বৃহস্পতিবার, ৭ মার্চ, ২০১৯ ০০:০০ টা

নিরাপত্তা নিয়ে যত নাটকীয়তা

ইলিয়াস কাঞ্চনের পিস্তল নিয়ে তোলপাড় তদন্ত কমিটি, অন্যদিকে চট্টগ্রামে বিমান ছিনতাই চেষ্টা তদন্তে ঘুরপাক হদিস নেই সিমলার

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা ও চট্টগ্রাম

শাহজালাল বিমানবন্দরের নিরাপত্তা নিয়ে নাটকীয় ঘটনার শেষ নেই। খেলনা পিস্তল দিয়ে বিমান ছিনতাই চেষ্টার তদন্তে কর্মকর্তারা যখন হিমশিম খাচ্ছে, ঠিক সেই সময়ে ১০ রাউন্ড গুলিসহ আসল নাইন এম এম পিস্তল নিয়ে নায়ক ইলিয়াস কাঞ্চনের নিরাপত্তা বেষ্টনী পেরিয়ে যাওয়ার ঘটনা আবারও নতুন করে তোলপাড়। বিশেষ করে একই বিমানবন্দরের স্ক্যানিং মেশিনে আসল বা খেলনা পিস্তল-কোনোটাই দেখা গেল না কেন, এমন প্রশ্ন সামনে চলে এসেছে। মাত্র দেড় সপ্তাহের ব্যবধানে বিমানবন্দরের এমন নজিরবিহীন ভঙ্গুর নিরাপত্তা ব্যবস্থার চিত্র ফুটে ওঠায় সিভিল এভিয়েশন এখন ভিষণ চাপে। তবে সিভিল এভিয়েশন বলছে, এ ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। বরখাস্ত করা হয়েছে একজন নিরাপত্তা কর্মীকে।

এভিয়েশন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্ক্যানিং মেশিনে অস্ত্র না দেখার কোনো কারণ নেই। এখনকার স্ক্যানিং মেশিনগুলো এতটাই অত্যাধুনিক যে, একটি আগ্নেয়াস্ত্র তিন ভাগ করে একটি ব্যাগে রাখা হলেও তা সংকেত দেবে স্ক্যানিং মেশিন। শুধু তাই নয়, ওই তিনটি অংশ জোড়া দিলে কী ধরনের হতে পারে, তার ছবি দেখা যাবে স্ক্যানিং মেশিনে। কিন্তু স্ক্যানিং মেশিনে কেন খেলনা বা আসল অস্ত্রের অস্তিত্ব দেখা যায়নি, তা বের করা জরুরি বলে মনে করেন তারা।

ইলিয়াস কাঞ্চনের অস্ত্র : বরখাস্ত ১ তদন্ত কমিটি গঠন

ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের অভ্যন্তরীণ টার্মিনালে চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চনের পিস্তল ও গুলি স্ক্যানারে ধরা না পড়ার ঘটনায় ফজলার রহমান নামের একজন নিরাপত্তাকর্মীকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। তিনি বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) স্বতস্ত্র নিরাপত্তা প্রহরী। একই সঙ্গে এ ঘটনা তদন্তে তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করেছে বেবিচক। গতকাল দুপুরে বেবিচকের পক্ষ থেকে এসব তথ্য জানানো হয়েছে।

মঙ্গলবার বিকালে নভোএয়ারের ভিকিউ-৯০৯ ফ্লাইটে শাহজালাল বিমানবন্দর হয়ে চট্টগ্রামে যাচ্ছিলেন তিনি। তার ব্যাগে থাকা লাইসেন্স করা পিস্তলটি বাসায় রেখে আসতে ভুলে যান। এরই মধ্যে বিমানবন্দরের প্রবেশ গেটে ব্যাগটি তল্লাশি করা হয়। নভোএয়ারের বোর্ডিং কাউন্টারে এসে ব্যাগে থাকা পিস্তলের কথা মনে পড়ে ইলিয়াস কাঞ্চনের। স্ক্যানিং মেশিনে পিস্তল ধরা না পড়ায় তিনি অবাক হন। পরে এ ব্যাপারে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেন ইলিয়াস কাঞ্চন। তাৎক্ষণিক শাহজালাল কর্তৃপক্ষ তার কাছে দুঃখ প্রকাশ করে। নভোএয়ারের বুকিং কাউন্টারে গিয়ে ইলিয়াস কাঞ্চন জানান, ৯ এমএম পিস্তল আর ১০ রাউন্ড গুলি ভুলবশত সঙ্গে নিয়ে এসেছেন তিনি। বিমানবন্দরে দুই দফা ব্যাগ ও দেহ তল্লাশি করা হলেও পিস্তলটা শো করেনি। পরে বিষয়টি জানাজানি হলে তোলপাড় শুরু হয় বিমানবন্দরে। তবে সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করে। গতকাল এ নিয়ে সিভিল এভিয়েশন কর্মকর্তারা মুখ খুলতেও চাননি। একজন অফিসার আরেক অফিসারের সঙ্গে কথা বলতে বলেন।

