাবাড়ী, কারওয়ান বাজার, কল্যাণপুরসহ রাজধানীর বিভিন্ন বাজার এলাকায় চিহ্নিত আড়তে প্রতি রাতে মুরগিবোঝাই পিকআপ এসে থামে। খাঁচা থেকে বেশকিছু মুরগি আলাদা করে তা চেরাই-ফাড়াই করারও ঘটনা ঘটে। ফার্মের জীবন্তু মুরগিগুলো কীভাবে ব্যবসায়ীদের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করছে, তা নিয়ে অনুসন্ধানের শুরুতেই চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে এসেছে।

জানা গেছে, কক্সবাজারের উখিয়া ও কুতুপালং এলাকায় গত কয়েক বছরে বেশকিছু পোলট্রি ফার্ম গড়ে উঠেছে। যেসব ফার্মের মুরগির মলদ্বারে ইয়াবার প্যাকেট ঢুকিয়ে খাঁচায় ভরে রাজধানীতে আনা হয়। মুরগিকে চিহ্নিত করতে লাল-সবুজ রং ব্যবহার করা হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও এসব মুরগির খাঁচায় কোনোরকম তল্লাশি চালান না। আড়তের চালানের সঙ্গে ইয়াবা বহনকারী মুরগি আনার বিনিময়ে মুরগি আড়তদার প্রতিটি মুরগি বাবদ ৩ হাজার টাকা করে পান বলে জানা গেছে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর