শিরোনাম
বুধবার, ৬ মার্চ, ২০১৯ ০০:০০ টা

ঘাটে ঘাটে সিন্ডিকেট

চোরাচালান, মাদক ব্যবসা, খাদ্যে ভেজাল, সড়ক-রেল থেকে বিমান, স্বাস্থ্যসেবা শিক্ষা, রাজনীতি থেকে শুরু করে সবখানে গড়ে উঠেছে সিন্ডিকেট

সাঈদুর রহমান রিমন

ঘাটে ঘাটে সিন্ডিকেট

দেশের সর্বত্র সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য। চোরাচালান থেকে মাদক ব্যবসা সবখানেই সিন্ডিকেট। ভেজাল খাদ্য বিক্রি, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাত থেকে শুরু করে পণ্যের আমদানিতেও একই চিত্র। সিন্ডিকেট করে আমদানিকৃত পণ্যের দাম বাড়ানোর রেকর্ড অনেক পুরনো। ভেজাল সামগ্রী বিক্রির সিন্ডিকেট সবসময় শক্তিশালী। রেল থেকে বিমান আবার বিমানবন্দরগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ থেকে শুরু করে ব্যবসা-বাণিজ্যের সিন্ডিকেট প্রচণ্ড  দাপটশালী। টেন্ডার বাণিজ্যের সিন্ডিকেটের আধিপত্যে দলমত নেই। আবার দলীয় রাজনীতিতেও রয়েছে আলাদা সিন্ডিকেট। রাজউক, তিতাস, সিটি করপোরেশনের মতো সেবা খাতগুলোও সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি। সরকারি অফিস-আদালতের সব ব্যবসাই নিয়ন্ত্রণ করে বিভিন্ন ধরনের গ্রুপ। এদের কাছে আদর্শ নয়, ব্যবসা-বাণিজ্যই বড়। অনেকটা ঘাটে ঘাটেই সিন্ডিকেট। ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণকারী কয়েকটি প্রভাবশালী সিন্ডিকেটের কাছে অনেক সময় সরকারও অসহায় হয়ে পড়ে। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখার সরকারি উদ্যোগ-আয়োজন সবকিছুই ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কারসাজিতে ভন্ডুল হয়ে যায়। ব্যবসা ক্ষেত্রে আরেকটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করে। তাদের দাপটের সামনে দেশি পণ্য ও উৎপাদিত সামগ্রী কোণঠাসা। এ সিন্ডিকেটের সঙ্গে দেশি বাজার নিয়ন্ত্রণকারী সিন্ডিকেট মিলে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি, বাজারমূল্য বৃদ্ধি ঘটাতেও দ্বিধা করে না। দেশে ভেজাল খাদ্য প্রস্তুত ও বাজারজাতের ক্ষেত্রেও রয়েছে শক্তিশালী সিন্ডিকেট। তাদের প্রভাবের কাছে বিএসটিআইসহ ভেজাল প্রতিরোধকারীরা বড়ই অসহায়। বার বার অভিযান চালিয়ে ভেজাল খাদ্য প্রস্তুত, উৎপাদন ও বাজারজাত কোনোভাবেই বন্ধ করা যাচ্ছে না। এমনকি ভেজাল খাদ্যের মূল নিয়ন্ত্রকদের কাউকে আটক বা শাস্তির আওতায়ও আনা যাচ্ছে না। কারও কারও মতে, দাপুটে সিন্ডিকেটের কাছে দেশের রাজনীতি পর্যন্ত জিম্মি। তাদের ইশারাতেই ঘটে রাজনৈতিক দলাদলি, হানাহানি, সংঘাত। কাকে নেতা বানানো হবে, কাকে সরিয়ে দেওয়া হবে সূক্ষ্ম পরিকল্পনার মাধ্যমেই তা বাস্তবায়ন করে সিন্ডিকেট। রাজধানী থেকে প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যায়েও খুন-খারাবি, চাঁদাবাজি, দখলবাজি, টেন্ডারবাজি থেকে শুরু করে সংঘাত-সংঘর্ষ সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করছে কোনো না কোনো সিন্ডিকেট। আধিপত্য সৃষ্টি এবং সাম্রাজ্যের বিস্তৃৃতি ঘটাতেই একেক স্থানে একেকজন নেতা অপরাধের নেপথ্য নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠছেন। এসব ঘটনায় সম্পৃক্ত খুনি, দুর্বৃত্ত, সন্ত্রাসীরা রাজনৈতিক ছায়াতলেই আশ্রয় নিয়ে বহাল তবিয়তে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে।

আবার রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের দমিয়ে রেখে প্রশাসনিক সিন্ডিকেটের পৃষ্ঠপোষকতায় অন্যরকম অপরাধ ঘটে চলেছে অনেক জায়গায়। বেশকিছু থানার পুলিশ কর্মকর্তাও স্থানীয় রাজনীতিবিদদের সঙ্গে নিয়ে ক্ষমতাধর সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন। এ সিন্ডিকেটে সম্পৃক্ত থাকার সুবাদেই পুলিশ কর্মকর্তারা মানুষকে হয়রানি করেন। মানব পাচার, জনশক্তি রপ্তানি, এমনকি হজে লোক পাঠানোর বিষয়ও নিয়ন্ত্রণ করছে শক্তিশালী ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট।