তবে এ বিষয়ে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নিরাপত্তা পরিচালক নূরে আলম সিদ্দিকী গতকাল গণমাধ্যমকে বলেছেন, প্রথম স্ক্যানারের ঘটনাটি সত্য, তবে দ্বিতীয় স্ক্যানারে এসে তার সঙ্গে পিস্তল থাকার বিষয়টি ধরা পড়ে। এরপর ইলিয়াস কাঞ্চন বিষয়টি স্বীকার করেন এবং তার সঙ্গে থাকা পিস্তল নিয়ে ভ্রমণ করতে চান। কিন্তু এ বিষয়ে ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, আমি নিজে থেকে যদি না বলতাম তাহলে তারা জানতেই পারত না যে আমার সঙ্গে পিস্তল আছে। তাদের নিরাপত্তা নিয়ে আমার সংশয় হচ্ছে। আমি ব্যতীত কোনো সন্ত্রাসী যদি পিস্তল নিয়ে যেত তাহলে অন্য ঘটনাও ঘটতে পারত।

বিমান ছিনতাই তদন্ত কাগজে কলমেই : বাংলাদেশ বিমানের উড়োজাহাজ ‘ময়ুরপঙ্খী’ ছিনতাই চেষ্টা মামলার তদন্ত ঘুরপাক খাচ্ছে কাগজে কলমে। ছিনতাই চেষ্টা ঘটনার পর ১০ দিন পেরিয়ে গেলেও রহস্যের কিনারা করতে পারেনি মামলার তদন্তকারী চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট। তদন্ত দল বিভিন্ন অফিস থেকে তথ্য-উপাত্তা সংগ্রহে দিন পার করছে। ‘ময়ুরপঙ্খী’ ছিনতাই চেষ্টাকারী পলাশ আহমেদ ওরফে মাহাদী ওরফে মাহিবি জাহানের ‘দ্বিতীয় স্ত্রী’ শামসুন নাহার সিমলা বিদেশে অবস্থান করায় তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেনি কাউন্টার টেররিজম ইউনিট। এ ব্যাপারে চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ (সিএমপি)-এর কমিশনার মাহাবুবর রহমান বলেন, ‘এ মামলার উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি নেই। এ ঘটনার রহস্য উন্মোচনে কাউন্টার টেররিজম ইউনিট কাজ করছে।’ সিএমপি’র কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের উপকমিশনার মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, ‘এখনো বলার মতো কোনো অগ্রগতি নেই। সম্ভাব্য সব দিক খতিয়ে আমরা এগোচ্ছি। আশা করছি দ্রুত সময়ের মধ্যে ভালো কোনো রেজাল্ট দিতে পারব।’ জানা যায়, ‘ময়ুরপঙ্খী’ ছিনতাই চেষ্টা ঘটনা এখনো ধোঁয়াশা। পুলিশ জানতে পারেনি কী কারণে পলাশ বিমান ছিনতাই চেষ্টা করেন। এর পেছনে কোনো হোতা রয়েছে কি না। তদন্ত দল রহস্য উন্মোচনের চেষ্টায় তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের পর শুরু করবে বিমানের চালক, ক্রু, যাত্রী এবং বিমানবন্দরের কর্মকর্তা কর্মচারীদের জিজ্ঞাসাবাদ। নিহত পলাশের পরিবারের সদস্য এবং ঘনিষ্ঠজনদেরও জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। আগামী সপ্তাহে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করা হবে বলে জানান তদন্ত সংশ্লিষ্টরা।

সিমলা বিদেশ অবস্থান করছেন : ‘ময়ুরপঙ্খী’ ছিনতাই চেষ্টাকারী পলাশের ‘দ্বিতীয় স্ত্রী’ শামসুন নাহার সিমলা বিদেশে অবস্থান করছেন বলে মামলার তদন্তকারী সংস্থা সিএমপির কাউন্টার টেররিজম ইউনিট যোগাযোগ করতে পারছে না। চিত্র নায়িকা সিমলার ব্যবহার করা বিভিন্ন নম্বর যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও নম্বরগুলো বন্ধ থাকায় যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি তার সঙ্গে। এমনকি সিমলার ঢাকা ও গ্রামের বাড়ির ঠিকানাও মেলেনি তার বিষয়ে কোনো তথ্য।

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের পরিদর্শক রাজেশ বড়ুয়া বলেন, ‘সিমলার ব্যবহার করা নম্বরগুলো বন্ধ রয়েছে। তার হোয়াটসআপ নম্বরেও বন্ধ রয়েছে। বিভিন্ন মাধ্যমে তার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু কোনোভাবেই তার সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভাব হয়নি।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সিমলা দেশের বাইরে রয়েছে তা এ তথ্য বিভিন্ন মাধ্যমে জেনেছি। আমরা চেষ্টা করছি তার সঙ্গে যোগাযোগ করার। তিনি যদি আমাদের ডাকে সাড়া না দেন তাহলে, ওনাকে আমরা গিল্টি মনে করব।’

আলামত ফরেনসিক ল্যাব

ছিনতাইকারীর কবলে পড়া বিমান ‘ময়ুরপঙ্খী’ থেকে উদ্ধার হওয়া আলামত পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে সিআইডি’র ফরেনসিক ল্যাবে। আদালতের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে মামলার আলামতগুলো পরীক্ষার জন্য ল্যাবে পাঠানো হয়েছে।

মামলার তদন্তকারী সংস্থা কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘আদালত থেকে অনুমতি পাওয়ার পর আলামতগুলো সিআইডির ফরেনসিক ল্যাবে পাঠানো হয়েছে। পরীক্ষার জন্য পাঠানো আলামতের মধ্যে রয়েছে পলাশের কাছ থেকে উদ্ধার হওয়া ‘পিস্তল’, বোমাসাদৃশ্য বস্তু, বিমানে বিস্ফোরিত ‘পটকার’ অংশ, পলাশের ব্যবহৃত বস্তুসহ কমপক্ষে ১০টি আলামত। প্রসঙ্গত, গত ২৩ ফেব্রুয়ারি বিকালে ঢাকা থেকে উড্ডয়নের পর বিমানের ফ্লাইট ‘ময়ুরপঙ্খী’ ছিনতাইয়ের চেষ্টা করে পলাশ আহমেদ ওরফে মাহাদি ওরফে মাহিবি জাহান। বিমানটি চট্টগ্রাম হয়ে দুবাই যাওয়ার কথা ছিল। বিমানটি ছিনতাইয়ের প্রচেষ্টার পর শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে। পরে প্যারা কমান্ডো অভিযান চালিয়ে জিম্মিদশা থেকে বিমানটি মুক্ত করে। অভিযানেই নিহত হন ‘ময়ুরপঙ্খী’ ছিনতাই চেষ্টাকারী পলাশ আহমেদ। এ ঘটনায় শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সিভিল এভিয়েশন বিভাগের প্রযুক্তি সহকারি দেবব্রত সরকার বাদী হয়ে একটি মামলা দায়ের করেন। যাতে নিহত পলাশ আহমেদসহ অজ্ঞাতনামা কয়েকজনকে আসামি করা হয়। পরবর্তীতে মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় কাউন্টার টেররিজম ইউনিটকে।

আবার উড়বে ময়ূরপঙ্খী : ছিনতাই চেষ্টার শিকার বাং?লাদেশ বিমানের উড়োজাহাজ ময়ূরপঙ্খী আজ উড়াল দেবে। ইতিমধ্যে মেরামতের সব কাজ শেষ। এটি এখন উড্ডয়নের জন্য প্রস্তুত। বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) ও উড়োজাহাজটির নির্মাতা প্রতিষ্ঠান বোয়িং কোম্পানির অনুমতি পাওয়া গেলে আজ থেকে উড়োজাহাজটি আকাশে উড়বে। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) শাকিল মেরাজ গতকাল বলেন, উড়োজাহাজটি উড্ডয়নের জন্য তৈরি। বেবিচক ও বোয়িংয়ের কাছ থেকে ক্লিয়ারেন্স পেলে ৭ মার্চ থেকে এটি দিয়ে ফ্লাইট অপারেশন শুরু হবে।

সর্বশেষ খবর