পরিবহন সেক্টরের সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছে সিন্ডিকেট। কেন্দ্রীয় পর্যায়ের তিনটি সিন্ডিকেটের আওতায় দেশব্যাপী চলে পরিবহন সেক্টরের কোটি কোটি টাকার চাঁদাবাজি। অপরাধজগতের অনেকেই এখন স্থানীয় পর্যায়ের রাজনীতি ও প্রশাসনের নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠেছেন। কোনো কোনো রাজনৈতিক নেতা নানা অপরাধের পাশাপাশি মাদক ব্যবসার সঙ্গেও সম্পৃক্ত। দেশব্যাপী ইয়াবা ও ফেনসিডিলের হাজার হাজার কোটি টাকার বাণিজ্যের মূলেও রয়েছেন রাজনৈতিক নেতা, এমনকি নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিও। কক্সবাজারের এক এমপির ওপর সব দায় চাপিয়ে দেশের আরও ১৯টি পয়েন্টে মাদকসহ সব ধরনের চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ করছেন জনপ্রতিনিধিরা। সেদিকে কারও নজর নেই। মোহাম্মদপুরে সাড়ে ১৭ একর আয়তনের জেনেভা ক্যাম্পে ছয়জন গড়েছেন ইয়াবা সিন্ডিকেট। জেনেভা ক্যাম্পের এ ইয়াবা সাম্রাজ্যকে কেন্দ্র করে এ পর্যন্ত ২১ জন খুন হয়েছেন। লুটপাটের সিন্ডিকেট দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হয়ে আসছে বিমান বাংলাদেশ। এ সিন্ডিকেটের কারণে রাষ্ট্রীয় এই সংস্থাটি কোনোকালেই লাভের মুখ দেখতে পায় না। শক্তিশালী এ সিন্ডিকেটটিকে হটাতে পারে না কেউ। আন্তর্জাতিক সাত সিন্ডিকেটের সহযোগী হিসেবে দেশি ১৬টি চক্র পরিচালনা করছে সোনা চোরাচালান। এসব চক্রে সম্পৃক্ত বিভিন্ন স্তরের দুই শতাধিক সদস্য। তারা দেশের দুটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরসহ কয়েকটি পয়েন্টে গড়ে তুলেছেন শক্তিশালী ঘাঁটি। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস ছাড়াও অন্তত আটটি আন্তর্জাতিক এয়ারলাইনস কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশ রয়েছে তাদের।

স্বাস্থ্য অধিদফতরে সরকার আসে সরকার যায়, মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীও বদল হন; কিন্তু সিন্ডিকেট বহাল থাকে বছরের পর বছর। তারা গোটা অধিদফতর লুটেপুটে খায়। এবারই প্রথম দুদকের তৎপরতায় স্বাস্থ্য অধিদফতরের আফজাল সিন্ডিকেটকে তছনছ করে দেওয়ার ঘটনা ঘটে। নিম্ন শ্রেণির কর্মচারী হয়েও আফজালের শত শত কোটি টাকার মালিক বনে যাওয়ার ঘটনা তদন্ত করতেই দুর্নীতিবাজ ৪৬ জন কর্মকর্তার নানা লুটপাটের কাহিনী বেরিয়ে এসেছে।

জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে সংসদ সদস্যদের আলাদা সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করে ঠিকাদারি থেকে শুরু করে সব ধরনের কাজ। সরকারের ভর্তুকির সারের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে অবৈধভাবে হাতিয়ে নিচ্ছে শত কোটি টাকা। ওই সিন্ডিকেটের কারসাজিতেই কৃষক ন্যায্যমূল্যে সার পাওয়া থেকে বঞ্চিত থাকছেন। ধান-চাল সংগ্রহেও রয়েছে আরেক সিন্ডিকেটের অপ্রতিরোধ্য প্রভাব। কৃষকের উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে সরকার বাড়তি দাম দিয়ে ধান-চাল সংগ্রহ করলেও সে সুফল ভোগ করতে পারেন না তারা। রাজনৈতিক দলের টাউটরাই মূলত নিয়ন্ত্রণ করে প্রতিটি এলাকার ধান-চাল সংগ্রহের বিষয়টি।

সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, দফতর, অধিদফতর ও সেবা খাতে ভর করেছে সিন্ডিকেটের আছর। দেশের সাধারণ মানুষের জন্য সরকারের নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের সুফল গিলে খাচ্ছে তারা। এ সিন্ডিকেটের কারণে সেবা খাত সাধারণ মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়। ওয়াসা, ডেসা, রাজউক, সড়ক ও জনপথ বিভাগ, সিটি করপোরেশন, রেলওয়ে, এলজিইডি থেকে শুরু করে সার আমদানি ও ধান-চাল ক্রয়, টেন্ডারবাজি সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করছে সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেট। উন্নয়নকাজের মানও রক্ষা হয় না লুটেরাদের কারণে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর